৭৬তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ-কৌরবপক্ষীয় সুষেণসংহার
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর ধনঞ্জয় রণস্থলে গমন করিলে সূতপুত্রের সহিত তাহার কিরূপ সংগ্রাম হইতে লাগিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। পাণ্ডবগণের ধ্বজদণ্ডসম্পন্ন সুসজ্জিত সৈন্যগণ রণস্থলে সমাগত হইয়া নিনাদসহকারে বর্ষাকালীন জলপটলের ন্যায় গৰ্জন করিতে আরম্ভ করিল। তৎকালে সেই ভীষণ সংগ্রাম অসাময়িক অনিষ্টজনকবর্ষার ন্যায় নিতান্ত ক্রূর ও প্রজাবিনাশক হইয়া উঠিল। মহাকায় মাতঙ্গসকল মেঘ, বাদ্য, নেমি ও তলধ্বনি গম্ভীর নির্ঘোষ; সুবর্ণময় বিচিত্র আয়ুধসমুদয় বিদ্যুৎ, শর, অসি ও নারাচ প্রভৃতি অস্ত্রসকল জলধারার ন্যায় শোভা ধারণ করিল। এই যুদ্ধে অনবরত রুধিরধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল। অসংখ্য ক্ষত্রিয় কালকবলে নিপতিত হইলেন। তক্কালে বহুসংখ্যক রথী সমবেত হইয়া একমাত্র রথীকে, একমাত্র রথী বহুসংখ্যক রথীকে এবং একজন রথী অন্য একজন রথীকে মৃত্যুমুখে নিপাতিত করিতে লাগিলেন। কোন রথী প্রতিপক্ষ রথীকে অশ্ব ও সারথির সহিত সংহার করিলেন এবং কোন কোন গজারোহী একমাত্র মাতঙ্গদ্বারা বহুসংখ্যক রথ ও অশ্বসমুদয় চুর্ণ করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক অরাতিপক্ষীয় অসংখ্য পদাতি, মহাকায় মাতঙ্গ, অশ্বসারথিসমবেত রথ ও সাদিসমবেত অশ্বসমুদয়কে শমনসদনে প্রেরণ করিতে লাগিলেন; তখন কৃপাচার্য্য শিখণ্ডীর সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন, সাত্যকি দুর্য্যোধনের প্রতি যুদ্ধার্থ গমন করিলেন এবং শ্রুতশ্রবা দ্রোণপুত্রের, যুধামন্যু চিত্রসেনের ও উত্তমৌজা কর্ণপুত্র সুষেণের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। সহদেব, ক্ষুধার্ত্ত সিংহ যেমন বৃষের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ গান্ধাররাজ শকুনির প্রতি দ্রুতবেগে ধাবমান হইলেন। নকুলনন্দন শতানীক কর্ণপুত্র বৃষসেনের প্রতি শরনিকরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বৃষসেনও শতানীককে লক্ষ্য করিয়া অনবরত শরজাল নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর নকুল কৃতবর্ম্মাকে এবং পাণ্ডবসেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন সসৈন্য কর্ণকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। মহারথ দুঃশাসনও সংশপ্তকসৈন্যগণসমভিব্যাহারে ভীমপরাক্রম ভীমসেনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর মহাবীর উত্তমৌজা শাণিতশদ্বারা অবিলম্বে কর্ণাত্মজ সুষেণের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। কর্ণতনয়ের ছিন্নমস্তক ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল, প্রতিধ্বনিত করিয়া সমরাঙ্গনে নিপতিত হইল।
“মহাবীর কর্ণ সুষেণের মৃত্যুদর্শনে একান্ত কাতর হইয়া ক্রোধভরে সুনিশিত শরনিকরে উত্তমৌজার অশ্ব, রথ ও ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন উত্তমৌজা শাণিত শরনিকরে ভাস্বরখড়্গদ্বারা কৃপাচার্য্যের পার্ষ্ণিগ্রাহগণকে বিনষ্ট করিয়া অবিলম্বে শিখণ্ডীর রথে আরোহণ করিলেন। ঐ সময় শিখণ্ডী কৃপাচার্য্যকে রথশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার উপর শরহার করিতে অভিলাষী হইলেন না। অনন্তর মহাবীর দ্রোণপুত্র কৃপাচাৰ্য্যকে পঙ্কে নিপতিত বৃষভের ন্যায় বিপন্ন দেখিয়া সত্বর তাঁহার নিকট আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন। ঐ সময় হিরণ্যবৰ্মধারী ভীমসেন গ্রীষ্মকালীন মধ্যাহ্নগত দিবাকরের ন্যায় প্রখর তেজপ্ৰকাশপূর্ব্বক সুনিশিত শরনিকরে আপনার পুত্রগণের সৈন্যসমুদয়কে নিপাতিত করিতে লাগিলেন।”