২২. ভীমের কীচকবধ-সঙ্কল্প-সঙ্কেত নিরূপণ

২২তম অধ্যায়

ভীমের কীচকবধ-সঙ্কল্প-সঙ্কেত নিরূপণ

ভীম কহিলেন, “হে যজ্ঞসেনি! তুমি যাহা কহিলে, আমি তদনুষ্ঠানে সম্মত আছি। অদ্য নিশ্চয় আমি কীচককে সবান্ধবে শমনসদনে প্রেরণ করিব। তুমি সমুদয় শোক-সন্তাপ পরিত্যাগপূর্ব্বক কল্য কীচকের সহিত সঙ্কেত করিবে। বিরাটরাজ এক নৃত্যশালা প্রস্তুত করিয়াছেন, তথায় কন্যাগণ দিবাভাগে নৃত্য করিয়া রাত্রিকালে স্ব স্ব গৃহে গমন করিয়া থাকে। সেই স্থানে রমণীয় এক শয্যা প্ৰস্তুত আছে, দুরাত্মা কীচক যেন প্রদোষসময়ে ঐ নৃত্যশালায় উপস্থিত হয়, আমি তথায় উহাকে সংহার করিব সন্দেহ নাই। ঐ দুরাত্মা যখন তোমার সহিত আলাপ করিবে, তৎকালে কেহ যেন তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে না পারে।”

তাহারা পরস্পর এইরূপ কথোপকথনানন্তর একান্ত দুঃখিত মনে পরস্পর বাষ্পমোক্ষণপূর্ব্বক প্রভাতকালে প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে দ্রুপদনন্দিনী স্বীয় আবাসে প্রস্থান করিলেন। রজনী প্রভাত হইবামাত্র দুরাত্মা কীচক শয্যা হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক রাজভবনে গমন করিয়া দৌপদীকে কহিল, “হে সুশ্রোণি! আমি ভূপালের সমক্ষেই তোমাকে পদাঘাত করিয়াছিলাম, তিনি তোমাকে রক্ষা করিতে পারিলেন না। বিরাটরাজ মৎস্যদেশের নামমাত্র রাজা, কিন্তু বস্তুত আমিই এ স্থানে নৃপতি ও সেনাপতি। হে ভীরু! তুমি আমার প্রণয়িনী হও, আমি যাবজ্জীবন তোমার দাস হইয়া থাকিব। আমি এই মুহূর্তেই তোমাকে একশত নিষ্ক এবং তৎসংখ্যক দাসী, দাস ও অশ্বতরীযুক্ত রথ প্রদান করিতেছি, আমাকে ভজনা কর।”

দ্ৰৌপদী-সঙ্কেতে কামাতুর কীচকের নৃত্যশালায় গমন

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে কীচক! আমি তোমার মনোরথ পরিপূর্ণ করিতে সম্মত আছি, কিন্তু তোমার ভ্রাতা বা অন্যান্য বন্ধুগণ কেহই যেন এই বিষয় জ্ঞাত হইতে না পারে; কারণ, পাছে সেই যশস্বী গন্ধর্ব্বগণের অযশ হয়, এই ভয়ে আমি সাতিশয় ভীত হইতেছি। অতএব যদি তুমি গোপনে আমার সহিত সঙ্গত হও, তাহা হইলে আমি তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করিতে পারি।”

কীচক কহিল, “সুন্দরি! আমি তোমার বাক্যানুরূপ কাৰ্য্য করিতে সম্মত আছি। আমি তোমার সমাগমলাভের নিমিত্ত একাকীই ত্বদীয় নির্জন আলয়ে গমন করিব। সেই সূৰ্য্যসঙ্কাশ গন্ধর্ব্বগণ তোমার এই বিষয়ের বিন্দুবিসর্গও জানিতে পরিবেন না।” তখন দ্রৌপদী কহিলেন, “বিরাটরাজ এক নৃত্যশালা প্রস্তুত করিয়াছেন, তথায় কন্যাগণ দিবাভাগে নৃত্য করিয়া রাত্রিকালে স্ব স্ব গৃহে গমন করিয়া থাকে। অন্ধকার হইলে তুমি তথায় গমন করিবে; তাহা হইলে আর কোন দোষেরই অপেক্ষা নাই।”

দ্রৌপদী কীচকের সহিত এইরূপ সঙ্কেত করিয়া সত্বর তথা হইতে গমন করিলেন। তৎকালে অর্দ্ধদিবসও তাঁহার মাসতুল্য বোধ হইতে লাগিল। দুরাত্মা কীচকও হর্ষোৎফুল্ললোচনে নিজ নিকেতনে প্ৰতিগমন করিল, কিন্তু সৈরিন্ধ্রী যে তাহার মৃত্যুস্বরূপ হইয়াছে, তাহা কিছুতেই অবগত হইতে পারিল না। পরে অনঙ্গ শরে একান্ত জর্জরিত হইয়া অবিলম্বে গন্ধমাল্য প্রভৃতি বিহারযোগ্য বেশভুষাদ্বারা আপনাকে অলঙ্কৃত করিতে আরম্ভ করিল। তৎকালে সেই আয়তলোচন দ্রৌপদীকে নিরন্তর অনুধ্যান করিতে করিতে তাহার মন এমন চঞ্চল হইয়া উঠিল যে, সেই বেশবিন্যাস-কালও অতি দীর্ঘ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। যেমন দশাদহনোন্মুখ [বৰ্ত্তি—সলতে] দীপশিখা নির্ব্বাণকালে সমধিক সমুজ্জ্বল হইয়া উঠে, তদ্রূপ কীচকও অচিরাৎ কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক শ্ৰীভ্রষ্ট হইবে বলিয়া তৎকালে সাতিশয় শোভমান হইতে লাগিল। ঐ দুরাত্মা দ্ৰৌপদীর বাক্যে বিশ্বাস করিয়া তদীয় চিন্তায় এরূপ নিমগ্ন হইয়াছিল যে, কিরূপে দিব্যাবসান হইল, কিছুই জানিতে পারিল না।

এ দিকে দ্রৌপদী মহানসে ভীমসেনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে ভীম! আমি তোমার বচনানুসারে কীচককে নৃত্যশালায় আগমন করিতে সঙ্কেত করিয়াছি। সেই গৃহ লোকশূন্য, সে শীঘ্রই তথায় গমন করিবে। অতএব তুমি নিশাকালে একাকী তাহাকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত প্ৰস্তুত হও। ঐ পাপাত্মা অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া গন্ধৰ্ব্বগণের অবমাননা করিয়াছে; অতএব তুমি সত্বর নৃত্যশালায় প্রবেশপূর্ব্বক তাহার প্রাণসংহার করিয়া আমার অবিরল-বিগলিত নয়ন-জল মার্জনা, কুলের মানরক্ষা ও আপনার শ্রেয় সাধন কর।”

ভীমসেন কহিলেন, “হে ভীরু! তুমি যখন আমাকে প্রিয়সংবাদ প্ৰদান করিতেছ, তখন অবশ্যই স্বচ্ছন্দে আগমন করিয়াছ সন্দেহ নাই। আমি পূর্ব্বে হিড়িম্বকে বধ করিয়া যেরূপ প্রীতিলাভ করিয়াছিলাম, এক্ষণে তোমার মুখে এই প্রিয়সংবাদ শ্রবণ করিয়া ততোধিক সন্তুষ্ট হইলাম। আমি সত্য, ভ্রাতৃগণ ও ধর্ম্মের শপথ করিয়া কহিতেছি, যেমন দেবরাজ বৃত্ৰাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন, সেইরূপ আমি অন্যসাহায্যনিরপেক্ষ হইয়া কীচককে নিহত ও প্রোথিত করিব। যদি অত্ৰত্য লোকে কীচকবধে জাতক্ৰোধ হইয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিতে সমুদ্যত হয়, তাহা হইলে আমি তাহাদিগের বন্ধসাধনেও পরাঙ্মুখ হইব না। তৎপরে দুৰ্য্যোধনকে বিনাশ করিয়া এই সসাগরা বসুন্ধরা অধিকার করিব। আমি কদাচ ধর্ম্মরাজের অনুরোধ রক্ষা করিব না। তিনি এক্ষণে স্বেচ্ছানুসারে বিরাটরাজের উপাসনা করুন।”

নৃত্যশালায় ভীমের প্রচ্ছন্ন অবস্থান— ভীম-কীচকের যুদ্ধ

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে ভীম! তুমি প্রচ্ছন্নভাবে দুরাত্মা কীচককে বিনাশ করিবে, দেখিও, যেন আমার নিমিত্ত তোমাকে সত্যভ্রষ্ট হইতে না হয়।” ভীমসেন কহিলেন, “প্রিয়ে! তুমি যাহা কহিলে, আমি তদনুরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠানে সম্মত আছি। আমি গাঢ়তিমিরে প্রচ্ছন্ন হইয়া অদ্যই কীচককে সবান্ধবে শমনসদনে প্রেরণ করিব। ঐ দুরাত্মা বারংবার তোমাকে প্রার্থনা ও তোমার অবমাননা করিয়াছে, অদ্য তাহার প্রতিফল প্ৰাপ্ত হইবে। গজরাজ যেমন নিম্বফল গ্রহণ করে, তদ্রূপ আমি তাহার মস্তক আক্রমণপূর্ব্বক ভূগর্ভে প্রোথিত করিব।” ভীমপরাক্রম ভীমসেন এই বলিয়া নিশাকালে নৃত্যশালায় গমনপূর্ব্বক প্রচ্ছন্নভাবে উপবেশন করিয়া সিংহ যেমন মৃগের আকাঙক্ষা করিয়া থাকে, তদ্রূপ কীচকের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরে দুর্বুদ্ধি কীচক কামিজনোচিত অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হইয়া দ্ৰৌপদীলাভের প্রত্যাশায় সেই অন্ধ-তমসাচ্ছন্ন সঙ্কেতস্থানে প্রবেশ করিল। ভীমসেন ইতিপূর্ব্বে তথায় আগমনপূর্ব্বক একান্তে শয়ান ছিলেন। দ্ৰৌপদী-পরাভবনিবন্ধন তাঁহার কলেবর ক্ৰোধে কম্পিত হইতেছিল। দুরাত্মা কীচক একান্ত কামমোহিত হইয়া হৃষ্ট-মনে দ্ৰৌপদী-বোধে বৃকোদরকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক হাস্যমুখে কহিতে লাগিল, “প্রিয়ে! আমি তোমার নিমিত্ত অসংখ্য ধন প্রেরণ করিয়াছি এবং দাসীশত-পরিবৃত রূপলাবণ্য-সম্পন্ন যুবতীগণে অলঙ্কৃত অন্তঃপুর পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্বর তোমার নিকট আগমন করিতেছি। আমার অন্তঃপুরচারিণী রমণীগণ সতত এই বলিয়া আমার প্রশংসা করে যে, তোমার তুল্য প্রিয়দর্শন পুরুষ এই ভূমণ্ডলে আর দৃষ্টিগোচর হয় না।” তখন ভীমসেন কহিলেন, “হে কীচক! আমার পরমসৌভাগ্য যে, তুমি অসামান্য-রূপসম্পন্ন হইয়া আত্মপ্রশংসা করিতেছ। ফলতঃ তোমা অপেক্ষা স্ত্রীলোকের প্রীতিকর পুরুষ আর দৃষ্টিগোচর হয় না। তুমিও ঈদৃশ স্পৰ্শীসুখ কদাচ অনুভব কর নাই। আহা! তোমার কি চমৎকার স্পৰ্শজ্ঞান! কি রসিকতা! কি কামশাস্ত্রে বিচক্ষণতা!”

ভীমপরাক্রম ভীমসেন এই কথা বলিয়া সহসা গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক সহাস্যবদনে কহিলেন, “রে দুরাত্মন! সিংহ যেমন পর্ব্বতপ্রতিম মহাগজকে অনায়াসে আক্রমণ করে, সেইরূপ আমি তোর ভগিনীর সমক্ষেই তোকে ভূতলে বিকর্ষণ করিব। তুই নিহত হইলে সৈরিন্ধ্রী নিরাপদ ও তাঁহার পতিগণ পরম সুখী হইয়া স্বচ্ছন্দে কালযাপন করিবেন।” মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর এই কথা বলিয়া কীচকের কেশগ্রহণ করিলেন; কীচকও বাহুবলে অতিবেগে স্বীয় কেশ বিমুক্ত করিয়া তাহার বাহুযুগল আক্রমণ করিল। এইরূপে উভয়ে ক্ৰোধপরবশ হইয়া ভয়ানক বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন বসন্তকালে বলবিক্রান্ত দ্বিরদযুগল [করী] করিণীর নিমিত্ত উন্মত্ত হইয়া যুদ্ধ করে, যেমন কপিকুলসিংহ বালী ও সুগ্ৰীব পত্নীর নিমিত্ত একান্ত ক্ৰোধাক্ৰান্ত হইয়া দুরন্ত সমরসাগরে অবগাহন করিয়াছিলেন, সেইরূপ আশীবিষোদ্ধত ভীম ও কীচক পরস্পর জিগীষাপরবশ হইয়া প্রচণ্ড সমরানল প্রজ্জ্বলিত করিলেন। উভয়ে পঞ্চশীর্ষ ভুজগসদৃশ ভীষণ ভুজদণ্ড সমুদ্যত করিয়া পরস্পর নখাঘাত ও দন্তাঘাত করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কীচক ভীমকে অত্যন্ত আঘাত করিল, কিন্তু স্থিরপ্রতিজ্ঞ বৃকোদর এক পদও বিচলিত হইলেন না। তাঁহারা পরস্পর আশ্লেষ [আঁকড়াইয়া ধরা], আকর্ষণ ও প্রকর্ষণপূর্ব্বক যুদ্ধ করিয়া প্রবৃদ্ধ বৃষভদ্বয়ের ন্যায় এবং নখ ও দন্তপ্রহার করিয়া ভীষণমূর্ত্তি ব্যাঘ্রযুগলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। পরে অমর্ষপ্ৰদীপ্ত কীচক, মদস্রাবী মাতঙ্গ যেমন অন্য মাতঙ্গকে আক্রমণ করে, তদ্রুপ বেগে ধাবমান হইয়া বাহুদ্বারা ভীমসেনকে আক্রমণ করিল; মহাবল ভীমসেনও তাঁহাকে প্রত্যাক্রমণ করিলেন। কীচক পুনরায় বলপূর্ব্বক তাহাকে নিক্ষেপ করিল। তৎকালে সেই পুরুষদ্বয়ের ভুজনিস্পেষে বেণুবিস্ফোটসদৃশ [বাঁশফাটার শব্দ] ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইতে লাগিল।

অনন্তর মহাবরী বৃকোদর কীচককে গৃহমধ্যে আকর্ষণপূর্ব্বক, প্রচণ্ড বায়ু যেমন প্ৰকাণ্ড মহীরুহকে আন্দোলিত করে, তদ্রূপ তাহাকে সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। কীচক ভীমের সঙঘর্ষণে নিতান্ত দুর্ব্বল ও কম্পিত্যকলেবর হইয়া প্ৰাণপণে তাঁহাকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। ভীম ক্রোধবশতঃ ঈষদবিচলিত হইবামাত্র কীচক জানুপ্রহারদ্বারা তাঁহাকে ভূতলে পাতিত করিল। ভীমসেন তাহাতে কিঞ্চিম্মাত্রও ব্যথিত না হইয়া দণ্ডপাণি কৃতান্তের ন্যায় তৎক্ষণাৎ পুনরুত্থিত হইলেন।

বলদৃপ্ত ভীমসেন ও কীচক এইরূপ পরস্পর স্পৰ্দ্ধা প্রকাশ ও তর্জনগর্জনপূর্ব্বক নিশীথসময়ে সেই বিজনস্থলে পরিকর্ষণ করাতে সমুদয় গৃহ মুহুর্ম্মুহু কম্পিত হইতে লাগিল। তখন ভীমসেন ক্ৰোধাভরে কীচকের বক্ষঃস্থলে এমন চপেটাঘাত করিলেন যে, সে তৎক্ষণাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। ক্রোধানলে তাহার অন্তর্দ্দগ্ধ হইতে লাগিল, কিন্তু উঠিবার সামর্থ্য হইল না। ভীমসেন দুরাত্মা কীচককে দুঃসহ চপেটাঘাতে নিতান্ত হীনবল ও বিচেতনপ্রায় দেখিয়া তাহাকে নিকটে আনয়নপূর্ব্বক দৃঢ়তর মর্দ্দন করিতে লাগিলেন এবং পুনরায় নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক তাহার কেশাকর্ষণ করিয়া পিশতাকাঙ্ক্ষী [মাংসলোলপু] শার্দ্দুল যেমন মৃগ গ্রহণপূর্ব্বক চীৎকার করে, তদ্রূপ ভীষণ ধ্বনি করিতে লাগিলেন।

ভীমকর্ত্তৃক কীচকের প্রাণসংহার

অনন্তর বৃকোদর কীচককে নিতান্ত শ্রান্ত দেখিয়া তাহাকে ঘূর্ণিত করিতে লাগিলেন। দুরাত্মা কীচক সাতিশয় ব্যথিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার ও ঘন ঘন নিশ্বাসত্যাগ করিতে লাগিল এবং বিসংজ্ঞ হইয়া পড়িল। তখন ভীমসেন দ্রৌপদীর ক্রোধানল নির্ব্বাণ করিবার নিমিত্ত সত্বর বাহুদ্বারা তাহার কণ্ঠ গ্রহণপূর্ব্বক দৃঢ়তর নিপীড়ন করিতে লাগিলেন। এইরূপে ঐ দুরাত্মা ভগ্নসর্ব্বাঙ্গ ও বিদ্ধচক্ষু হইলে ভীম জানুদ্বারা তাহার কটিদেশ আক্রমণপূর্ব্বক বাহুদ্বারা তাহাকে নিপীড়িত করিয়া পশুর ন্যায় সংহার করিলেন।

কীচক পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলে ভীমসেন তাহার মৃতদেহ ভূতলে সংঘটনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সৈরিন্ধ্রী! অদ্য আমি ভাৰ্য্যাপহারী দুরাত্মা কীচকের প্রাণসংহার করিয়া ভ্রাতার নিকট অঋণী হইলাম; অদ্য আমার পরম শান্তিলাভ হইল।” রোষারুণনেত্ৰ ভীমসেন এই কথা বলিয়া স্বলিত-বস্ত্রাভরণ উদভ্ৰান্তনেত্র ও গতজীবিত কীচককে পরিত্যাগ করিলেন। তখনও তাঁহার ক্রোধের শান্তি হয় নাই। তিনি পুনরায় হস্তে হস্ত নিষ্পেষণ ও ওষ্ঠ দর্শনপূর্ব্বক তাহার হস্ত, পদ, গ্ৰীবা ও মস্তক শরীরমধ্যে প্রবেশিত করিলেন। পরে দ্রৌপদীকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “পাঞ্চালি! দেখ, সেই কামুকের কিরূপ দুর্দ্দশা হইয়াছে।” এই কথা বলিয়া সেই মথিতসর্ব্বাঙ্গ মাংসপিণ্ডাকার কীচকের মৃতদেহে এক পদাঘাত করিলেন এবং অগ্নি প্ৰজ্বালনপূর্ব্বক ঐ মৃত কলেবর দ্ৰৌপদীকে দর্শন করাইয়া কহিলেন, “হে ভীরু! যাহারা তোমাকে কামনা করিবে, তাহারা কীচকের ন্যায় পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইবে, সন্দেহ নাই।” মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন এইরূপে দ্রৌপদীর হিতসাধনাৰ্থে কীচকবিনাশরূপ অতিদুষ্কর কর্ম্মসম্পাদনানন্তর শান্তচিত্তে প্ৰণয়িনীর নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক সত্বর মহানসে আগমন করিলেন।

দ্ৰৌপদী এই প্রকারে কীচককে নিহত করাইয়া বিগতসন্তাপ ও পরম পরিতুষ্ট হইয়া সভাপালদিগকে কহিলেন, “হে সভাসদগণ! আপনারা আগমন করিয়া দেখুন, পরস্ত্রী-কাম-কামবিমোহিত দুরাত্মা কীচক আমার পতিগণকর্ত্তৃক নিহত হইয়া ভূতলে শয়ান রহিয়াছে।”

তখন নৃত্যশালারক্ষকগণ তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া সহস্ৰ সহস্র উল্কাগ্রহণপূর্ব্বক সহসা তথায় আগমন করিল এবং সেই গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশপূর্ব্বক হস্তপদবিহীন, রক্তাক্তকলেবর, গতাসু কীচককে নয়নগোচর করিয়া সাতিশয় ব্যথিত ও বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিল, “কি আশ্চৰ্য্য ব্যাপার! ইহার গ্ৰীবা কোথায়, হস্ত, পদ ও মস্তকই বা কোথায় গেল?” তাহারা এই কথা বলিয়া কীচকের মৃতদেহ পরীক্ষা করিতে লাগিল।