০২৭. বনবাসন্দশায় দ্রৌপদীর দুঃখ

২৭তম অধ্যায়

বনবাসন্দশায় দ্রৌপদীর দুঃখ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, শোকাভিভূত বনবাসী পাণ্ডবগণ সায়ংসময়ে কৃষ্ণার সহিত উপবিষ্ট হইয়া পরস্পর কথোপকথন করিতে লাগিলেন। অনন্তর মনোরমা বিদ্যাবতী পতিব্ৰতা পাঞ্চালী যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে নাথ! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন কি নৃশংস! আমাদিগকে রাজ্যভ্ৰষ্ট্র, অজিনধারী ও বনচারী করিয়াও কিছুমাত্র দুঃখিত বা অনুতাপিত হয় নাই। আপনি ধর্ম্মপরায়ণ জ্যেষ্ঠভ্রাতা; তথাপি সে দুর্ম্মতি যখন আপনার প্রতি অতি কঠোরবাক্য প্রয়োগ করিল, তখন তাহার হৃদয় লৌহনির্ম্মিত সন্দেহ নাই। হা নাথ! আপনি কখন দুঃখের মুখাবলোকন করেন নাই, কিন্তু এক্ষণে সেই পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন সুহৃদগণের সহিত একত্র আসীন হইয়া আপনাকে দুর্ভেদ্য দুঃখ-শৃঙ্খলে বদ্ধ করিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইয়াছে। আপনি যখন বনগমনের নিমিত্ত মৃগচর্ম্ম পরিধান করিয়া নিৰ্গত হইলেন, তখন কেবল দুৰ্য্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসন এই চারিজন কঠোরহৃদয় পাপাত্মার অশ্রুপাত হয় নাই; কিন্তু আর সমুদয় কৌরবেরই নয়ন হইতে অবিরলধারে শোকসলিল বিগলিত হইয়াছিল। হে মহাভাগ! আপনার এই নূতন শয্যা ও কুশময় আসন অবলোকন করিয়া সেই পুরাতন শয্যা ও নানাবিধ রত্নমণ্ডিত সিংহাসন আমার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইতেছে। আমি আর শোকাবেগ সংবরণ করিতে পারি না। হা নাথ! পূর্ব্বে আপনাকে সভামধ্যে রাজমণ্ডলীতে পরিবৃত দেখিতাম, এক্ষণে আমি আপনার ঈদৃশ অবস্থা অবলোকন করিয়া কিরূপে শান্তিলাভ করিতে পারি? পূর্ব্বে আপনাকে চন্দনচর্চিত, সূর্ঘ্যের ন্যায় তেজস্বী ও শুভ্ৰ কৌষেয়বসনে সুসজ্জিত দেখিয়াছিলাম, এক্ষণে ধূলি-ধূসরকলেবর ও চীরধারী দেখিতে হইল। হে রাজেন্দ্ৰ! পূর্ব্বে আপনার গৃহে সহস্ৰ সহস্ৰ ব্ৰাহ্মণ, যতি, ব্ৰহ্মচারী ও গৃহস্থেরা সুবৰ্ণপাত্রে অভিলাষানুরূপ সুস্বাদু দোষহীন অন্নব্যঞ্জনাদি ভোজন করিতেন এবং যথাযোগ্য সহস্ৰ প্ৰকার সৎকার প্রাপ্ত হইতেন, এক্ষণে সে সকল লুপ্তপ্রায় হইয়াছে দেখিয়া কি আমার অন্তঃকরণে শান্তির উদয় হইতে পারে? কুণ্ডলধারী যুবা সূপকারসকল আপনার যে ভ্রাতৃগণকে সমীচীন রূপে প্ৰস্তুত নানাবিধ অন্নভোজন করাইত, সেই দুঃখানভিজ্ঞ চিরসুখী ভ্রাতৃগণ এক্ষণে বন্যফলমূলাদি দ্বারা জীবনধারণ করিতেছেন, ইহা দেখিয়া আমার শোকসাগর একেবারে উচ্ছলিত হইয়া উঠিল। যে ভীমসেন বিবিধ যান ও উচ্চাবচ বসনদ্বারা সৎকার প্রাপ্ত হইতেন ও যিনি সমরে সমস্ত কুরুকুলকে উন্মলিত করিতে পারেন, তিনি এক্ষণে বনবাসী হইয়া স্বয়ং দাসোচিত কর্ম্মসকল নির্ব্বাহ করিতেছেন, ইহা দৰ্শন করিয়াও কেন আপনার রোষানল প্রজ্বলিত হইতেছে না? তিনি কেবল আপনার প্রতিজ্ঞা-পাশে বদ্ধ হইয়া ঈদৃশ অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করিতেছেন। যে অর্জ্জুন দ্বিবাহু হইয়াও বহুবাহু অর্জ্জুনের [কার্ত্তবীৰ্য্যার্জ্জুন] সমকক্ষ; যিনি শরসন্ধানে লঘুহস্ততা-প্ৰযুক্ত সমরে কালান্তক-যমোপম; যাহার শস্ত্ৰপ্ৰতাপে সমস্ত পার্থিব অবনত হইয়া আপনার যজ্ঞে ব্ৰাহ্মণগণের উপাসনা করিয়াছিল; যিনি এক রথে দেবতা, মনুষ্য ও সৰ্পগণকে পরাজয় করিয়া দেবদানবকর্ত্তৃক পূজিত হইয়াছেন; যিনি অদ্ভুতাকার রথ, তুরঙ্গ ও মাতঙ্গে পরিবৃত হইয়া সমরে বিচরণ করিতেন; যিনি ভূপতিগণের নিকট হইতে বলপূর্ব্বক ধনগ্রহণ করিয়াছিলেন; যিনি এককালে পঞ্চশত শর নিক্ষেপ করিতে পারেন; হা নাথ! তিনি তপস্বিবেশে বনবাসী হইয়াছেন দেখিয়াও কেন আপনার ক্ৰোধপাবক প্ৰদীপ্ত হইতেছে না? শ্যামকলেবর তরুণবয়স্ক নকুল ও প্রিয়দর্শন শৌর্য্যশালী সহদেব এই সুকুমার মাদ্রীকুমারদ্বয় চিরসুখী হইয়াও বনবাসক্লেশে অতিমাত্র ক্লিষ্ট হইতেছেন, ইহা দেখিয়া কি নিমিত্ত ক্ষমাবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন, বালিতে পারি না। আমি দ্রুপদরাজদুহিতা, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, বীরপত্নী ও ব্ৰতশালিনী হইয়া বনচারিণী হইলাম; ইহা অপেক্ষা অধিক দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? হে পাণ্ডবনাথ! যখন আমাকে ও ভ্রাতৃগণকে এরূপ দুরবস্থাগ্রস্ত দেখিয়াও আপনার মন ব্যথিত হইতেছে না, তখন বুঝিলাম, আপনি নিতান্ত ক্ৰোধ-শুন্য, তাহাতে সন্দেহ নাই। লোকে প্রসিদ্ধই আছে, ক্রোধশুন্য ক্ষত্ৰিয় নাই, কিন্তু আপনাতে তাহার বৈপরীত্য দেখিতেছি। যে ক্ষত্রিয় সমুচিতসময়ে তেজঃপ্রদর্শন না করে, সে সমুদয় লোকের নিকট পরাভব প্রাপ্ত হয়; অতএব শক্রগণের প্রতি ক্ষমা করা কোনক্রমেই কর্ত্তব্য নহে, এক্ষণে তেজঃপ্রকাশ করিয়া তাহাদিগকে সমূলে নিৰ্মূল করাই উচিত কর্ম্ম, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু সময়বিশেষে ক্ষমাও অবলম্বন করিতে হইবে, কেন না, যে ক্ষত্ৰিয় ক্ষমাকালে ক্ষমাবলম্বন না করেন, তিনি সর্ব্বভূতের অপ্রিয় হইয়া ইহকালে ও পরকালে বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়েন।’