০৩৩. স্বমতপোষকবাক্যশ্রবণে ভীমের উত্তেজনা

৩৩তম অধ্যায়

স্বমতপোষকবাক্যশ্রবণে ভীমের উত্তেজনা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, ক্রোধনস্বভাব ভীমসেন যাজ্ঞসেনীর বাক্যশ্রবণে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন! ধর্ম্মনিপেত সৎপুরুষোচিত রাজ্যলাভপদবী অবলম্বন করুন। দেখুন, ধর্ম্মার্থক্যামবিহীন হইয়া আমাদের তপোবনে বাস করিবার আবশ্যকতা কি? দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ধর্ম্ম, আর্জ্জব বা তেজঃপ্রভাবে আমাদের রাজ্যগ্ৰহণ করে নাই; কেবল কপট দ্যূতক্ৰীড়া করিয়া উহা অপহরণ করিয়াছে। গোমায়ু যেমন সিংহের আমিষ গ্রহণ করে ও দুর্ব্বল কুকুর যেমন বলবানদিগের আমিষ অপহরণ করে, তদ্রূপ আমাদের রাজ্য সেই দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক অপহৃত হইয়াছে। হে মহারাজ! আপনি কি নিমিত্ত অল্পমাত্র ধর্ম্মরক্ষানুরোধে ধর্ম্মকামের উৎপাদক রাজ্যরূপ অর্থ পরিত্যাগ করিয়া দারুণ দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইতেছেন? গাণ্ডীবধন্বা অর্জ্জুন আমাদের রাজ্য রক্ষা করিত, ইন্দ্রও বলপূর্ব্বক উহা অপহরণ করিতে পারেন নাই; কেবল অনাবধানতাপ্রযুক্তই উহা আমাদিগের সমক্ষে বিপক্ষকর্ত্তৃক অপহৃত হইয়াছে। যেমন কুণি [বিকলহস্ত—যাহার হস্তের ক্রিয়া অচল] ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে বিল্ব ও পঙ্গুদিগের নিকট হইতে ধেনুসকল অপহৃত হয়, তদ্রূপ আপনার নিমিত্তই আমাদের রাজ্য অপহৃত হইয়াছে। হে মহারাজ! আপনি ধর্ম্মাভিলাষী, আপনার প্রিয়সাধনের নিমিত্তই আমরা ঈদৃশ ব্যসনাপন্ন হইয়াছি। আমরা আপনার সমপথানুগত বচনানুসারে আত্মসংযম করিয়া কেবল মিত্ৰগণের দুঃখ ও শত্রুদিগের আনন্দবৃদ্ধি করিতেছি। হে রাজন! আমরা আপনার সমপথাবলম্বী বচনানুসারে তৎকালে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণকে বিনাশ করি নাই, সেই মর্ম্মচ্ছেদী কর্ম্ম স্মরণ করিয়া যৎপরোনাস্তি অনুতাপিত হইতেছি। হে মহারাজ! এক্ষণে এই দুর্ব্বলজনাচরিত বলবানদিগের নিতান্ত অপ্রিয় মৃগচৰ্য্যারূপ বনবাসে অশেষ ক্লেশ অনুভব করুন। কি কৃষ্ণ, কি অর্জ্জুন, কি অভিমন্যু, কি সৃঞ্জয়গণ, কি আমি, কি মাদ্রীসূতদ্বয়, কেহই আপনার এই অবস্থার অভিনন্দন করিবে না। আপনি কি ধর্ম্মরক্ষানুরোধে সতত ব্ৰত্যকর্শিত হইয়া বৈরাগ্যপন্থাবলম্বনপূর্ব্বক নিতান্ত পৌরুষশূন্য মনুষ্যের ন্যায় কালব্যাপন করিবেন! হে পাণ্ডবরাজ! যেসকল কাপুরুষ আপনাদিগের বংশলক্ষ্মীর প্রত্যুদ্ধরণে অসমৰ্থ, তাহারাই নিতান্ত নিষ্ফল ও স্বার্থবাতক বৈরাগ্যকে প্রিয় জ্ঞান করে; কিন্তু আপনি জ্ঞানবান, কাৰ্য্যসাধনে সমর্থ ও আমাদিগের পুরুষাকারাভিজ্ঞ হইয়াও কেবল অনৃশংসতানুরোধে এই অনার্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছেন না। দেখুন, আমরা বৈরানিৰ্য্যাতনে সমর্থ হইয়াও ক্ষমাপথ অবলম্বন করাতে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ আমাদিগকে নিতান্ত অশক্ত জ্ঞান করিতেছে, ইহা অপেক্ষা আমাদিগের সংগ্রামে প্ৰাণত্যাগ করাও দুঃখাবহ নহে। যদি ধর্ম্মযুদ্ধে আমরা সকলেই নিহত হই, তাহাও শ্ৰেয়ঃ, কারণ, তাহা হইলে পরকালে সম্পত্তিলাভ হইবে, কিংবা যদি আমরা ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে সংগ্রামে নিহত করিয়া সমস্ত পৃথিবী ভোগ করিতে পারি, তাহাও আমাদের পক্ষে শ্রেয়স্কর। স্বধর্ম্মানুষ্ঠান, বিপুল কীর্ত্তিলাভ ও বৈরানিৰ্য্যাতনের নিমিত্ত আমাদের সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়া সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। আমরা কর্ত্তব্যবিষয় বিবেচনা করিয়া আপনাদিগের নিমিত্ত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে যদি শত্ৰুগণ আমাদিগকে পরাজয় করিয়া রাজ্যলাভ করে, তাহাও আমাদের প্রশংসার বিষয়; উহাতে কিছুমাত্র নিন্দা নাই। যে ধর্ম্মদ্বারা মিত্ৰগণের বা আপনার কষ্ট হয়, তাহাকে ব্যাসন কহে। উহাই কুধর্ম্ম, কখনই ধর্ম্ম নহে। যেমন সুখ ও দুঃখ মৃতব্যক্তিকে ত্যাগ করে, তদ্রূপ ধর্ম্ম ও অর্থ সতত ধর্ম্মচিন্তানিরত পুরুষকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি কেবল ধর্ম্মের নিমিত্তই ধর্ম্মোপার্জ্জন করে, সে অশেষ ক্লেশভোগী হয়; যেমন অন্ধ ব্যক্তি সূৰ্য্যের প্রভা জানিতে পারে না, তদ্রূপ সেই অপণ্ডিত ব্যক্তি ধর্ম্মোপার্জ্জনের প্রয়োজন বুঝিতে অসমর্থ হয়। যে ব্যক্তির অর্থ কেবল আত্মভোগেই পৰ্য্যবসিত হয়, সে অর্থোপার্জ্জনের আবশ্যকতা জানিতে পারে না। যেমন রক্ষকগণ অরণ্যে গোরক্ষণ করে, তদ্রূপ ঐ পামর কেবল অর্থরক্ষা করিয়াই জীবনযাপন করে। যে ব্যক্তি ধর্ম্ম ও কাম পরিত্যাগ করিয়া কেবল অর্থোপার্জ্জনে নিরন্তর রত থাকে, সেই দুরাত্মা ব্ৰহ্মহার ন্যায় সর্ব্বভূতের বধ্য। আর যে ব্যক্তি ধর্ম্ম ও অর্থ পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল কামার্থী হইয়া কালব্যাপন করে, তাহার মিত্ৰনাশ ও সে ধর্ম্মার্থবিহীন হইয়া থাকে।

“যেমন মৎস্যকুল বারি শুষ্ক হইলে কালগ্রাসে পতিত হয়, তদ্রূপ সেই ধর্ম্মার্থবিহীন দুরাত্মা স্বেচ্ছানুসারে বিহার করিয়া পরিশেষে কামাবসানে নিধন প্ৰাপ্ত হয়। এই নিমিত্ত পণ্ডিতগণ ধর্ম্মার্থসংগ্রহে। কখনই প্ৰমত্ত হয়েন না। যেমন অরণি পাবকোৎপাদনের হেতু, তদ্রূপ ধর্ম্ম ও অর্থ কামের প্রসূতি। ধর্ম্ম অর্থের মূল, অর্থও ধর্ম্মোৎপাদনের হেতু; যেমন মেঘ ও সমুদ্র পরস্পর পুষ্টিসাধন করিয়া থাকে, তদ্রূপ ধর্ম্ম ও অর্থ পরস্পর পোষকতা করে। স্রক্‌চন্দনাদি-রূপ দ্রব্যস্পর্শ বা স্বর্ণাদিরূপ অর্থলাভ হইলে মনুষ্যের যে প্রীতি জন্মে, তাহারই নাম কাম। কাম মনুষ্যের চিত্তে সমুদিত হয়, উহার শরীর নাই। বিপুল ধর্ম্মোপার্জ্জন দ্বারা অর্থার্থী ব্যক্তির অর্থলাভ হয়; অর্থ হইতে কামার্থীর কমলাভ হয়, কিন্তু কাম হইতে অন্য কোন ফললাভের সম্ভাবনা নাই। যেমন কাষ্ঠসমুৎপন্ন ভস্ম হইতে ভস্মান্তরলাভের সম্ভাবনা থাকে না, তদ্রূপ কাম হইতে কামান্তরলাভ হয় না; কামই প্রীতিসমুৎপাদক ফল। যেমন বৈতংসিক [ব্যাধ—জালদ্বারা পক্ষী প্রভৃতির সংগ্ৰহকারী] বিহঙ্গমগণের প্রাণসংহার করে, তদ্রূপ অধর্ম্ম সর্ব্বভূতের হিংসা করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি কাম ও লোভের পরতন্ত্র হইয়া ধর্ম্মের স্বরূপ পরিজ্ঞানে পরাঙ্মুখ হয়, সেই দুরাত্মা ইহকালে ও পরকালে সর্ব্বভূতের বধ্য হয়।

“হে রাজন! স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে—শ্ৰী, ধন, গো, হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি দ্রব্যজাত হইতেই কাম সমুৎপন্ন হয়, আপনি ইহা সবিশেষ অবগত আছেন, এবং দ্রব্যের প্রকৃতি ও ভূয়সী বিকৃতিও উত্তমরূপে জানেন। জরা বা মরণদ্বারা ঐ সমুদয় দ্রব্যের অদর্শন বা বিয়োগকে অনর্থ বলা যায়; সেই মহান অনর্থ এক্ষণে আমাদিগের সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব অনৰ্থ নিবারণ করা সর্ব্বতোভাবে বিধেয়।

“হে মহারাজ! পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়, মন ও হৃদয় স্ব স্ব বিষয়ে বর্ত্তমান থাকিয়া যে প্রীতি উপভোগ করে, তাহারই নাম কাম; উহাই ধর্ম্মের এক উৎকৃষ্ট ফল। মনুষ্য এইরূপে ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনের উপর পৃথক পৃথক রূপে দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কেবল ধর্ম্মপর বা কেবল কামপর হইবে না; সতত সমভাবে এই ত্রিবর্গের অনুশীলন করিবে। শাস্ত্ৰে কথিত আছে যে, পূর্ব্বাহ্নে ধর্ম্মানুষ্ঠান, মধ্যাহ্নে অর্থচিন্তা ও অপরাহ্নে কামানুশীলন করিবে। অতএব হে রাজন! উক্তরূপে কালবিভাগ করিয়া যথাসময়ে ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম ত্ৰিবৰ্গেরই সেবা করা পণ্ডিতগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি মহোদয়জনিত সুখ-সম্ভোগ করিয়া মোক্ষোপায়জ্ঞান অবলম্বনপূর্ব্বক সুখাভিলাষী হয়, তাহার পক্ষে মোক্ষই শ্ৰেয়ঃ। আপনি মোক্ষোপার্জ্জন বা মহোদয়লাভের জন্য সাতিশয় যত্ন করেন। কিন্তু সেই শ্রেয়স্কর মোক্ষ গৃহস্থাশ্রমবাসীর পক্ষে আতুর ব্যক্তির জীবনের ন্যায় নিরন্তর দুঃখদায়ক হইয়া উঠে। আপনি ধর্ম্মের মর্ম্ম অবগত আছেন এবং সতত ধর্ম্মানুষ্ঠানও করিয়া থাকেন, ইহা জানিয়া আপনার সুহৃদগণ আপনাকে কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্তিপ্রদান করিতেছেন। দান, যজ্ঞ, সাধুগণের পূজা, বেদাধ্যয়ন ও আর্জ্জব—এই কয়েকটি প্রধান ধর্ম্ম; ইহাই ইহকালে ও পরকালে বলবান থাকে। কিন্তু অর্থবিহীন ব্যক্তি অন্যান্য সমুদয় গুণে গুণবান হইলেও ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতে পারে না। ধর্ম্মই এই জগতের মূল; ধর্ম্মাপেক্ষা কিছুই উৎকৃষ্ট নহে। বিপুল অর্থ থাকিলেই ধর্ম্মানুষ্ঠান করিতে পারা যায়; কিন্তু সেই অর্থভৈক্ষচৰ্য্যা বা কাতরতা অবলম্বনদ্বারা লাভ করিতে পারা যায় না; উহা কেবল ধর্ম্মাচরণ করিলেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। হে পুরুষপ্রধান! যজ্ঞদ্বারা অর্থসংগ্ৰহ করা আপনার পক্ষে প্রতিষিদ্ধ; ভিক্ষাবৃত্তি কেবল ব্ৰাহ্মণেরই নিৰ্দ্ধারিত আছে; অতএব আপনি তেজোদ্বারা অর্থলাভ করিতে চেষ্টা করুন। ক্ষত্ৰিয়ের ভৈক্ষচৰ্য্যা বা বৈশ্য ও শূদ্রের ন্যায় কোন প্রকার জীবিকা নিৰ্দ্ধারিত নাই; কেবল স্বকীয় বলই তাহাদিগের প্রধান ধর্ম্ম। অতএব হে মহারাজ! আপনি স্বধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক সমাগত শত্ৰুগণকে সংহার করিয়া আমার ও অর্জ্জুনের সহায়তায় ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের সৈন্যসকল নাশ করুন।

“বিদ্বানেরা প্ৰভুত্বকেই ধর্ম্ম কহেন; অতএব আপনি প্রভুত্বলাভে যত্ন করুন; অনীশ্বর হইয়া থাকা উচিত নহে। হে রাজেন্দ্ৰ! যে হিংসা দ্বারা লোকসকল ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়, আপনি সেই হিংসাপ্রধান ক্ষত্ৰিয়কুলে সমুৎপন্ন হইয়াছেন। অতএব সাবধান হইয়া কুলোচিত সনাতনধর্ম্ম প্রতিপালন করুন। প্ৰজাপালন দ্বারা নানাবিধ ফললাভ করা আপনার পক্ষে নিন্দনীয় নহে; কারণ, উহা ক্ষত্ৰিয়ের কুলক্ৰমাগত নিত্যধর্ম্ম। যদি আপনি প্ৰজাপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন, তাহা হইলে জনসমাজে হাস্যাস্পদ হইবেন, যেহেতু, মনুষ্য স্বধর্ম্ম হইতে বিচলিত হইলে কখনই প্ৰশংসাভাজন হইতে পারে না; তিন্নিমিত্ত আপনি মনের শৈথিল্য পরিত্যাগ করিয়া ক্ষাত্রতেজ অবলম্বনপূর্ব্বক ধুরন্ধরের ন্যায় ভূভার বহন করুন। কোন রাজা কোনকালেই কেবল ধর্ম্মাবলম্বনপূর্ব্বক পৃথিবী বা অসীম ঐশ্বৰ্য্যলাভ করিতে পারেন নাই। যেমন ব্যাধ ভক্ষ্যরূপ-প্রলোভন প্রদর্শনপূর্ব্বক মৃগগণের প্রাণসংহার করিয়া আপনার আহার লাভ করে, তদ্রূপ বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রুপক্ষীয় লুব্ধচেতাঃ ক্ষুদ্রাশয় জনগণকে উৎকোচ প্ৰদানপূর্ব্বক ভেদোৎপাদন করিয়া অনায়াসেই রাজ্যপ্রাপ্ত হয়েন। অসুরগণ দেবতাদিগের অগ্রজ ভ্রাতা ও সমৃদ্ধিসম্পন্ন ; তথাপি দেবগণ কৌশল করিয়া অনায়াসে তাহাদিগকে পরাজয় করিয়াছিলেন। হে মহাবাহো! এইরূপে বলবান ব্যক্তির নিকটে সকলই সুসাধ্য, ইহা বিবেচনা করিয়া আপনি কৌশলে শক্রগণের প্রাণসংহার করুন। এই ভূমণ্ডলে অর্জ্জুনের সমান ধনুৰ্দ্ধর ও আমার তুল্য গদাযুদ্ধবিশারদ কেহই নাই। বলবান ব্যক্তি পুরুষসঙ্ঘ বা শত্রুপক্ষীয়দের কোন প্রকার অনুসন্ধানদ্বারা যুদ্ধ করে না, কেবল বলপূর্ব্বকই সংগ্রাম করিয়া থাকে; অতএব হে মহারাজ! আপনি বল প্রকাশ করুন। বলই অর্থের মূল; বল ভিন্ন আর সমুদয়ই হেমন্তকালীন বৃক্ষচ্ছায়ার ন্যায় কোন প্রকার উপকারজনক হয় না। যেমন কৃষক অধিক শস্যলাভাকাঙক্ষায় অল্প বীজ বপন করে, তদ্রূপ অর্থাভিলাষী ব্যক্তির সমধিক অর্থলাভের নিমিত্ত অল্প অর্থ পরিত্যাগ করাও কর্ত্তব্য। কিন্তু যেখানে অৰ্থত্যাগ করিলে তাহার সমান বা তদপেক্ষা অধিকতর লাভের সম্ভাবনা নাই, সে স্থানে প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক অর্থ পরিত্যাগ করা বিধেয় নহে; যেহেতু, উহা কেবল খরকণ্ডুয়নের [অত্যন্ত চুলকনা] ন্যায় পরিণামে দুঃখজনক হইয়া উঠে।

“হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! এই প্রকার যদি অল্পধর্ম্ম পরিত্যাগ করিলে অধিকতর ধর্ম্মলাভ হয়, তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য। পণ্ডিত ব্যক্তিরা মিত্রবলসম্পন্ন অমিত্রের মিত্র-ভেদ করিয়া থাকেন, কারণ, মিত্ৰগণ ভিন্ন হইয়া পরিত্যাগ করিলে যুবা ব্যক্তিও অবশ হয়। হে রাজন! বলবান ব্যক্তি বলপূর্ব্বক যুদ্ধ করিয়াই প্ৰজাগণকে বশীভূত করে; সে কখন উহাদিগকে নিগ্ৰহ বা প্রিয়সম্ভাষণদ্বারা বশীভূত করে না। যেমন বহুসংখ্যক মধুমক্ষিকা একত্ৰ হইয়া মধুগ্রাহীর প্রাণসংহার করে, তদ্রূপ অনেক দুর্ব্বল ব্যক্তি সমবেত হইলে বলবান শক্রকে শমনসদনে গমন করিতে হয়। যেমন সূৰ্য্য স্বীয় কিরণদ্বারা পৃথিবীর রস শোষণ করিয়া প্ৰজাগণকে পালন করেন, তদ্রূপ আপনি যুদ্ধে শত্রুগণকে বশীভূত করিয়া প্রতিপালন করুন। হে মহারাজ! আমরা শ্রবণ করিয়াছি যে, আমাদের পূর্ব্বপুরুষের ন্যায় যথানিয়মে প্রজাপালন করিলে অনাদি স্বকীয় ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করা হয়। ক্ষত্ৰিয়েরা যুদ্ধে শত্ৰুগণকে পরাজয় করিয়া বা তাহাদের নিকট পরাভূত হইয়া যেমন সদগতিলাভ করে, তপানুষ্ঠানদ্বারা কদাচি তাদৃশ গতি প্রাপ্ত হইতে পারে না। লোক আপনার এই দুর্দ্দশা দেখিয়া নিশ্চয় করিয়াছে যে, সূৰ্য্য হইতে প্রভা ও চন্দ্ৰমা হইতে শোভা অপগত হইলে, আর থাকে না। হে মহারাজ! এক্ষণে যাবতীয় সভামধ্যে কেবল আপনার প্রশংসা ও বিপক্ষগণের নিন্দারই আলোচনা হইতেছে। আপনি মোহ, কার্পণ্য, লোভ, ভয়, কাম বা অর্থের জন্য কদাচ মিথ্যাকথা প্রয়োগ করেন নাই; এই নিমিত্তই সমস্ত ব্ৰাহ্মণ ও কুরুগণ একত্ৰ হইয়া হৃষ্টচিত্তে সতত আপনারই সত্যপরায়ণতার আন্দোলন করিয়া থাকেন। রাজ্যলাভ করিবার নিমিত্ত রাজার যে অণুমাত্র পাপ সমুৎপন্ন হয়, তিনি পশ্চাৎ বিপুলদক্ষিণ যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা তাহার অপনোদন করেন। লোকে ব্ৰাহ্মণগণকে বহুসংখ্যক গ্রাম ও সহস্ৰ সহস্ৰ গো দান করিয়া রাহুবিনির্ম্মুক্ত চন্দ্ৰমার ন্যায় পাপসমূহ হইতে মুক্ত হইয়া থাকে। হে কুরুনন্দন! সমস্ত পৌর এবং জনপদবাসী লোকেরা বৃদ্ধ ও বালকগণ-সমভিব্যাহারে আপনারই প্রশংসা করিতেছেন। কুক্কুরমুখে ক্ষীর, শূদ্ৰমুখে বেদ, চৌরে সত্য ও নারীতে বলসংযুক্ত হইলে যেরূপ ঘৃণাকর ও দুঃখদায়ক হয়, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনে রাজ্যভার অর্পিত হইয়া তদ্রূপ হইয়াছে। হে মহারাজ! আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই সতত এই কথার আন্দোলন করিতেছে। হায়! আপনি আপন বুদ্ধিতে রাজ্যভ্রষ্ট হইয়া আমাদের সহিত এই দুরবস্থাগ্রস্ত হওয়াতে আমরা সকলেই এককালে বিনষ্ট হইলাম। হে মহারাজ! এক্ষণে আপনি দ্বিজশ্রেষ্ঠদিগের আশীর্ব্বাদ গ্রহণপূর্ব্বক তাহাদিগকে ধনপ্রদান করিবার নিমিত্ত সত্বর সর্বোপকরণসম্পন্ন শীঘ্রগামী স্যন্দনে আরোহণ করুন ও অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ মহাধনুৰ্দ্ধর মহাবলপরাক্রম ভ্রাতৃবর্গে পরিবৃত হইয়া অদ্যই হস্তিনানগরে গমন করিতে প্ৰবৃত্ত হউন। যেমন দেবরাজ ইন্দ্র সুরগণ-সমভিব্যাহারে অসুরগণকে সংহার করিয়া স্বৰ্গরাজ্যগ্রহণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অরাতিকুল সমূলে নির্মূল করিয়া দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন হইতে রাজ্যগ্রহণ করুন। হে রাজন! এই ভূমণ্ডলে কোন ব্যক্তিই গাণ্ডীবনিমুক্ত আশীবিষসদৃশ বিচিত্ৰপুঙ্খ অর্জ্জুনের শরসমূহ সহ্য করিতে পারে না। আমি যুদ্ধে ক্রুদ্ধ হইয়া গদাঘূর্ণনা করিলে তাহার বেগ সহ্য করিতে পারে, এমন কোন বীর কি মাতঙ্গ বা অশ্ব এই জগতীতলে অদ্যাপি জন্মগ্রহণ করে নাই। হে মহারাজ! আমরা সৃঞ্জয়গণ, কেকয়বংশীয়গণ ও বৃষ্ণিবংশাবতংস কৃষ্ণের সহিত মিলিত হইয়া ও বহুসংখ্যক সৈন্যসামন্ত-সমভিব্যাহারে দৃঢ়তর যত্নসহকারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে কি নিমিত্ত শত্রুহস্তগত রাজ্যের প্রত্যুদ্ধরণে অক্ষম হইব?