২১. কীচকবধে দ্ৰৌপদীর ভীম- উদ্বোধন

২১তম অধ্যায়

কীচকবধে দ্ৰৌপদীর ভীম- উদ্বোধন

ভীমসেন কহিলেন, “প্রিয়ে! যখন তোমার লোহিততল পাণিপল্লব কিণাঙ্কিত হইয়াছে, তখন আমার বাহুবলে ও অর্জ্জুনের গাণ্ডীবে ধিক! কি বলিব, রাজা যুধিষ্ঠির সময় প্রতীক্ষা করিতেছেন, নতুবা বিরাটের সভামধ্যেই ঘোরতর সংগ্রামে অথবা আমি মহাগজের ন্যায় অবলীলাক্রমে গদাঘাতে ঐশ্বৰ্য্যমত্ত কীচকের মস্তক প্রোথিত করিতাম। যাজ্ঞসেনি! দুরাত্মা কীচক যখন তোমাকে পদাঘাত করিয়াছিল, তখনই আমি সমুদয় মৎস্যদেশ বিমন্দিত করিতে উৎসুক হইয়াছিলাম; কিন্তু তৎকালে রাজা যুধিষ্ঠির কটাক্ষ-ভঙ্গীতে নিবারিত করিলেন বলিয়াই আমি ক্ষান্ত হইয়া আছি। আমরা যে রাজ্য হইতে বিবাসিত হইয়াছি এবং অদ্যাপি কৰ্ণ, শকুনি, দুৰ্য্যোধন ও দুঃশাসন প্রভৃতি দুরাত্মা কুরুগণের মস্তকচ্ছেদন করি নাই, এই দুইটি হৃদিন্যস্ত শল্যের ন্যায় আমার কলেবর নিপীড়ন করিতেছে। অয়ি নিতস্বিনি! ক্ৰোধ পরিত্যাগ কর, ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিও না। রাজা যুধিষ্ঠির তোমার এই প্রকার তিরস্কারবাক্য- শ্রবণ করিলে নিশ্চয়ই প্ৰাণপরিত্যাগ করিবেন, তিনি প্ৰাণপরিত্যাগ করিলে ধনঞ্জয়, নকুল ও সহদেব গতজীবিত হইবেন। ইঁহারা লোকান্তরে প্রস্থান করিলে আমি কদাচ জীবনধারণ করিতে সমর্থ হইব না।

“পূর্ব্বকালে ভৃগুবংশীয় চ্যবন বনে বল্মীকভাব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; তথাপি তাঁহার পত্নী সুকন্যা তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। ভুবনবিখ্যাত রূপচন্দ্ৰসেনা সহস্রবর্ষবয়স্ক বৃদ্ধতম স্বামীর অনুচারিণী হইয়াছিলেন। জনকদুহিতা সীতা অরণ্যচারী রামের সমভিব্যাহারিণী হইয়া রাক্ষসহস্তে কত নিগ্ৰহ ভোগ করিয়াছিলেন; তথাপি পতির অনুগমনে নিরস্ত হয়েন নাই। রূপযৌবনসম্পন্না লোপামুদ্রা অলৌকিক ভোগসমুদয় পরিত্যাগপূর্ব্বক আগস্ত্যের সহচরী হইয়াছিলেন। মনস্বিনী সাবিত্রী যমলোক পৰ্য্যন্ত সত্যবানের অনুগমন করিয়াছিলেন। হে কল্যাণি! তুমিও এই সকল পতিব্ৰতাগণের ন্যায় সর্ব্বগুণসম্পন্না; অতএব আর অত্যল্লকাল অপেক্ষা কর, অৰ্দ্ধমাসমাত্র অবশিষ্ট আছে, ত্ৰয়োদশবর্ষ পরিপূর্ণ হইলেই তুমি রাজমহিষী হইবে।”

দ্রৌপদী কহিলেন, “নাথ! আমি রাজাকে তিরস্কার করিতেছি না, দুর্বিষহ দুঃখে নিতান্ত কাতর হইয়াছি বলিয়াই আমার নয়নযুগল হইতে অশ্রুধারা বিগলিত হইতেছে। এক্ষণে আর অতীত বিষয়ের আলোচনা করিয়া কি হইবে? কৰ্তব্য-বিষয়ে চেষ্টাবান হও। রাজা বিরাট পাছে আমার নিমিত্ত চলচ্চিত্ত হয়েন, পাছে আমার সৌন্দৰ্য্যদর্শনে সুদেষ্ণার সৌন্দৰ্য্য অনাদৃত হয়, এই আশঙ্কায় রাজমহিষী কিরূপে আমাকে স্থানান্তরিত করিবেন, প্রতিনিয়তই সেই চিন্তা করেন। দুরাত্মা কীচক রাজমহিষীর এই প্রকার অভিপ্ৰায় জানিয়া সতত আমাকে প্রার্থনা করে, আমি তাহাতে প্ৰথমে ক্রোধান্বিত হই, পুনরায় ক্রোধাবেগ সংবরণ করিয়া এই বলি, “কামান্ধ কীচক! আত্মরক্ষা কর, আমি পাঁচজন গন্ধর্ব্বের প্ৰিয়তমা মহিষী; তাঁহারা সকলেই শৌৰ্য্যশালী ও সাহসী, কুপিত হইলে অবশ্যই তোমার প্রাণসংহার করিবেন।” দুরাত্মা কীচক আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া এই উত্তর করে, সৈরিন্ধ্রী! আমি গন্ধৰ্ব্বগণকে ভয় করি না, শত লক্ষ গন্ধর্ব্ব সমাগত হইলেও তাহাদিগকে সমরশায়ী করিব।” আমি প্রত্যুত্তর করি, কীচক! তুমি যশস্বী গন্ধর্ব্বগণের সমকক্ষ নও, আমি ধর্ম্মপরায়ণা কুলকামিনী, কাহারও প্ৰাণসংহার করা আমার অভিপ্রেত নহে, এই নিমিত্তই অদ্যাপি জীবিত রহিয়াছ।” কীচক এই কথা শ্রবণ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করে।

“একদা সুদেষ্ণা ভ্রাতার প্রীতিকামনায় তাহার আদেশানুসারে সুরানয়নের নিমিত্ত আমাকে কীচকের আলয়ে প্রেরণ করিয়াছিল। আমি তদনুসারে কীচকের ভবনে গমন করিলে সেই দুরাত্মা প্রথমতঃ আমাকে সান্ত্বনা করিতে প্ৰস্তুত হইল। তৎপরে বলপ্রকাশ করিতে সমুৎসুক হইলে, আমি তাহার সঙ্কল্প অবগত হইয়া দ্রুতপদসঞ্চারে রাজার শরণাপন্ন হইলাম। কিন্তু দুরাত্মা সূতপুত্ৰ রাজার সমক্ষেই আমাকে ভূমিসাৎ করিয়া পদাঘাত করিল। বিরাট, কঙ্ক, রথী, পীঠমর্দ্দ [প্রিয় পার্ষদ], গজারোহী ও নাগরিক প্রভৃতি ভূরি ভূরি লোক তাহা দৰ্শন করিতে লাগিল। আমি তৎকালে বিরাট ও কঙ্ককে পুনঃ পুনঃ তিরস্কার করিলাম, তথাপি বিরাটরাজ তাহাকে নিবারণ বা শাসন করিলেন না।

“দুরাত্মা কীচক ধর্ম্মভ্রষ্ট, নৃশংস ও বীৰ্য্যাভিমানী। ঐ দুরাত্মা নিতান্ত ক্লিষ্ট রোরুদ্যমান জনগণের নিকটও ধন গ্ৰহণ করিয়া থাকে। আমি ঐ কামান্ধ দুর্বিনীত পাপাত্মাকে বারংবার প্রত্যাখ্যান করিয়াছি; এক্ষণে যদি সাক্ষাৎ হইলেই আমাকে আঘাত করে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমার প্রাণবিয়োগ হইবে। অতএব যদি তোমরা পূর্ব্বকৃত প্ৰতিজ্ঞার অনুরোধ রক্ষা কর, তাহা হইলে তোমাদিগের ভাৰ্য্যাকে রক্ষা করিতে পরিবে না; তন্নিবন্ধন তোমাদের মহান অধর্ম্ম হইবে। বিশেষতঃ ভাৰ্য্যাকে রক্ষা করিতে পারিলেই পুত্রকে রক্ষা করা হয় এবং পুত্র রক্ষিত হইলে আত্মাও রক্ষিত হয়, কারণ, আত্মাই ভাৰ্য্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে; এই নিমিত্ত পণ্ডিতগণ ভাৰ্যাকে জায়া বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন; আর ভাৰ্য্যা, ভতাঁ তাহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিবেন বলিয়া সতত সাবধানে তাহাকে রক্ষা করে। বর্ণধর্ম্মবৰ্ণনাকালে ব্রাহ্মণগণের নিকট শ্রবণ করিয়াছি যে, অরাতিগণের প্রাণসংহার ভিন্ন ক্ষত্ৰিয়গণের অন্য ধর্ম্ম নাই।

“দেখ, কীচক তোমার ও ধর্ম্মরাজের সমক্ষে আমাকে পদাঘাত করিল। পূর্ব্বে তুমিই আমাকে ভয়ঙ্কর জটাসুর হইতে পরিত্রাণ করিয়াছিলে এবং তুমিই ভ্রাতৃগণের সমভিব্যাহারে জয়দ্রথকে পরাজয় করিয়াছিলে, এক্ষণে আমার অবমন্তা [অপমানকারী] কীচককেও সংহার কর। ঐ দুরাত্মা রাজার আশ্রয় পাইয়া আমাকে শোকাকুল করিতেছে। ঐ পাপাত্মা আমার অনৰ্থপাতের হেতু। যদি ঐ দুরাত্মা সূৰ্য্যোদয় পৰ্য্যন্ত জীবিত থাকে, তাহা হইলে বিষপান করিয়া আমি প্রাণত্যাগ করিব। কীচকের বশীভূত হওয়া অপেক্ষা তোমার সমক্ষে প্ৰাণত্যাগ করা আমার পক্ষে শ্ৰেয়ঃ।” দ্রুপদ-নন্দিনী এই কথা কহিয়া ভীমসেনের বক্ষঃস্থলে শয়ন করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।

তখন ভীমসেন প্রিয়তমাকে আলিঙ্গন ও তাঁহার মুখমণ্ডলের অশ্রুমার্জন করিয়া আশ্বাসবাক্য তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন এবং কীচককে লক্ষ্য করিয়া কোপপ্রদর্শনপূর্ব্বক সৃক্কদ্বয় পরিলেহন করিয়া বলিতে লাগিলেন।