০০২. ব্যাসকর্ত্তৃক সমর-পরিণামপ্রকাশ

২য় অধ্যায়

ব্যাসকর্ত্তৃক সমর-পরিণামপ্রকাশ

হে রাজন! অনন্তর ত্রিকালজ্ঞ [অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়বিৎ] সত্যবতীসূত ভগবান ব্যাস উভয়পক্ষের সৈন্যগণকে নিরীক্ষণ করিয়া মনে করিলেন, ভরতপিতামহ ভীষ্ম এই ঘোর সংগ্রামে নিশ্চয়ই কলেবর পরিত্যাগ করিবেন। পরে শোকাকুল পুত্ৰগণের অনয়াদর্শী [অন্যাষাদর্শী—অন্যায় পক্ষপাতী] মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে নির্জ্জনে কহিলেন, “মহারাজ! তোমার পুত্র ও অন্যান্য পার্থিবগণের মৃত্যুকাল আসন্ন হইয়াছে; এক্ষণে তাহারা এই সংগ্রামে পরস্পর সমবেত হইয়া বিনষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। তুমি কালের বৈপরীত্য [কলিপ্ৰভাব-বিপরীত ভাব-উল্টা গতি] পৰ্য্যালোচনা কর [মনে মনে বুঝিয়া দেখ], পুত্ৰগণের বিনাশদর্শনে শোকাকুল হইও না। এক্ষণে তুমি যদি রণস্থলে উহাদিগকে অবলোকন করিবার অভিলাষী হও, তাহা হইলে আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্ৰদান করিতেছি; তুমি স্বচক্ষেই রণক্ষেত্ৰ প্রত্যক্ষ কর।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে তপোধন! আমি জ্ঞাতিবধ সন্দর্শন করিতে অভিলাষ করি না; আপনার তেজঃ-প্রভাবে আদ্যোপান্ত এই যুদ্ধ শ্রবণ করিব।” তখন বেদব্যাস সঞ্জয়কে বর প্রদান করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “মহারাজ! এই সঞ্জয় তোমার নিকট যুদ্ধবৃত্তান্ত অবিকল বর্ণনা করিবেন। ইনি কি দিবা কি রাত্রি সকল সময়েই, কি প্ৰকাশ কি অপ্রকাশ সকল বিষয়ই জানিতে পরিবেন। এবং অন্যে যাহা মনে মনে কল্পনা করিবে, তাহাও অবগত হইবেন। ইঁহার শরীরে শস্ত্র-স্পর্শ হইবে না এবং ইনি পরিশ্রমেও কদাচ শ্ৰান্ত বা ক্লান্ত হইবেন না। সঞ্জয় এই যুদ্ধ হইতে বিমুক্ত হইয়া জীবিত থাকিবেন। আমি কৌরব ও পাণ্ডবগণের কীর্ত্তিকলাপ সর্ব্বত্র বিখ্যাত করিয়া দিব। তুমি শোকাকুল হইও না, ইহাদিগের অদৃষ্টে এইরূপই নির্দ্দিষ্ট আছে; তুমি ইহা নিবারণ করিতে কখনই সমর্থ হইবে না; যে স্থানে ধর্ম্ম, সেই স্থানেই জয়।”

অশুভসূচক উৎপাত

হে মহারাজ! ভগবান বেদব্যাস এই বলিয়া পুনরায় রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “হে রাজন! এই যুদ্ধে ভয়ঙ্কর ক্ষয় সমুপস্থিত হইবে; দেখ, এক্ষণে ভয়প্রদ দুর্নিমিত্তসমুদয় উপলক্ষিত হইতেছে। শ্যেন [বাজ], গৃধ্র [শকুন], কাক, কঙ্ক [হাড়গিলে] ও বক-ইহারা সমবেত হইয়া বৃক্ষাগ্রে নিপতিত হইতেছে [কোথায় মৃত মানবদেহ পতিত হইবে, তাহা লক্ষ্য করিতেছে]; পক্ষিসকল হৃষ্টমনে সংগ্রামসন্নিহিতস্থান অবলোকন করিতেছে; ক্ৰব্যাদগণ [শবমাংসভোজী শৃগালকুকুর] গজবাজীর [হস্তী ও অশ্বের] মাংস ভক্ষণ করিবে, প্রচণ্ড কঙ্কসকল অতি কঠোর চীৎকার করিয়া দক্ষিণাভিমুখে ধাবমান হইতেছে; আমি প্রতিদিন পূর্ব্ব [প্ৰাতঃকালে] ও পশ্চিম সন্ধ্যা [সায়ং সময়ে] নিরীক্ষণ করিতেছি—সূৰ্য্যদেব উদয়াস্তকালে কবন্ধ[মস্তকহীন দেহ—ধড়মাত্র]পরিবৃত হইতেছেন এবং সন্ধ্যাকালে কৃষ্ণগ্ৰীব [১০], শ্বেতলোহিতপ্ৰান্ত [১১], বিদ্যুদ্দিমমণ্ডিত [১২] পরিধিমণ্ডলে বেষ্টিত [১০-১৩: মধ্যে কৃষ্ণ, উভয় প্ৰান্তভাগ শ্বেত ও রক্ত এইরূপ ত্ৰিবৰ্ণরঞ্জিত মেঘ এবং চমকিত বিদ্যুৎশ্রেণীদ্বারা বহির্ব্বেষ্টন মঙ্গল আবৃত] হইতেছেন; দিব্যরাত্ৰ চন্দ্ৰ, সূৰ্য্য ও নক্ষত্ৰসকল প্রজ্জ্বলিত হইতেছেন; দিবা ও রাত্রির কিছুমাত্র বিশেষ নাই। হে মহারাজ! এই সমস্ত তোমারই ভয়ের নিমিত্ত উপস্থিত হইতেছে। দেখ, কার্ত্তিকী পৌর্ণমাসীতে [১৪] পদ্মবৰ্ণাভ [১৫] নভোমণ্ডলে অলক্ষ্য [১৬] প্রভাহীন [১৭], অগ্নিবর্ণ [১৮] চন্দ্ৰমা সমুদিত হইয়াছে [১৪-১৯: আকাশমণ্ডলে কার্ত্তিক পূর্ণিমার শরৎ-শুভ্ৰ চন্দ্ৰ কমলাকান্তি রক্তবর্ণ অথচ প্রভাহীন ও অস্পষ্ট অবস্থায় দৃষ্ট হইতেছেন]; মহাবলপরাক্রান্ত পরিঘ [লম্বা মুষল]তুল্য ভুজযুগলসম্পন্ন রাজা ও রাজপুত্ৰগণ নিহত হইয়া ধরাতালে শয়ন করিবেন। প্রতিনিয়ত রজনীযোগে প্ৰজাক্ষয়ের নিমিত্ত অন্তরীক্ষে সংগ্রামনিরত বরাহ [শূকর— শুয়োর] ও মার্জ্জরের [বিড়ালের] তুমুল নিনাদ শ্রুতিগোচর হইয়া থাকে, দেবগণের প্রতিমূর্ত্তিসকল কখনো কম্পিত, কখনো স্বেদসিক্ত [ঘর্ম্মে আদ্র], কখনো বা ভূতলে নিপতিত হইতেছে; তাঁহারা কখনো হাস্য ও কখনো বা রুধির [রক্ত] বমন করিতেছেন; দুন্দুভি[নাগড়া]সকল আহত না হইয়াও বাদিত [আঘাত ব্যতীত আপনি আপনি বাজিয়া উঠিতেছে] এবং ক্ষত্ৰিয়দিগের রথসমুদয় অশ্বযোজিত না হইয়াও চালিত হইতেছে; কোকিল, শতপত্র [ময়ুরী], চাষ [সুবৰ্ণ চটক— সোনা-চায়— সোনাচড়ুই], ভাস [পানকৌড়ী], শুক] [টিয়াজাতীয় মদীনা কি কাজলা পাখী], সারস [বেলে হাঁস] ও ময়ুরগণ অতি কঠোর চীৎকার করিতেছে; প্রভাতকালে শত সহস্ৰ শলভ [ফড়িং] পরিদৃশ্যমান [দৃষ্ট] হইতেছে; লৌহতুণ্ড [লোহার তুল্য শক্ত ঠোঁট] কৃষ্ণবৰ্ণ শলভাসকল গজপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া চীৎকার করিতেছে; দিগদাহ উপস্থিত হওয়াতে উভয় সন্ধ্যা প্রকাশমান হইতেছে; পর্জ্জন্য [মেঘ] ধূলিরাশি ও মাংস বর্ষণ করিতেছে; সাধুসম্মতা [সজ্জনমান্যা] ত্ৰিলোকবিখ্যাতা ভগবতী অরুন্ধতি [বশিষ্ঠপত্নী] বশিষ্ঠদেবকে পশ্চাদ্বতীর্ণ করিয়াছেন; শনৈশ্চর রোহিণীকে নিপীড়িত করিতেছেন [শনিগ্ৰহ রোহিণী নক্ষত্ৰ ভেদ করিলে দারুণ দুর্ভিক্ষ হয়]; চন্দ্ৰমার [চন্দ্রের] কলঙ্কচিহ্ন [চন্দ্রের মধ্যে মৃগমুণ্ডকার চিহ্ন] তিরোহিত হইয়াছে; মেঘশূন্য নভোমণ্ডলে মহাঘোর গর্জ্জন শ্রুতিগোচর হইতেছে; অশ্বসকল অনবরত বাষ্পবিন্দু [নয়নজল] বিসর্জ্জন করিতেছে; হে রাজন! মহদ্‌ভয় উপস্থিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”