০৩২. দ্ৰৌপদীর পুনঃ পুনঃ বিলাপ–দৈব-পুরুষকার

৩২তম অধ্যায়

দ্ৰৌপদীর পুনঃ পুনঃ বিলাপ–দৈব-পুরুষকার

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে পাৰ্থ! আমি ধর্ম্মের অবমাননা বা নিন্দা করি না এবং সর্ব্বভুতেশ্বর প্রজাপতিরও অপমান করিতে পারি না, কেবল দুঃখার্ত্ত হইয়াছি বলিয়া বিলাপ করিতেছি; পুনরায় আরও বিলাপ করিব, সুস্থির-মনে শ্রবণ করুন। হে অরতিনিসূদন! এই জন্মমরণশীল সংসারে জ্ঞানবানদিগের কর্ম্ম করাই কর্ত্তব্য; যেহেতু, স্থাবর ব্যতীত কোন জীবই কর্ম্মবিহীন হইয়া কালব্যাপন করিতে পারে না। সদ্যোজাত গোবৎসগণও পূর্ব্বসংস্কার অনুসারে মাতৃস্তনপান অবধি বৃক্ষের ছায়ায় অবস্থান প্রভৃতি কর্ম্ম করিয়া থাকে। বিশেষতঃ জঙ্গমদিগের মধ্যে মনুষ্যগণ কর্ম্মদ্বারা ইহলোক ও পরলোকে আপনার জীবিকালাভ করিবার বাসনা করে। হে ভরতকুলগ্রগণ্য! সমস্ত প্রাণীরাই প্রাক্তনকর্ম্মজনিত সংস্কার অবলম্বনপূর্ব্বক কর্ম্ম করিয়া তাহার প্ৰত্যক্ষ ফললাভ করিয়া থাকে। যেমন বক জলে থাকিয়া পূর্ব্বসংস্কারানুসারে আপনার জীবনযাত্ৰা নির্ব্বাহ করে, সেইরূপ কি ধাতা, বিধাতা সকলেই স্বকীয় পূর্ব্বসঙ্কল্পবশতঃ কর্ম্ম করেন ও অন্যান্য প্ৰাণীসকলেও আপনি আপন প্রাক্তন কর্ম্মসংস্কারপ্রভাবে জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া থাকে। কর্ম্মপরাঙ্মুখ ব্যক্তিরা কখনই জীবিকানির্ব্বাহ করিতে পারে না; তন্নিমিত্ত সকলেরই কর্ম্মানুষ্ঠানে ব্যাপৃত থাকা অবশ্য কর্ত্তব্য। দৈবপর হইয়া কর্ম্ম করিতে বিমুখ হওয়া কোনক্রমেই উচিত নহে; অতএব হে ধর্ম্মরাজ! আপনি সতত কর্ম্মানুষ্ঠানে নিযুক্ত হউন, কদাচ গ্লানিযুক্ত হইবেন না, নিরন্তর কর্ম্ম সকল সমাধান করিয়া কৃতকাৰ্য্য হউন। কর্ম্মানুষ্ঠানজ্ঞ ব্যক্তি সহস্রের মধ্যে একজন আছে কি-না সন্দেহ। অর্থের রক্ষণাবেক্ষণ ও বৃদ্ধিকরণেও কর্ম্মের আবশ্যকতা আছে। কেন না দৈবপর হইয়া উপার্জ্জন না করিলে অর্থ অক্ষয় হয় না, দেখুন, কেবল ব্যয় করিলে হিমাচলও ক্ষয় হইয়া যায়, প্ৰজাগণ যদি ভূমণ্ডলে আসিয়া কর্ম্ম না করিত, তাহা হইলে ক্ৰমে ক্রমে উৎসন্ন হইয়া যাইত এবং কর্ম্ম নিৰ্ম্মফল হইলে তাহাদিগের শ্ৰীবৃদ্ধি হইতে পারিত না। আমরা এমত অনেক লোক দেখিতে পাই, যাহারা অকিঞ্চিৎকর কর্ম্মে ব্যাপৃত থাকে, কিন্তু কর্ম্ম না করিলে লোকে কোনপ্রকারেই জীবিকানির্ব্বাহ করিতে পারে না। অদৃষ্টপর ও চার্ব্বাকমতাবলম্বী এই উভয়প্রকার লোকই শঠ; কেবল কর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তিরাই প্রশংসাভাজন হইয়া থাকেন। যে ব্যক্তি কেবল দৈবের উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া শয়ান থাকে, সে দুর্বুদ্ধি জলমধ্যস্থ আমঘটের [অদগ্ধমৃত্তিকার পাত্ৰ—কাঁচা মাটির ঘটী] ন্যায় অবসন্ন হইয়া যায়। ঐরূপ হঠবাদী ব্যক্তি কর্ম্ম করিতে সমর্থ হইয়াও যদি আলস্যে তাহা পরিত্যাগ করে, তবে অনাথ দুর্ব্বলের ন্যায় অচিরকালমধ্যে কালগ্ৰাসে পতিত হয়। হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! মনুষ্য অকস্মাৎ যে অর্থলাভ করে, তাহাকে হঠপ্রাপ্ত বলা যায়; উহা কাহারও যত্নে উপার্জ্জিত নহে। পুরুষ দৈববশে যাহা প্রাপ্ত হয়, তাহাই দৃষ্টলব্ধ বলিয়া নিশ্চিত হয়; স্বয়ং কর্ম্ম করিয়া যে ফললাভ করে, তাহাকে প্রত্যক্ষ ও পৌরুষলব্ধ কহে এবং স্বভাববশতঃ প্রবৃত্ত কোন অনির্দ্দিষ্ট কারণবশতঃ যাহা লাভ করে, তাহাকে স্বভাবজ ফল কহিয়া থাকে। হে পুরুষসত্তম! লোকে এইরূপে হঠাৎ, দৈবাৎ, স্বভাবতঃ ও কর্ম্মদ্বারা যাহা লাভ করে, তাহা তাহার জন্মান্তরীণ কর্ম্মের ফল। সর্ব্বভুতেশ্বর বিধাতাও কর্ম্মধান হইয়া মনুষ্যগণের পূর্ব্বকৃত কর্ম্মানুসারে ফলপ্ৰদান করিয়া থাকেন। মনুষ্য যে সমস্ত শুভাশুভ কর্ম্ম করে, উহা পূর্ব্বজন্মকৃত কর্ম্মের ফল, কিন্তু বিধাতৃবিহিত বলিয়া নির্দেশ করা যায়। শারীরিগণের দেহ বিধাতার কর্ম্মসাধনের কারণস্বরূপ। দেহ স্বয়ং, অবশ, বিধাতা উহাকে যে কাৰ্য্যে প্রেরণ করেন, সে তাহাই করিয়া থাকে। হে নাথ! সর্ব্বভূতেশ্বর বিধাতা স্বয়ং সর্ব্বকর্ম্মের নিযোক্তা হইয়া অনাত্মবশ জীবগণকে সেই সকল কর্ম্মে প্রেরণ করেন। তিনিই স্বয়ং মনে মনে অর্থনিশ্চয় করিয়া বুদ্ধিপূর্ব্বক কর্ম্ম করিয়া তাহা লাভ করেন; মনুষ্য কেবল তাহার কারণমাত্র। যে-সকল আগার ও নগর প্রস্তুত হইয়াছে, তাহারও কারণ কর্ম্ম, অতএব যে পুরুষশ্রেষ্ঠ! কর্ম্ম যে কত প্রকার, তাহার সংখ্যা করা যায় না। পণ্ডিত ব্যক্তি বুদ্ধিদ্বারা তিলে তৈল, গাভীতে দুগ্ধ ও কাষ্ঠে পাবক সমুৎপন্ন হয় বুঝিতে পারিয়া ঐ সমুদয় প্রস্তুত করিবার উপায়ও স্থির করেন, পরে স্থিরীকৃত উপায়সহকারে কাৰ্য্যসিদ্ধিবিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েন। হে রাজন্‌! এইরূপে প্রাণীগণ কর্ম্মসিদ্ধি করিয়া আপন আপন জীবিকানির্ব্বাহ করে। কর্ত্তা কাৰ্য্যকুশল হইলে কর্ম্ম সুসম্পন্ন ও সাধুফলপ্ৰদ হয়, কিন্তু কর্ত্তা কাৰ্য্যে অক্ষম হইলে বিস্তর ফলভেদ হইয়া থাকে। যদি পুরুষকার কর্ম্মসাধ্যবিষয়ে ব্যর্থ হইত, তাহা হইলে যাগ ও তাড়াগ খননাদি কর্ম্মের ফললাভে কেহ প্ৰবৃত্ত হইত না। পুরুষ কর্ম্মকর্ত্তা, এই নিমিত্তই কর্ম্ম সিদ্ধ হইলে পুরুষের প্রশংসা হয়; অসিদ্ধ হইলে “এ বিষয়ে কি কেহ কর্ত্তা ছিল না” বলিয়া নিন্দা করে। কেহ কেহ কাহেন, সকল কর্ম্মই হঠবশতঃ সম্পন্ন হইয়া থাকে। কেহ কেহ কাহেন, সকলই দৈবপ্রভাবে হয়; কেহ কেহ কহেন, মনুষ্যের প্রযত্নেই কাৰ্য্যসকল সিদ্ধ হয়। কেহ কেহ এই ত্ৰিবিধ কারণদ্বারা সুসম্পন্ন হয় বলিয়া স্বীকার করেন না, কিন্তু দৈব ও হঠাদি সকলই প্রাক্তন কর্ম্মের অন্তর্ভূত হয়, উহা ভিন্ন আর কিছুই কারণ হইতে পারে না। যাহারা হঠ ও দিষ্টকে [দৈব-ভাগ্য] অৰ্থসিদ্ধির কারণ বলেন ও যে তত্ত্ববিৎ ব্যক্তিরা জানেন যে, মনুষ্য দৈব, হঠ ও স্বভাব এই তিনপ্রকার কারণেই ফলপ্ৰাপ্ত হয়, কিন্তু শুভাশুভ সমস্তই প্রাক্তন কর্ম্মের ফল, যে সকল পণ্ডিত বলেন, প্রাক্তন কর্ম্ম কারণ নহে, তাহারা কিন্তু বিলক্ষণ তত্ত্ববিৎ পণ্ডিত। দেখুন, যদি বিধাতা সমস্ত প্রাণীগণকে জন্মান্তরীণ কর্ম্মানুসারে ফলপ্ৰদান না করিতেন, তাহা হইলে মনুষ্য যেরূপ বিষয়াভিলাষে কর্ম্ম করিত, তাহাই প্রাপ্ত হইত। অর্থসিদ্ধি ও অর্থের অসিদ্ধি এই তিনটি—দৈব, হঠ ও স্বভাব—দ্বারাই হইয়া থাকে, কিন্তু উহার মুখ্য কারণ প্রাক্তন-কর্ম্ম, ইহা যাহারা স্বীকার না করেন, তাহারা দেবতুল্য জড়পদার্থ। ভগবান মনুও কর্ম্ম অবশ্য-কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। হে মহারাজ! পুরুষ দৈবপর হইয়া একান্ত নিশ্চেষ্ট হইলে অবশ্যই পরাভূত ও দুঃস্থ হয়, কর্ম্ম করিলে প্রায়ই ফলসিদ্ধি হইয়া থাকে; কিন্তু অসম্যক্‌কাকরী ব্যক্তি কখনই অভষ্টি ফললাভ করিতে পারে 
না। অঙ্গভঙ্গপ্রযুক্ত ক
র্ম্ম নিষ্ফল হয় বলিয়া কদাচ কর্ম্মের বৈয়র্থ্য স্বীকার করা যায় না, যেহেতু, প্ৰায়শ্চিত্ত করিলে অবশ্যই ফললাভ হয়, অতএব কর্ম্ম কদাচ ফলশূন্য নহে। কর্ম্ম সুসম্পন্ন হইলে যদি ফলপ্ৰাপ্ত না হয়, তাহাতেও কোন দোষ হইতে পারে না। যে ব্যক্তি আলস্যপরায়ণ হইয়া কেবল শয়ান থাকে, তাহাতে অলক্ষ্মীর আবেশ হয়, আর যে পুরুষ কাৰ্য্যদক্ষ, সে নিশ্চয়ই আপন কর্ম্মের ফললাভ করিয়া অতুল ঐশ্বৰ্য্য ভোগ করে। সংশয়ই অনর্থের মূল; অসংশয়চিত্তে কর্ম্ম করিলে অবশ্যই কাৰ্য্যসিদ্ধি হয়, কিন্তু নিতান্ত সংশয়বিহীন ধীরব্যক্তি সংসারে অতি দুর্লভ। হে মহারাজ! সম্প্রতি আমাদের এই মহান অনর্থ সমুপস্থিত হইয়াছে; যদি আপনি পুরুষকার অবলম্বন করেন, তাহা হইলে নিঃসন্দেহই অনৰ্থ-নাশ হইবে। পাছে কর্ম্ম সফল না হয়, এই ভাবিয়া যদি আপনি, বৃকোদর, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব নিশ্চেষ্ট থাকেন, তাহা হইলে রাজ্যপ্ৰাপ্তির আশা একেবারে দূর হইয়া যায়; কিন্তু ইহা আপনাদের পক্ষে অতি অন্যায়। যখন অন্যের কর্ম্ম সফল হইতেছে, তখন আমাদের চেষ্টা কেনই বা নিরর্থক হইবে? কর্ম্ম করিলে শীঘ্রই হউক কিংবা বিলম্বেই হউক, অবশ্যই তাহার ফললাভ হয়। দেখুন, কৃষক লাঙ্গলদ্বারা পৃথিবী কর্ষণ করিয়া শস্যবপনপূর্ব্বক নিশ্চেষ্ট হইয়া কেবল বৃষ্টির অপেক্ষা করে। যদিও বৃষ্টি না হয়, তাহাতে কৃষকের তত ক্ষোভ হয় না। সে মনে করে যে, পুরুষের যাহা কর্ত্তব্য, তাহা করিয়াছি, সফল হইল না, ইহাতে আমার কোন অপরাধ নাই। পণ্ডিত ব্যক্তি ‘পুরুষের যাহা কর্ত্তব্য, তাহা যথাসাধ্য করিয়াছি, এক্ষণে সফল হইল না, ইহাতে আমি কোনক্রমে অপরাধী নহি এই বিবেচনা করিয়া আত্মনিন্দা করেন না। আমি কর্ম্ম করিলে অর্থসিদ্ধি হয় না’, এই বলিয়া কর্ম্মে বৈরাগ্য প্রকাশ করিবে না। ফলসিদ্ধিবিষয়ে পুরুষকার ও অবৈরাগ্য এই দুইটি কারণ আছে। কর্ম্মসিদ্ধি হউক বা না হউক, কর্ম্ম করিতে উপেক্ষা করা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। সমুদয় কারণ একত্ৰ হইলে অবশ্যই কর্ম্মসিদ্ধি হয়। প্রধান অঙ্গের অভাব থাকিলে কর্ম্মের সম্পূর্ণ ফল হয় না, হয় ত’ একেবারেই কর্ম্ম নিষ্ফল হইয়া যায়; কর্ম্ম আরম্ভ না করিলে ফল বা শৌৰ্য্যাদিগুণ কিছুই দৃষ্ট হয় না। মনুষ্য আপনার কল্যাণলাভের নিমিত্ত স্বীয় বুদ্ধিসাধ্যে দেশ, কাল, উপায় ও মঙ্গল প্রয়োগ করিবে। পরাক্রমই কাৰ্য্যসাধনের মুখ্য উপায়, ইহা সর্ব্বত্র দৃষ্ট হইতেছে; অতএব পরাক্রম অবলম্বনপূর্ব্বক অপ্ৰমত্ত হইয়া কর্ম্ম করিবে। বুদ্ধিমান লোক যে ব্যক্তিতে বহুগণ-সংযুক্ত মঙ্গললাভের চিহ্ন দেখেন, তাহা হইতে সাম, দান ও ভেদ এই তিন উপায়দ্বারা অর্থলাভের আকাঙ্ক্ষা করেন। মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, যদি সমুদ্র বা পর্ব্বতও অপকারক হয়, তাহাদিগের ব্যাসন বা বিবাসনের চেষ্টা করিবে। যে ব্যক্তি সতত শক্রগণের ছিদ্রান্বেষণে সমুত্থিত হইয়া থাকে, সে আপনার ও অমাত্যগণের নিকট ঋণ হইতে মুক্ত হয়। পুরুষ কদাপি অশক্ত বলিয়া আত্মার অবমাননা করিবে না; আত্মাবমানী ব্যক্তি কখন উৎকৃষ্ট ঐশ্বৰ্য্যলাভ করিতে পারে না। হে রাজন! লোকের স্বাভাবিকী ফলসিদ্ধি এই প্রকার হইয়া থাকে; কিন্তু কাল ও অবস্থার বিভাগানুসারে ঐ সিদ্ধি ভিন্ন-ভিন্ন রূপে পরিণত হয়, সন্দেহ নাই।

“হে ভারতবংশাবতংস! পূর্ব্বে পিতা একজন পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণকে আপনার ভবনে বাস করাইয়াছিলেন; এই বৃহস্পতিপ্রোক্ত নীতি তাঁহার নিকট কহিয়াছিলেন ও ভ্রাতৃগণকে অভ্যাস করাইয়াছিলেন, আমিও তৎকালে তাহাদের নিকট ইহা শ্রবণ করিয়াছিলাম। হে মহারাজ! আমি যখন ঐ সমস্ত বিষয় শুনিবার মানসে কোন কাৰ্য্যোদ্দেশে পিতার ক্ৰোড়ে গিয়া বসিতাম, তখন সেই ব্ৰাহ্মণ আমাকে সান্ত্বনা করিয়া এই সকল নীতি কহিতেন।”