৪৯. কর্ণের প্রতি কৃপাচাৰ্য্যের কটাক্ষ

৪৯তম অধ্যায়

কর্ণের প্রতি কৃপাচাৰ্য্যের কটাক্ষ

কৃপ কহিলেন, “হে কৰ্ণ! ক্রূর-যুদ্ধে তোমার নিপুণতা আছে এবং কিরূপে মন্ত্রণা করিতে হয়, তাহাও তোমার অবিদিত নাই, কিন্তু উত্তরকালে যে কি ফল হইবে, তাহার কিছুমাত্ৰ পৰ্য্যবেক্ষণ কর না। শাস্ত্ৰে বহুবিধ মায়াযুদ্ধ উল্লিখিত হইয়াছে বটে, কিন্তু পণ্ডিতগণ ঐ সমুদয় সংগ্রামকে পাপযুদ্ধ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। উপযুক্ত দেশকাল পৰ্য্যালোচনা করিয়া যুদ্ধ করিলে জয়লাভ হয়; কিন্তু অযোগ্য দেশে বা অকালে সংগ্রাম করিলে কখন ফললাভ হয় না। হে রাধেয়! অনধিকারচর্চায় প্রবৃত্ত হওয়া বিধেয় নহে; বিজ্ঞ ব্যক্তিরা রথকারের ভার বহনে কদাচ প্ৰবৃত্ত হয়েন না। ইহা সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করা আমাদিগের পক্ষে কোন ক্রমেই শ্রেয়স্কর নহে। ঐ মহাবীর একাকী কুরুদেশ রক্ষা, অগ্নির তৃপ্তিসাধন ও পঞ্চ বৎসর ব্রহ্মচৰ্য্যানুষ্ঠান করিয়াছে; ঐ মহাবীর একাকী সুভদ্রাকে হরণ করিয়া রথে আরোহণপূর্ব্বক দ্বৈরথযুদ্ধ করিবার মানসে কৃষ্ণকে আহ্বান করিয়াছিল। ঐ মহাবীর একাকী কিরাতরূপী ভগবান মহাদেবের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। ঐ মহাবীর একাকী বনমধ্যে জয়দ্ৰথকর্ত্তৃক অপহৃত কৃষ্ণকে প্রত্যুদ্ধার করিয়াছিল। ঐ মহাবীর একাকী ইন্দ্রের নিকট পঞ্চ বৎসর অস্ত্রশিক্ষা করিয়াছে। ঐ মহাবীর একাকী অরাতি পরাজয় করিয়া কুরুকুলের যশোরাশি দেদীপ্যমান করিয়াছে। ঐ মহাবীর একাকী সংগ্রামে অরিনিসূদন গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ৰসেন, নিবাতকবচগণ ও কালকঞ্জ দানবদলকে সংহার করিয়াছে। হে কর্ণ! ঐ মহাবল পরাক্রান্ত ধনঞ্জয় একাকী স্বীয় বীৰ্য্যপ্ৰভাবে এই সমুদয় অলৌকিক কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে। তুমি একাকী কোনকালে কোন মহৎ কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছ?

“মহাবীর অর্জ্জুন দিগ্বিজয়সময়ে ভূপালগণকে বশবর্তী করিয়া যে প্রকার অসাধারণ শক্তি প্ৰকাশ করিয়াছিল, তাহাতে বোধ হয়, সুররাজ ইন্দ্রও তাহার সহিত সংগ্রাম করিতে সমর্থ নহেন, অতএব হে সূতনন্দন! তুমি সেই মহাতেজঃ পার্থের সহিত যুদ্ধ করিবার মানস করিয়া কি নিমিত্ত দক্ষিণকর প্রসারণপূর্ব্বক প্রদেশিনী [তর্জনী অঙ্গুলি] দ্বারা ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গমের [সর্পের] দংশন আক্রমণ করিতে বাসনা করিতেছ? তুমি অঙ্কুশ না লইয়া মহাবনপ্রবিষ্ট মত্ত-মাতঙ্গে আরোহণপূর্ব্বক নগরে গমন করিতে বাসনা করিয়াছ; তুমি ঘৃতাক্ত হইয়া চীরবাস পরিধানপূর্ব্বক প্রজ্বলিত [ঘৃতপ্ৰক্ষেপে সমধিক উদ্দীপিত] হুত-হুতাশনের মধ্য দিয়া গমন করিতে বাসনা করিতেছ; কোন ব্যক্তি তলদেশে মহাশিলা বদ্ধ করিয়া বাহু দ্বারা সমুদ্র সন্তরণ করিতে অভিলাষ করে? যে ব্যক্তি অকৃতাস্ত্র ও দুর্ব্বল হইয়া সেই বলবান কৃতাস্ত্ৰ ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করিতে মানস করে সে নিতান্ত মূঢ়। ঐ মহাবীর আমাদিগের কর্ত্তৃক পরাজিত ও অপমানিত হইয়া ত্ৰয়োদশ বৎসর প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ ছিল, এক্ষণে মুক্ত হইয়া অবশ্যই আমাদিগকে নিঃশেষিত করিবে। মহাবল-পরাক্রান্ত অর্জ্জুন যে কৃপমধ্যস্থিত হুতাশনের ন্যায়। এই স্থানে গোপনে অবস্থান করিতেছেন, ইহা আমরা পূর্ব্বে জানিতে পারিলে কদাচ এরূপ কর্ম্ম করিতাম না। যাহা হউক, এক্ষণে মহাভয় সমুপস্থিত, অতএব দ্রোণ, দুৰ্য্যোধন, ভীষ্ম, অশ্বত্থামা, তুমি ও আমি, এই ছয় জন রখী প্রস্তুত হইয়া থাকি, সকলে একত্ৰ হইয়া অর্জ্জুনের সহিত সংগ্ৰাম করিব। একাকী যুদ্ধ করিব বলিয়া বৃথা সাহস বা দৰ্প করিবার আবশ্যক নাই। সৈন্য সমুদয় ও প্রধান প্রধান ধনুৰ্দ্ধরগণ বর্ম্মধারণ ও ব্যূহ রচনা করিয়া অস্ত্ৰ-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক সাবধান হইয়া থাকুক। পূর্ব্বে দানবগণ বাসবের সহিত যেরূপ সমর করিয়াছিল, আদ্য অর্জ্জুনের সহিত আমাদিগেরও সেই প্রকার সংগ্ৰাম হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”