০১৯. পাণ্ডবপক্ষের সৈন্যসজ্জা

১৯তম অধ্যায়

পাণ্ডবপক্ষের সৈন্যসজ্জা

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! এই একাদশ অক্ষৌহিণী ব্যূহিত হইয়াছে দেখিয়াও মানুষ, দৈব, গান্ধর্ব্ব ও আসুর ব্যূহবেত্তা যুধিষ্ঠির কি প্রকারে অল্পসৈন্য লইয়া ভীষ্মের বিপক্ষে ব্যূহ রচনা করিলেন?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরনাথ! ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির রাজা দুৰ্য্যোধনের সৈন্যগণকে ব্যূহিত দেখিয়া ধনঞ্জয়কে কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! বৃহস্পতি কহিয়াছেন, শত্রুসৈন্য অপেক্ষা আপনার সৈন্য অল্প হইলে তাহাদিগকে বিস্তারিত ও অধিক হইলে তাহাদিগকে সংহত করিয়া সংগ্ৰাম করিবে। অধিক সৈন্যের সহিত সংগ্রাম করিতে হইলে অল্প সৈন্যদিগকে সূচীমুখাকারে [ইহার নাম সূচীব্যূহ। যে স্থলে বিপক্ষ সৈন্য অধিক তথায় এইরূপ কর্ত্তব্য। এই ব্যূহে পিপীলিকাপংক্তির ন্যায় অগ্র ও পশ্চাৎ ভাগ সংহত, অর্থাৎ সমিলিত করিয়া সেনাসংস্থান করিতে হয়। সম্মুখভাগে বিপক্ষ সৈন্য প্রবল হইলে এইরূপ ব্যূহরচনা করা উচিত] সন্নিবেশিত করিবে। আমাদিগের সৈন্য শত্রু অপেক্ষাও অল্প; অতএব বৃহস্পতির বাক্যানুসারে ব্যূহ রচনা কর।”

“ধনঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার নিমিত্ত বজ্রপাণিশিক্ষিত বজ্রাখ্য[ইহার নাম “বজ্র”ব্যূহ। কখনো সূচীব্যূহের ন্যায় সৈন্যগণকে সংহত করিতে হয়, কখনো বিপক্ষের সমক্ষে যাহাতে বেশী বলিয়া বোধ হয়, তদ্রূপ ভাবে ছড়াইয়া সাজাইতে হয় এবং প্রয়োজনবশে কখনো সূচীব্যূহের মত সৈন্য সাজাইতে হয়। বজ্রব্যূহে এই তিন প্রকার রচনারীতি অবলম্বনীয়।]নামে অচল [অটুট] ও দুর্জ্জয় ব্যূহ রচনা করিতেছি। যিনি সমরে সমীরণের ন্যায় শক্ৰগণের দুঃসহ, যুদ্ধোপায়বিচক্ষণ [যুদ্ধকৌশলে অভিজ্ঞ] যোদ্ধাদিগের অগ্রগণ্য, সেই ভীমসেন আমাদের অগ্রযোদ্ধা [সমরের সম্মুখবর্ত্তী] হইয়া রিপুসৈন্যের তেজোরাশি বিনাশিত করিবেন। যেমন হীনবল মৃগসকল সিংহসন্দর্শনে ভীত হইয়া পলায়ন করে, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি কৌরবগণ তাঁহাকে দর্শন করিয়া নিবৃত্ত হইবে। যেমন দেবগণ দেবরাজ ইন্দ্রের আশ্রয় গ্ৰহণ করেন, তদ্রূপ আমরা সেই প্রাকার [প্রাচীর—আবরণ] স্বরূপ যোধপ্রধান ভীমসেনকে আশ্রয় করিব। এই ভূমণ্ডলে এমন পুরুষ নাই যে, ভীমকর্মী ভীমসেন রোষাবিষ্ট হইলে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে সমর্থ হয়।”

“মহাবাহু ধনঞ্জয় এই কথা কহিয়া সৈন্যগণকে যথোক্ত প্রকারে ব্যূহিত করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। পরিপূর্ণ স্তিমিত [চাঞ্চল্যরহিত—স্থির] ভাগীরথীর ন্যায় পাণ্ডবগণের মহতী সেনা কৌরবগণকে আগমন করিতে দেখিয়া মন্দ মন্দ গমন করিতে আরম্ভ করিল। যিনি বজ্রসারময়ী [বজ্রবৎ দৃঢ়] গদা গ্ৰহণ করিয়া মহাবেগে বিচরণ করিলে সমুদ্রও শুষ্ক হইয়া যায়, সেই ভীমসেন সেনাপতিগণের অগ্রনেতা [অগ্রণী—প্ৰধান পরিচালক] হইলেন এবং মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব ও রাজা ধৃষ্টকেতু ইহারাও অগ্রনেতা হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। বিরাট এবং অক্ষৌহিণীপরিবৃত রাজা যুধিষ্ঠির তাহার ভ্রাতা ও পুত্ৰগণসমভিব্যাহারে পৃষ্ঠগোপ্তা হইলেন। মহাদ্যুতি নকুল ও সহদেব ভীমসেনের চক্ররক্ষক [সৈন্যের চারিদিকের রক্ষক] হইলেন; অভিমন্যু ও দ্ৰৌপদেয়গণ তাঁহার পৃষ্ঠভাগ রক্ষা করিতে লাগিলেন। মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভদ্রকগণসমীভব্যাহারে তাহাদিগের সকলকে রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। অর্জ্জুনকর্ত্তৃক রক্ষিত শিখণ্ডী ভীষ্মবধের নিমিত্ত সাতিশয় যত্নবান হইয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ গমন করিলেন। মহাবল যুযুধান অর্জ্জুনের পৃষ্ঠভাগ রক্ষা করিতে লাগিলেন, পাঞ্চালনন্দন যুধামন্যু ও উত্তমৌজা এবং কৈকেয়, ধৃষ্টকেতু ও মহাবীর চেকিতান অমাত্যগণসমভিব্যাহারে তাঁহার চক্ররক্ষক হইলেন। ইঁহারা সকলেই আপনার সৈন্যগণকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। হে রাজন! মহাবীর অর্জ্জুন, “ঐ সকল ব্যক্তি ধৃতরাষ্ট্রের দায়াদ, উহারা আপনার অংশে রহিল।’, ইহা ভীমসেনকে কহিলে পর পাণ্ডবসৈন্যসকল অনুকুল বাক্যে তাহাকে স্তব করিতে লাগিল।

“রাজা যুধিষ্ঠির সচল অচলের ন্যায় বৃহত্তর মত্তমাতঙ্গসমূহ সহকারে মধ্যম-সৈন্যে [মধ্যভাগস্থিত সৈন্যের রক্ষকরূপে] অবস্থান করিলেন। মহানুভব পাঞ্চালনন্দন যজ্ঞসেন অক্ষৌহিণীসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের নিমিত্ত পরাক্রান্ত বিরাটের অনুবর্ত্তী হইলেন; তাঁহাদিগের রথে আদিত্য ও চন্দ্রের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন, সুবর্ণভূষিত, নানা চিহ্নশালী ধ্বজসকল শোভা পাইতে লাগিল। তৎপরে মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাদিগকে উৎসারিত করিয়া [সরাইয়া দিয়া] সভ্রাতৃক সপুত্র যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুনের রথে একমাত্র কপিধ্বজ কৌরব ও পাণ্ডবগণের অন্যান্য সমুদয় ধ্বজ অতিক্রম করিয়া শোভমান হইল। বহু সহস্ৰ পদাতিক ভীমসেনকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত অসি, শক্তি ও ঋষ্টি হস্তে করিয়া অগ্ৰে অগ্ৰে গমন করিতে লাগিল। মদস্রাবী, মহাবল, হেমজলজড়িত [স্বর্ণনির্ম্মিত পৃষ্ঠাবরণবস্ত্ৰে আবৃত], পদ্মগন্ধী [পদ্মতুল্য সুগন্ধ], দশ সহস্ৰ বারণ [হস্তী] বর্ষণকারী মেঘ ও গমনশীল ভূধরের ন্যায় রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুবর্ত্তী হইল।

“মনস্বী ভীমসেন পরিঘোপম [দীর্ঘ মুষলতুল্য] ভীষণ গদা গ্ৰহণ করিয়া মহাসৈন্য আকর্ষণপূর্ব্বক বিপক্ষসৈন্যের প্রতি গমনোন্মুখ হইলেন; তখন কোন যোদ্ধারই সাধ্য নাই যে, নিকটে গিয়া দিবাকরের ন্যায় দুষ্প্রেপ্রক্ষণীয় [দুৰ্দর্শ-অতি কষ্টে দর্শনযোগ্য] পরন্তপ ভীমসেনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে। যে ব্যূহে ভয়ের লেশ নাই, সকল দিকেই যাহার মুখ, চাপরূপ বিদ্যুৎ যাহার ধ্বজ, যাহা অতি ভীষণ ও মানবগণের অজেয়, গাণ্ডীবধন্বা অর্জ্জুন এবং অন্যান্য পাণ্ডবগণ কৌরবসেনার বিপক্ষে সেই বজ্রাখ্য ব্যূহ রচনা করিয়া রক্ষা করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর সূৰ্য্যোদয় হইলে সৈন্যগণ সন্ধ্যাবন্দনাদি সমাপন করিল। আকাশে মেঘের লেশ নাই; তথাপি গর্জ্জনশীল সমীকরণ জলবিন্দুসহকারে প্রবাহিত হইতে লাগিল। প্রবল বায়ু কৰ্কর বর্ষণপূর্ব্বক ধূলিপটল উৎক্ষিপ্ত করিল। সমুদয় জগৎ অন্ধকারে সূৰ্য্যের প্রতি আস্ফালন করিয়া [স্পৰ্দ্ধা করিয়া—আপন তেজের আধিক্য দেখাইয়া] মহাশব্দে বিদীর্ণ হইয়া গেল।

“সৈন্যগণ সুসজ্জিত হইলে দিবাকর প্রভাশূন্য হইলেন; পৃথিবী ঘোরশব্দে কম্পিত ও বিশীর্ণ হইতে লাগিল; চতুর্দ্দিকে ভুরি ভুরি নির্ঘাতশব্দ সমুৎপন্ন হইল এবং এরূপ দুর্বিষহ ধূলিপটল প্রাদুর্ভূত হইয়া উঠিল যে, আর কিছুই নয়নগোচর হইল না। কিঙ্কিণীজালজড়িত কাঞ্চনমালা, উৎকৃষ্ট বসন ও পতাকাপরিশোভিত আদিত্যের ন্যায় তেজোযুক্ত ধ্বজসকল সহসা জগৎ ঝনঝনায়মান [কান-ঝালাপালাকর কর্কশ শব্দ] হইয়া উঠিল। হে রাজন! পুরুষশ্রেষ্ঠ সমরপ্রিয় পাণ্ডবগণ গদাপাণি ভীমসেনকে অগ্রস্থিত দেখিয়া আপনাদের সৈন্যের প্রতিপক্ষে ব্যূহ রচনাপূর্ব্বক যেন তাহাদিগের মজ্জা গ্ৰাস করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন।”