০৭. যুধিষ্ঠিরের দ্যূতকরবেশে বিরাটরাজ-সভাপ্রবেশ

৭ম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের দ্যূতকরবেশে বিরাটরাজ-সভাপ্রবেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তদনন্তর মহাবিষ, আশীবিষের ন্যায় দুরাসাদ, কুরুবংশাবতংস মহানুভব, রাজা যুধিষ্ঠির বৈদূৰ্য্য ও কাঞ্চনময় অক্ষগুটিকাসকল বস্ত্ৰ দ্বারা বেষ্টনপূর্ব্বক কক্ষে নিক্ষেপ করিয়া সর্ব্বাগ্রে সভাস্থ বিরাটরাজের নিকট উপনীত হইলেন। তিনি অপূর্ব্ব রূপ ও বলপ্রভাবে সাক্ষাৎ অমরের ন্যায়, নিবিড় জলদজালজড়িত সূর্য্যের ন্যায় ও ভস্মাচ্ছন্ন বহ্নির ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। বিরাটরাজ আচিরকালমধ্যে অভ্রপটলসংবৃত সুধাংশু-সদৃশ সভাগত যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মন্ত্রী, ব্রাহ্মণ, সূত, বৈশ্য ও অন্যান্য সভ্যদিগের জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে সভাসদগণ! যিনি প্রথমে আগমন করিয়া রাজার ন্যায় সভা নিরীক্ষণ করিতেছেন, উনি কে? উনি ব্রাহ্মণ নহেন, আমার বোধ হয়, কোন রাজা হইবেন; উহার সমভিব্যাহারে দাস, রথ ও হস্তী কিছুই নাই। তথাচ উনি দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। যেমন মদমত্ত বারণ অকুতোভয়ে নলিনীর সমীপে সমুপস্থিত হয়, তদ্রূপ ইনিও আমার নিকট অসঙ্কুচিতচিত্তে আগমন করিতেছেন। যাহা হউক, ইহার আকারপ্রকারদর্শনে উহাকে রাজা বলিয়া আমার বোধ হইতেছে।”

বিরাটরাজ এইরূপ তর্ক-বিতর্ক করিতেছেন, ইত্যবসরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহার সন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমি ব্রাহ্মণ-জাতি, সর্ব্বস্বান্ত হওয়াতে জীবিকালাভের নিমিত্ত আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। মানস করিয়াছি, এই স্থানে অবস্থানপূর্ব্বক মহাশয়ের অভিলাষানুরূপ কাৰ্য্যসংসাধন করিব।” তখন বিরাটরাজ সাতিশয় প্ৰহৃষ্টমনে স্বাগত-প্রশ্নপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তাঁহার বাক্য স্বীকার করিয়া কহিলেন, “তাত! তোমাকে নমস্কার! এক্ষণে তুমি কোন রাজার রাজধানী হইতে আগমন করিতেছ, তোমার নাম ও গোত্র কি এবং তুমি কি কি শিল্পকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাক, এই সমস্ত সত্য করিয়া বল।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মহারাজ! আমি ব্যাঘ্রপদী গোত্রসম্ভূত ব্ৰাহ্মণ; আমার নাম কঙ্ক। পূর্ব্বে আমি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রিয়সখা ছিলাম, দূতে আমার সবিশেষ নিপুণতা আছে।”

বিরাট কহিলেন, “আমি তোমার প্রার্থনা-পূরণে সম্মত আছি। তুমি মৎস্যদেশ শাসন কর। আমি তোমার একান্ত বশংবদ। দূতানুরক্ত ব্যক্তিগণ আমার প্রিয় পাত্র; অতএব তুমিও আমার প্রিয় ও রাজ্যলাভে সম্যক উপযুক্ত।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মহারাজ! আমি নীচ লোকের সহিত কখনই দূতক্রীড়া করিব না এবং আমি যাহাকে পরাজয় করিব, সে আমার ধনলাভে কদাচ অধিকারী হইবে না। আপনি অনুকম্পা করিয়া আমার এই প্রার্থনায় সম্মত হইন।” বিরাট কহিলেণ, “আমি তোমার অহিতকারী ব্রাহ্মণকে বিষয় হইতে নির্ব্বাসিত করিয়া দিব এবং অন্যে তোমার অপ্রিয়ানুষ্ঠান করিলে তৎক্ষণাৎ তাহার প্রাণনাশ করিব।”

“হে জনপদবর্গ। তোমরা সকলেই সমাগত হইয়াছ, এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ করা। অদ্যাবধি প্ৰিয়-সখা কঙ্ক আমার ন্যায় সকল বিষয়েই সম্পূর্ণ অধিকারী হইলেন।” অনন্তর ধর্ম্মরাজের প্রতি দৃষি।টপাত করিয়া কহিলেণ, “সখে! আমি তোমার সহিত একযানে আরোহণ করিব এবং আমার ন্যায় তোমারও প্রচুর বস্ত্র ও অপৰ্য্যাপ্ত পান-ভোজন লাভ হইবে। আমি গৃহের দ্বার-সকল উদঘাটন করিয়া দিতেছি। তুমি সর্ব্বদাই বাহ্যান্তর [বাস—বহিৰ্দ্ধার, আন্তর—অন্তঃপুর] পৰ্য্যবেক্ষণ করিবে। যদি জীবিকালাভে অসমর্থ হইয়া তোমার নিকট কেহ কিঞ্চিৎ প্রার্থনা করে, তাহা হইলে তুমি তৎক্ষণাৎ আমাকে বলিবে, আমি নিঃসন্দেহ তাহার মনোরথ পূর্ণ করিব। আমার সন্নিধানে তোমার কিছুমাত্র শঙ্কা নাই।”

হে মহারাজ! এইরূপে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বিরাটের সহিত সমাগত হইয়া পরম-সমাদরে বাস করিতে লাগিলেন, কেহই তাঁহার এই বৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গও অবগত হইতে পারিল না।