০১৭. বিয়সূচনা-কর্ণের ভীষ্ম ঈর্ষা

১৭শ অধ্যায়

বিয়সূচনা-কর্ণের ভীষ্ম ঈর্ষা

“মহারাজ! ভগবান বেদব্যাস যে প্রকার কহিয়াছিলেন, ভূপালগণ সেই প্রকার একত্র হইয়া আগমন করিয়াছিলেন। ঐ দিন চন্দ্ৰমা মঘানক্ষত্ৰে [মঘা নক্ষত্রের অধিপতি পিতৃগণ; মৃত পিতৃগণের বাসস্থান চন্দ্ৰলোকে। চন্দ্রের মঘামিলনদিনে যুদ্ধারম্ভে ইহাই সূচিত হয় যে বীরগণের পিতৃলোকে গতি হইবে—যুদ্ধে মৃত্যু ঘটিবে।] গমন করিয়াছিলেন। দীপ্যমান সপ্তমহাগ্ৰহ [গ্ৰহলোক হইতে অন্তরীক্ষে সাতটি মহাগ্ৰহ স্মৃলিত হইয়াছিল। রাহু ও কেতু দুইটি উপগ্রহ, মূল গ্রহ রবি-আদি সপ্ত, উক্ত দুইটি উপগ্রহ লইয়া নবগ্রহ সংজ্ঞা।] আকাশে পতিত হইয়াছিল এবং প্রজ্বলিত শিখাসমুপেত দিবাকর যেন দ্বিধাভূত [দুই ভাগে বিভক্ত—দুইটি সূৰ্য্য] হইয়া সমুদিত হইয়াছিলেন। মাংসশোণিতপ্রিয় গোমায়ু ও বায়সগণ শরীরভিক্ষণে লোলুপ হইয়া প্ৰদীপ্ত দিগ্নিভাগে [চতুর্দ্দিকে] শব্দ করিতে লাগিল। কুরুপিতামহ ভীষ্ম ও অরিনিসূদন দ্রোণ প্রতিদিন প্ৰাতঃকালে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক সংযত হইয়া ‘পাণ্ডবগণের জয় হউক’ বলিয়া আশীর্ব্বাদ করেন, আপনার নিমিত্ত যে প্রকার প্রতিজ্ঞ করিয়াছেন, তদনুসারে যুদ্ধ করিয়া থাকেন।

“ভীষ্ম প্রথমে সমুদয় মহীপালগণকে আনয়ন করিয়া কহিলেন, ‘হে ক্ষত্ৰিষগণ! সংগ্রামই স্বৰ্গগমনের অনাবৃত [খোলা]দ্বারা; এই দ্বার আশ্রয় করিয়া ইন্দ্ৰলোক ও ব্ৰহ্মলোকে গমন করা। নাভাগ, যযাতি, মান্ধাতা, নহুষ ও মৃগ ঈদৃশ কর্ম্মদ্বারাই সিদ্ধ হইয়া পরমস্থানে গমন করিয়াছেন। ব্যাধিদ্বারা গৃহে প্ৰাণত্যাগ করা ক্ষত্ৰিয়ের পক্ষে অধর্ম্ম, শস্ত্রদ্বারা মৃত্যুই তাহাদিগের সনাতন ধর্ম্ম।”

“মহীপালগণ৷ ভীষ্মের বাক্যাবসানে রথারোহণ করিয়া স্ব স্ব সৈন্যসমভিব্যাহারে গমন করিলেন। কিন্তু হে নৃপ! বিকর্ত্তননন্দন কৰ্ণ তাঁহার অমাত্য ও বন্ধুগণকে ভীষ্মনিমিত্ত অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করাইলেন। কর্ণ ব্যতীত অন্যান্য ভূপাল ও আপনার পুত্ৰগণ সিংহনাদে দশদিক মুখরিত [ধ্বনিত] করিতে লাগিলেন; সৈন্যসকল শ্বেতচ্ছত্ৰ, পতাকা, ধ্বজ, গজ, বাজী, রথ ও পদাতিদ্বারা সাতিশয় শোভমান হইতে লাগিল। ভেরী, পণব, দুন্দুভি ও রথনেমির নিনাদে মেদিনীমণ্ডল আকুলিত হইয়া উঠিল। মহারথগণ কাঞ্চনময় অঙ্গদ ও কেয়ুরদ্বারা অগ্নিমান [আগ্নেয়-প্রজ্বলিত অগ্নিযুক্ত] পর্ব্বতের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। বিমল আদিত্যসদৃশ কুরুচমূপতি [কুরুসেনাপতি] পিতামহ ভীষ্ম পঞ্চতারামণ্ডিত [পাঁচটি তারকচিহ্নিত] তালকেতু [পতাকাযুক্ত তালপ্রমাণ তরুর ন্যায় উচ্চ ধ্বজ] দ্বারা শোভা পাইতে লাগিলেন। আপনার মহাধনুৰ্দ্ধর ভূপালগণ। ভীষ্মের চতুর্দ্দিকে যথাস্থানে অবস্থান করিলেন। গোবাসনদেশীয় রাজা শৈব্য পতাকাশোভিত কবিরাজে আরোহণ করিয়া রাজগণসমভিব্যাহারে গমন করিলেন। পদ্মবৰ্ণ অশ্বত্থামা সিংহলাঙ্গুলকেতু [সিংহপুচ্ছে চিহ্নিত পতাকাযুক্ত] রথে আরোহণপূর্ব্বক সকলের অগ্রসর হইয়া গমন করিলেন; শ্রুতায়ুধ, চিত্ৰসেন, পুরুমিত্র, বিবিংশতি, শল্য, ভূরিশ্রবা ও বিকৰ্ণ, এই সাত মহাধনুৰ্দ্ধর উৎকৃষ্ট বর্ম্ম ধারণ ও রথে আরোহণ করিয়া অশ্বত্থামার অনুসরণক্ৰমে ভীষ্মের পুরোবর্ত্তী হইলেন। তাঁহাদিগের অত্যুন্নত সুবৰ্ণময় ধ্বজসকল রথসমূহ অলঙ্কৃত করিয়া শোভা পাইতে লাগিল। আচাৰ্য্যপ্রধান দ্রোণের ধ্বজ, সুবৰ্ণময় বেদী ও কমণ্ডলুভূষিত এবং শরাসনযুক্ত পরিদৃশ্যমান হইল। অনেক শতসহস্র সেনাসমবেত দুৰ্য্যোধনের মণিময় ধ্বজ নাগচিহ্নে [হস্তিচিহ্নে] শোভিত হইতে লাগিল। কলিঙ্গদেশবাসী, পৌরব, কাম্বোজ ও সুদক্ষিণগণ এবং ক্ষেমধন্বা ও শল্য দুৰ্য্যোধনের সম্মুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মগধরাজ বৃষভধ্বজভূষিত মহামূল্য রথে আরোহণপূর্ব্বক শারদমেঘসদৃশ [শরৎকালের মেঘতুল্য] পূর্ব্বদেশীয় সেনাগণের অগ্রগ [অগ্রগামী] হইয়া শক্রসমূহের অভিমুখে গমন করিলেন; অঙ্গপতি বৃষকেতু ও মহানুভব কৃপাচাৰ্য্য সেই সৈন্যগণের রক্ষা করিতে লাগিলেন। অতি যশস্বী জয়দ্ৰথ রাজতময় বরাহকেতু[শূকরচিহ্ন]দ্বারা শোভা পাইতে লাগিলেন; শতসহস্র রথ, অষ্টসহস্ৰ হস্তী ও ছয়-অযুত অশ্বারোহী তাঁহার বশবর্ত্তী ছিল; তিনি অগ্রে অবস্থানপূর্ব্বক অনন্তরথনাগাশ্বসঙ্কুল [অগণিত রথ, গজ ও অশ্বগণযুক্ত] মহৎ সৈন্য রক্ষা করিতে লাগিলেন। কলিঙ্গরাজ ষষ্টিসহস্র রথ এবং যন্ত্র, তোমার, তূণীর ও পতাকপরিশোভিত পর্ব্বতসঙ্কাশ অযুত নাগ, পাবকধ্বজ, শ্বেতচ্ছত্র, উরোভূষণ [বক্ষের অলঙ্কার], চামর ও ব্যজনে শোভমান হইয়া গমন করিলেন। মহাবীর কেতুমান বিচিত্র অঙ্কুশযুক্ত মাতঙ্গে আরোহণ করিয়া মেঘারূঢ় ভানুমানের [সূৰ্য্যের] ন্যায় তাঁহার সমভিব্যাহারে গমন করিলেন। তেজস্বী ভগদত্তও দেবরাজের ন্যায়। সেই হস্তীতে আরোহণ করিলে তাঁহার সদৃশ ও কেতুমানের সমকক্ষ বিন্দ ও অনুবিন্দ গজস্কন্ধে সমারাঢ় হইলেন। আচাৰ্য্য দ্রোণ, পিতামহ ভীষ্ম, অশ্বত্থামা, বাহুক ও কৃপাচাৰ্য্যকর্ত্তৃক বিরচিত ব্যূহ হস্তিরূপ অঙ্গ, ভূপালরূপ মস্তক ও অশ্বরূপ পক্ষে সুশোভিত হইয়া যেন হাস্য করিতে করিতে গমন করিতে [পাখীর ন্যায় উৰ্দ্ধে উৎপতিত হইতে] লাগিল।”