২২. ভীমসহ জরাসন্ধের যুদ্ধ

ভীমসহ জরাসন্ধের যুদ্ধ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, তখন যদুবংশাবতংস সুবক্তা বাসুদেব যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় মহারাজ জরাসন্ধকে কহিলেন, “হে রাজন্‌! আমাদের তিনজনের মধ্যে কাহার সহিত যুদ্ধ করিতে তোমার অভিলাষ হয়, বল? কে যুদ্ধ করিতে সভূত হইবে?” মহাদ্যুতি জরাসন্ধ কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর ভীমসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে চাহিলেন।

ঐ সময়ে পুরোহিত রোচনা, মাল্য ও অন্যান্য মাঙ্গল্যদ্রব্যজাত এবং দুঃখমুর্চ্ছানিবারক অঙ্গদ ও ঔষধসমুদয় লইয়া সংগ্রামেচ্ছু জরাসন্ধের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। মহারাজ জরাসন্ধ যশস্বী ব্ৰাহ্মণ কর্তৃক কৃতস্বস্ত্যয়ন হইয়া ক্ষত্রধর্ম্মানুসারে বর্ম্ম পরিধান ও কিরীটি পরিত্যাগপূর্ব্বক কেশবন্ধনপূর্ব্বক বেগবান সমুদ্রের ন্যায় সমুত্থিত হইয়া ভমিসেনকে কহিলেন, “হে ভীম! আইস, তোমার সহিত যুদ্ধ করিব।” মহাতেজঃ জরাসন্ধ ভীমকে এই কথা বলিয়া, বলাসুর যেমন ইন্দ্রকে আক্রমণ করিয়াছিল, তদুপ বৃকোদরকে আক্রমণ করিলেন। মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেনও কৃষ্ণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া এবং তৎকর্তৃক কৃতস্বস্ত্যয়ন হইয়া যুদ্ধাভিলাষে জরাসন্ধের নিকট গমন করিলেন। এইরূপে সেই দুই নরশ্রেষ্ঠ বীরপুরুষ পরস্পর জিগীষাপরবশ হইয়া স্ব স্ব বাহুমাত্র অবলম্বনপূর্ব্বক উভয়ে মিলিত হইলেন। প্রথমে তাহারা করগ্রহণপূর্ব্বক পদাভিবান্দন করিয়া কক্ষাস্ফোটন করিতে লাগিলেন এবং স্কন্ধে বারংবার করাঘাত ও অঙ্গে অঙ্গে সমাশ্লেষ করিয়া পুনরায় আস্ফালন করিতে লাগিলেন। পরে চিত্ৰহস্তাদি বিবিধ বন্ধন করিয়া কক্ষাবন্ধ করিলেন এবং পরস্পর ললাটে ললাটে এরূপ আঘাত করিলেন যে, উভয়ের ললাট হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিনির্গত ও ঘোরতর শব্দ হওয়াতে বোধ হইল যেন বজ্রাঘাত হইতেছে। অনন্তর বাহুপাশাদি বন্ধন করিয়া পরস্পর মস্তকে পদাঘাতপূর্ব্বক মত্তবারণের ন্যায় ও ঘনঘটার ন্যায় গভীর গর্জন এবং সুসংক্রুদ্ধ সিংহদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর নিরীক্ষণ, করপ্রহার ও বারংবার আকর্ষণ করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন; পরস্পর অঙ্গ ও বাহু দ্বারা অঙ্গ সমাপীড়ন ও বাহু দ্বারা উদর আবরণকরতঃ পরস্পরকে স্ব স্ব পশ্চাৎ ও পার্শ্বদেশে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন এবং স্ব স্ব কণ্ঠ, কক্ষ ও উদরে হস্তাস্ফালন করিতে লাগিলেন। তদনন্তর পরস্পর পৃষ্ঠভঙ্গ ও বাহুদ্বয় দ্বারা সম্পূর্ণ মূৰ্ছা এবং পুর্ণকুম্ভ [বাহুতে রজজুর মত পাক দেওয়া] প্রভৃতি করিলেন। তৎপরে তাহারা তৃণপীড় [মাথায় মুষ্টিপ্রহার], পূর্ণযোগ [অতর্কিত আঘাত] ও সমুষ্টিক প্রভৃতি নানাবিধ যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।

হে নরশ্রেষ্ঠ! তখন যাবতীয় পুরবাসী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য, শূদ্ৰ, বনিতা ও বৃদ্ধগণ তাঁহাদের সংগ্রাম দেখিতে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। যুদ্ধক্ষেত্ৰ জনতা দ্বারা সমাকীর্ণ হইল। মহাবীর জরাসন্ধ ও ভীমসেন পরস্পর নিগ্রহ ও প্রগ্রহ দ্বারা ভীষণ বাহুযুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। পরস্পর জয়াকাঙ্ক্ষী, পরম প্রহৃষ্ট, মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরষদ্বয় পরস্পরের ছিদ্রানুন্ধান করিতে লাগিলেন। হে রাজন! বীরদ্বয়ের বৃত্ৰবাসবসদৃশ ভয়ানক তুমুল সংগ্রামে অন্যান্য লোক অপসারিত হইল। তাহারা প্রকর্ষণ, আকর্ষণ, অনুকর্ষণ ও বিকর্ষণ দ্বারা পরস্পরকে আক্রমণ ও জানু দ্বারা আঘাত করিতে লাগিলেন; তদনন্তর কঠোরশব্দে ভৎসনা করিয়া প্রস্তরাঘাতসদৃশ মুষ্টিপ্ৰহারে অভিঘাত করিতে লাগিলেন। উভয়েই বিস্তৃতবক্ষা, উভয়েই দীৰ্ঘবাহু, উভয়েই যুদ্ধকুশল; সুতরাং উভয়ে উভয়কে লৌহার্গলসদৃশ বাহু দ্বারা সংসক্ত করিলেন। দুই মহাত্মার যুদ্ধ কার্তিক মাসের প্রথম দিবসে আরম্ভ হইয়া অনাহারে অবিশ্রান্ত ত্ৰয়োদশ দিবস দিবারাত্রি সমভাবে চলিয়াছিল। চতুর্দশ দিবসে রাত্ৰিতে মগধরাজ ক্লান্ত হইয়া নিবৃত্ত হইলেন। বাসুদেব জরাসন্ধকে ক্লান্ত দেখিয়া ভীমকর্ম্মা ভীমসেনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! ক্লান্ত শত্রুকে পীড়ন করা উচিত নহে, অধিকতর পীড্যমান হইলে জীবন পরিত্যাগ করে; অতএব ইনি তোমার পীড়নীয় নহেন। হে ভারতীৰ্ষভ! ইঁহার সহিত বাহুযুদ্ধ কর।” শত্রুনিসূদন ভীম কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া দুৰ্জয় জরাসন্ধকে তদবস্থ জানিয়া তাহাকে জয় করিবার নিমিত্ত অধিক কোপাবিষ্ট হইলেন।