০০৬. পর্ব্বতাদিদ্বারা জম্বুদ্বীপের পরিচয়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

পর্ব্বতাদিদ্বারা জম্বুদ্বীপের পরিচয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি দ্বীপের বিষয় সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিলে; এক্ষণে উহা বিস্তৃতরূপে বর্ণন কর। তুমি সকল বিষয়েরই তত্ত্বজ্ঞ; অতএব শশস্থানে যেসমস্ত ভূভাগ পরিদৃশ্যমান হয়, তাহার পরিমাণ কীৰ্তন করিয়া পরিশেষে পিপ্পলস্থানের বিষয় বর্ণনা করিবে।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! হিমালয়, হেমকূট, নিষধ, বৈদূৰ্য্যমণিময় নীল, শশিসঙ্কাশ [চন্দ্ৰতুল্য কান্তি] শ্বেত ও সর্ব্বধাতুসম্পন্ন শৃঙ্গবান [শৃঙ্গযুক্ত] এই ছয়টি পর্ব্বত একাকার; এই সকল পর্ব্বত পূর্ব্বসমূদ্র হইতে পশ্চিমসমুদ্ৰ পর্য্যন্ত বিস্তৃত; তথায় সিদ্ধ ও চারণগণ নিরন্তর অবস্থান করিতেছেন। এই ছয় পর্ব্বত সহস্ৰ-সহস্ৰ যোজন [চারি ক্ৰোশে এক যোজন] অন্তরে অবস্থিত; তন্মধ্যে নানা জনপদ প্রতিষ্ঠিত ও সকলপ্রকার প্রাণী অধিষ্ঠিত আছে; ইহাই ভারতবর্ষ [সর্ব্বত্র বর্ষশব্দ স্থানবাচক]। হিমালয়ের উত্তরে হৈমবতবর্ষ ও হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। নীলপর্ব্বতের দক্ষিণ ও নিষধগিরির উত্তরে মাল্যবানপর্ব্বত; উহা পূর্ব্বসমুদ্র হইতে পশ্চিমসমুদ্ৰ পর্য্যন্ত বিস্তীর্ণ হইয়া আছে। তদ্রুপে গন্ধমাদনপর্ব্বতও নীলপর্ব্বতের দক্ষিণ এবং নিষধপর্ব্বতের উত্তরে অবস্থিত হইয়া পূর্ব্বসমূদ্র হইতে পশ্চিমসমূদ্র পৰ্য্যন্ত বিত্তীর্ণ রহিয়াছে। নবোদিত সূৰ্য্যের ন্যায় নিতান্ত সমুজ্জ্বল, ধূমহীন অগ্নির ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন, সুবৰ্ণময় সহস্ৰ-সহস্ৰ যোজন বিত্তীর্ণ সুমেরুগিরি নীল ও নিষধপর্ব্বতের মধ্যে অবস্থিত আছে। উহা ভূগর্ভে ষোড়শ যোজন প্রবিষ্ট ও ঊৰ্দ্ধে চতুরশীতি যোজন উন্নত; লোকসমুদয় উহার ঊৰ্দ্ধ, অধ্য ও পার্শ্বপ্রদেশ আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতেছে। ভদ্রাশ্ব, কেতুমাল, জম্মু ও উত্তরকুরু—এই চারিটি দ্বীপ ইহার পার্শ্বদেশে প্রতিষ্ঠিত আছে। পুণ্যশীল ব্যক্তিরা উত্তরকুরুদ্বীপে সুরম্য আশ্রয়সকল নির্ম্মাণ করিয়াছেন। একদা পক্ষিরাজ গরুড়ের আত্মজ সুমুখ সুমেরুপর্ব্বতে সুবৰ্ণময় পক্ষিসকল নিরীক্ষণ করিয়া চিন্তা করিল, এই সুমেরুপর্ব্বতে পক্ষিগণের কিছুমাত্র ইতরবিশেষ নাই; উত্তম, মধ্যম ও অধম সকলেই একপ্রকার; অতএব ইহা পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। এই বিবেচনায় উহা পরিত্যাগ করিয়া উত্তর-কুরুতে গমন করিল। জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর প্রধান সূৰ্য্যদেব, চন্দ্ৰমা, নক্ষত্রগণ ও দক্ষিণানিল নিরন্তর মেরু প্ৰদক্ষিণ করিতেছেন। তথায় বৃক্ষসকল ফল-পুষ্পে সুশোভিত, প্রাসাদ সমুদয় সুবৰ্ণে অলঙ্কৃত, দেবতা, গন্ধর্ব্ব, অসুর, অপ্সরা ও রাক্ষসগণ সর্ব্বদা তথায় বিহার করিয়া থাকেন। ব্ৰহ্মা, রুদ্র ও সুররাজ ইন্দ্র-ইঁহারা তথায় সমবেত হইয়া বহুদক্ষিণ [প্রচুর দক্ষিণাসাধ্য] বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেন; তৎকালে তুম্বুরু [২], নারদ, বিশ্বা[৪]বসু ও হাহা[২-৫: ইহারা গন্ধর্ব্বগণের প্রধান] হুহু—ইঁহারা তথায় গমন করিয়া তাঁহাদিগকে স্তব করিয়া থাকেন। সপ্তর্ষিগণ ও প্রজাপতি কশ্যপ প্রতিপর্ব্বে তথায় গমন করেন। তাহার শৃঙ্গে দৈত্যগুরু শুক্র সতত বিহার করিয়া থাকেন এবং রত্নপর্ব্বতসকল তাঁহারই অধিকৃত। যক্ষাধিপতি কুবের সেই শুক্র হইতে রত্নের চতুর্থাংশ গ্রহণ করিয়া তাহার ষোড়শাংশ মনষ্যদিগকে প্ৰদান করেন।

“সুমেরুপর্ব্বতের উত্তরপার্শ্বে প্রস্তর স্তূপ হইতে সমুত্থিত, পুষ্পগুচ্ছে সুশোভিত, পরামরমণীয় কর্ণিকার [সোঁদাল] বন বিরাজিত রহিয়াছে। তথায় ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতি পার্ব্বতীসমভিব্যাহারে চরণাবিলম্বিনী [পদ পৰ্য্যন্ত বিলম্বিতা] কণিকারময়ী মালা ধারণপূর্ব্বক ভূতগণপরিবৃত হইয়া বিহার করিতে থাকেন; তাঁহার নেত্রত্ৰয় উদিত দিবাকরের ন্যায় সাতিশয় সমুজ্জ্বল। সত্যবাদী তপঃপরায়ণ সিদ্ধগণ সতত তাঁহাকে নিরীক্ষণ করেন; দুর্বৃত্ত ব্যক্তিরা কদাচ তাঁহাকে অবলোকন করিতে সমর্থ হয় না। সেই সুমেরুর শিখর হইতে সাধুজনসেবিতা, বিশ্বরূপ, অতি, পবিত্র, শুভ্রসলিলসম্পন্না, ভগবতী ভাগীরথী অনবরত অতি গভীর, ভয়ঙ্কর ঝর্ঝর-শব্দে মহাবেগে চন্দ্ৰমা’হ্রদে নিপতিত হইতেছেন। তাহা হইতেই সাগরসদৃশ ঐ মহাহ্রদ উৎপন্ন হইয়াছে। পর্ব্বতগণও যাঁহাকে ধারণ করিতে সমর্থ হয় নাই, ভগবান শূলপাণি সেই গঙ্গাকে শতসহস্ৰ বৎসর মস্তকে ধারণ করিয়াছেন। ;

“সুমেরুর পশ্চিমপার্থে কেতুমলনামে এক মহাজনপদ আছে। তত্ৰত্য পুরুষসকল সুবর্ণবর্ণ ও নারীগণ অপ্সরাসদৃশ; তাঁহাদিগের রোগ-শোকের সম্পর্ক নাই; তাহারা দশসহস্ৰ বৎসর জীবিত থাকিয়া নিরন্তর সন্তুষ্টমনে কালযাপন করে। যক্ষরাজ কুবের রাক্ষসগণসমভিব্যাহারে অপ্সরাগণপরিবৃত হইয়া তৎসন্নিহিত গন্ধমাদনশৃঙ্গে বিহার করিয়া থাকেন। গন্ধমাদনের উত্তরপার্শ্বে বহুসংখ্যক গণ্ডশৈল [পর্ব্বতপার্শ্বস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব্বত] আছে; তত্ৰত্য পুরুষগণ কৃষ্ণবর্ণ, মহাবলপরাক্রান্ত ও তেজস্বী; মহিলাসকল পদ্মবৰ্ণ এবং প্রিয়দর্শন; একাদশসহস্ৰ বৎসর তাহাদিগের পরমায়ু। হিমালয়পর্ব্বতের দক্ষিণে ভারতবর্ষ, উত্তরে হৈমবতবৰ্ষ, হেমকূটপর্ব্বতের উত্তরে হরিবর্ষ, নিষধপর্ব্বতের উত্তরে ইলাবৃতবৰ্ষ, নীলপর্ব্বতের উত্তরে শ্বেতবৰ্ষ, শ্বেতপর্ব্বতের উত্তরে হৈরণ্যকবর্ষ, তাহার পর ঐরাবতবৰ্ষ—এই সাতটি বর্ষ শরাসনাকার [ধনুকের আকৃতি] ধারণ করিয়া ভূপৃষ্ঠে সন্নিবেশিত আছে। এই সমস্ত বর্ষের গুণ এবং প্রাণীগণের আয়ুঃপরিমাণ, স্বাস্থ্য, ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম, উত্তরোত্তর উৎকৃষ্ট; তত্ৰত্য প্ৰাণীসকল সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করিতেছে। হে মহারাজ! এই পৃথিবী এইরূপ বহুদিন পর্ব্বতদ্বারা ব্যাপ্ত রহিয়াছে। হেমকূটকৈলাসনামে রমণীয় অতিবিশাল এক পর্ব্বত আছে; তথায় যক্ষরাজ কুবের গুহ্যকদিগের সহিত বিহার করেন। হেমকূটকৈলাসের উত্তরে মৈনাকপর্ব্বতসন্নিহিত হিরণ্যশৃঙ্গনামে অতি বৃহৎ মণিময় এক পর্ব্বত আছে; তাহার পার্শ্বে কাঞ্চনময়বালুকপরিশোভিত অতিরমণীয় বিন্দুসরনামে সরোবর সন্নিবেশিত রহিয়াছে; তথায় মহারাজ ভগীরত ভগবতী গঙ্গার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া বহু বৎসর বাস করিয়াছিলেন; সেই সরোবরতীরে মণিময় যূপ ও হিরন্ময় চৈত্য[যজ্ঞীয় যূপ—পশুবন্ধনের খোঁটা]সকল নিখাত [মৃত্তিকায় পোঁতা] আছে; দেবরাজ ইন্দ্ৰ তথায় যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। তথায় সর্ব্বলোকস্রষ্টা অমিততেজঃ [অতুলনীয়তেজোযুক্ত] ভগবান ভূতপতি রুদ্র অখিলালোককর্ত্তৃক উপাসিত হইয়া থাকেন; সেই স্থানে নরনারায়ণ, ব্ৰহ্মা, মনু ও স্থাণু, ইঁহারা বিরাজ করেন। ত্ৰিপথগামিনী গঙ্গা ব্ৰহ্মলোক হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া প্রথমে এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন; পরে বস্বোকসারা, নলিনী, সরস্বতী, জম্বুনদী, সীতা, গঙ্গা ও সিন্ধু—এই সাতটি ধারায় বিভক্ত হইয়া প্রবাহিত হয়েন। এইসকল ধারা অচিন্ত্যনীয় ও দিব্যগুণসম্পন্না; যুগ-প্রলয়ের অবসানে এই স্থানে ঋষি ও ইন্দ্ৰাদি দেবগণ যজ্ঞানুষ্ঠান করেন। পূর্বোক্ত সাতটি দিব্যগঙ্গা ত্ৰিলোকে বিশ্রুত আছেন; তন্মধ্যে সরস্বতী কোন কোন স্থানে দৃশ্যা ও কোন কোন স্থানে অদৃশ্যা হইয়া থাকেন।

“হিমাচলে রাক্ষস, হেমকূট গুহ্যক, নিষধে সর্প ও নাগ, গোকর্ণে তপোধন, শ্বেতপর্ব্বতে সমস্ত দেবাসুর, নিষধে গন্ধর্ব্ব ও নীলপর্ব্বতে ব্ৰহ্মর্ষিগণ বাস করিয়া থাকেন। শৃঙ্গবানপর্ব্বত দেবগণের বিচরণ-স্থান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। হে রাজন! যে সাতটি বর্ষ কীর্ত্তন করিলাম, তাহাতে স্থিতিশীল বৃক্ষাদি ও গতিশীল পশু, পক্ষী, মানব প্রভৃতি প্ৰাণীসমুদয় প্রতিষ্ঠিত আছে, তাহাদিগের দৈবী ও মানুষী সমৃদ্ধি বিবিধ প্রকার; উহা নির্ণয় করা নিতান্ত দুষ্কর, কিন্তু মঙ্গলার্থী ব্যক্তির তদ্বিষয়ে শ্রদ্ধা করা একান্ত বিধেয়। হে রাজন! আপনি যে শশস্থানের বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। শশস্থানের উত্তর ও দক্ষিণপার্শ্বে দুইটি বর্ষ আছে; নাগদ্বীপ ও কাশ্যপদ্বীপ শশস্থানের কর্ণস্বরূপ; হে রাজন! তামার পাতের ন্যায় শিলাসংযুক্ত সুশোভিত৷ যে মলয়পর্ব্বত আছে, তাহা জম্বুদ্বীপস্থ শশস্থানের দ্বিতীয় অবয়বস্বরূপে দৃষ্ট হইয়া থাকে।”