৫০. কর্ণের প্রতি অশ্বত্থামার আক্রোশ

৫০তম অধ্যায়

কর্ণের প্রতি অশ্বত্থামার আক্রোশ

অশ্বত্থামা কহিলেন, “হে কৰ্ণ! গোধন সকল এখনও পরাজিত ও বারণাবত-নগরে নীত হয় নাই, তাহারা স্বস্থানেই অবস্থান করিতেছে, তথাপি তুমি কি নিমিত্ত এরূপ অহঙ্কার প্রকাশ করিতেছ? মহাবল পরাক্রান্ত মনুষ্যেরা বহুতর যুদ্ধে জয়লাভ ও প্রভূত অর্থ সংগ্ৰহ করিয়াও কদাচ আস্ফালন করেন না। হুতাশন তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক সমস্ত বস্তু দগ্ধ করিয়া থাকেন, দিবাকর মূক হইয়া স্বীয় প্রখর করজাল বিস্তার করনে, অবনী মমৌনাবলম্বন করিয়া এই সচরাচর লোক-সকল ধারণ করিয়া আছেন। বিধাতা চাতুর্ব্বর্ণ্যের বিশেষ বিশেষ বৃত্তিবিধান করিয়া দিয়াছেন; ব্রাহ্মণের স্বাধ্যায়সম্পন্ন হইয়া সর্ব্বদা যজন ও যাজনকাৰ্য্যে নিযুক্ত হইবেন; ক্ষত্ৰিয়েরা শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করিবেন, কদাচ যাজনকর্ম্মে প্রবৃত্ত হইবেন না; বৈশ্যেরা অর্থলাভ করিয়া ব্ৰাহ্মণেরই কাৰ্য্যসাধন করিবেন এবং শূদ্রেরা কপটতাশূন্য হইয়া বিনীতভাবে নিরন্তর বর্ণত্রয়ের শুশ্রূষায় নিরত হইবেন; অতএব বিধিবিহিত স্ব স্ব ব্যবসায়সুলভ অর্থলাভ করিলে কদাচ দূষিত হইতে হয় না। মহানুভব পুরুষেরা ধর্ম্মানুসারে এই সসাগরা পৃথিবী হস্তগত করিয়া গুণবিহীন গুরুজনেরও অবমাননা করেন না।

“এই নৃশংস ও নির্ঘৃণ্য দুৰ্য্যোধনের ন্যায় কোন ক্ষত্ৰিয় কপটদ্যুত দ্বারা রাজ্যলাভ করিয়া সন্তুষ্ট হইতে থাকেন এবং কোন ব্যক্তি বৈতংসিকের [জালিক—পক্ষীদিগকে প্রলুব্ধ করিয়া যাহারা জালে আবদ্ধ করে] ন্যায় ছলনা ও প্রতারণা দ্বারা অর্থ সংগ্ৰহ করিয়া আত্মশ্লাঘা করে? এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, তুমি যাহাদিগের ধনাপহরণ করিয়াছিলে, সেই মহারথ পাণ্ডবগণকে কোন দ্বৈরথযুদ্ধে [অন্যের অপেক্ষা না করিয়া দুইজন রথীর পরস্পর যুদ্ধ] পরাজয় করিয়াছ? কোন যুদ্ধে ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ অধিকার করিয়াছ এবং কোন যুদ্ধেই বা একবস্ত্রা রাজস্বলা পতিব্ৰতা দ্রৌপদীকে জয় করিয়া সভায় আনয়ন করিয়াছিলে? তোমরা পূর্ব্বে যে সমস্ত দুষ্কর্ম্ম করিয়াছ, তাহাই এই অনর্থের মূল, কিন্তু মহাত্মা বিদুর এ বিষয়ে তোমাদিগকে যাহা কহিয়াছিলেন, তাহাও তোমরা অগ্রাহ্য করিয়াছ, এই নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সহিত সৌহার্দ্দভঙ্গ হইয়াছে। মনুষ্যদিগের শক্তি অনুসারে শান্তি অবলম্বন করাই বিধেয়।

‘অর্জ্জুন দ্রৌপদীর সেই সকল ক্লেশ কদাচ সহ্য করিবে না। সে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের বিনাশসাধনের নিমিত্তই প্রাদুর্ভূত হইয়াছে। তুমি বিজ্ঞ হইয়া কি কারণে এ বিষয়ের উল্লেখ করিতেছ? মহাবীর অর্জ্জুন আমাদিগকে সংহার করিয়া অবশ্যই বৈরানির্যাতন করবে। সে রণস্থলে দেব, গন্ধর্ব্ব, অসুর বা রাক্ষসভয়ে কদাচ ভীত হয় না। খগরাজ গরুড় মহাবেগে পতিত হইবামাত্র যেমন মহীরুহ উন্মলিত হয়, তদ্রূপ সে ক্রোধাভরে সংগ্রামে যাহাকে আক্রমণ করিবে, সে তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হইবে, সন্দেহ নাই। অর্জ্জুন বলবীৰ্য্যে তোমা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, ধনুবিদ্যায় দেবরাজসদৃশ ও যুদ্ধে বাসুদেবতুল্য; অতএব কে তাঁহাকে প্রশংসা না করিবে? তাঁহার সমান বীরপুরুষ ভূমণ্ডলে আর দৃষ্টিগোচর হয় না, সে দৈববলে দেবগণের সহিত ও বাহুবলে মানবগণের সহিত সংগ্ৰাম করে এবং অস্ত্ৰ দ্বারা অস্ত্ৰ-সকল প্রতিহত করিতে পারে।

“শিষ্যের প্রতি আচাৰ্য্যের অপত্যস্নেহ হইয়া থাকে, এই নিমিত্ত অর্জ্জুন দ্রোণাচাৰ্য্যের নিতান্ত প্রিয়পাত্ৰ হইয়াছে; তুমি যেরূপ দূতক্ৰীড়া করিয়াছিলে, যেরূপে ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ অধিকার করিয়াছিলে ও যেরূপে দ্রৌপদীকে সভায় আনয়ন করিয়াছিলে, এক্ষণে সেইরূপে তোমাকে অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে। তোমার মাতুল ক্ষাত্রধর্ম্মকোবিদ কপটদ্যুতবেদী গান্ধাররাজ শকুনি এখন যুদ্ধ করুন। অর্জ্জুনের গান্তীব-পাশক দিক্ [] বা চতুষ্ক [পাশা ক্ষেপণে যেমন পোয়া, দুয়া, ত্রি, চৌকা ফেলার চতুরতা, বাণিক্ষেপে তাহা নহে] নিক্ষেপ করে না, উহা কেবল অনবরত প্রজ্বলিত সুতীক্ষ্ন শর-সমূহ বর্ষণ করিয়া থাকে। অর্জ্জুনের নিদারুণ শরজাল গাণ্ডীব-বিনির্মুক্ত হইয়া পর্ব্বত বিদারণপূর্ব্বক গমন করিতে পারে। পবন, অন্তক ও অগ্নি, ইঁহারা কদাচ সমস্ত বস্তু বিনষ্ট করিতে সমর্থ হয়েন না, কিন্তু ধনঞ্জয় ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া সকলেরই বিনাশসাধন করিতে পারেন। তুমি সভামধ্যে শকুনির সাহায্যলাভ করিয়া যেরূপে দূতক্ৰীড়া করিয়াছিলে, এক্ষণে শকুনি কর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া সেইরূপে অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ কর। এই যুদ্ধে অন্য যোদ্ধাসকল গমন করুন। আমি কখনই অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিব না। যদি মৎস্যরাজ এই গোষ্ঠে আগমন করেন, তাহা হইলে আমি যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইব।”