০৪. পাণ্ডবগণের প্রতি ধৌম্যবর্ণিত রাজগৃহবাসের উপযোগী উপদেশ

৪র্থ অধ্যায়

পাণ্ডবগণের প্রতি ধৌম্যবর্ণিত রাজগৃহবাসের উপযোগী উপদেশ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “তোমরা বিরাট-রাজ্যে যে সমস্ত কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিবে, তাহা কহিলে; আমিও স্বয়ং যাহা করিব, তাহা কহিয়াছি। এক্ষণে পুরোহিত ধৌম্য দ্ৰৌপদীর পরিচারিকা, সূত ও পৌরোগবগণ সমভিব্যাহারে দ্রুপদরাজভবনে গমনপূর্ব্বক আমাদিগের অগ্নিহোত্র রক্ষা করুন এবং ইন্দ্ৰসেন প্রভৃতি সকলে রথ লইয়া অবিলম্বে দ্বারকা নগরীতে গমন করুন। কেহ জিজ্ঞাসা করিলে সকলেই কহিবেন যে, পাণ্ডবেরা আমাদিগকে দ্বৈতবনে পরিত্যাগ করিয়া তথা হইতে যে কোথায় প্রস্থান করিয়াছেন, আমরা তাহা বিন্দু-বিসর্গও অবগত নহি।”

অনন্তর পাণ্ডবেরা পরস্পর এইরূপ অবধারিত করিয়া পুরোহিত ধৌম্যকে আমন্ত্রণ করিলেন। তখন মহর্ষি ধৌম্য তাঁহাদিগকে সস্নেহসম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে পাণ্ডবগণ! তোমরা ব্রাহ্মণ, সুহৃদ, যান, প্রহরণ ও অগ্নিবিষয়ক কর্ত্তব্য অবধারণ করিয়া দিলে; এক্ষণে যাহা কহিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও অর্জ্জুনকে সতত দ্রৌপদীর রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে। তোমরা লোকবৃত্তান্ত সমস্তই জ্ঞাত আছ, কিন্তু বিদিত বিষয়েও উপদেশ প্রদান করা সুহৃদ্বর্গের অবশ্য কর্ত্তব্য। লোকে ইহাকেই সনাতন ধর্ম্ম ও অর্থ-কাম বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকে, এই নিমিত্ত আমি তোমাদিগের ইতিকর্ত্তব্যতা নির্দেশ করিয়া দিতেছি, শ্রবণ কর।

“হে পাণ্ডবগণ! তোমরা রাজকুলে বাস করিবে, অতএব আমি রাজকুলের বিষয় উল্লেখ করিতেছি। যে ব্যক্তি রাজকুলের সমস্ত অবগত হইয়াছে, তথায় তাহাকেও অতি ক্লেশে কালযাপন করিতে হয়। তোমরা সম্মানিত হও বা অপমানিতই হও, যেরূপে হউক, ছদ্মবেশে তথায় এক বৎসর অতিক্রম করিবে। পরে চতুর্দ্দশ বৎসর সমুপস্থিত হইলে স্বেচ্ছানুসারে ব্যবহার করিতে পরিবে। হে পাণ্ডুনন্দনগণ! রাজভবনস্থ ব্যক্তির কোন বিষয়ে পৰ্য্যবেক্ষণ করিতে ইচ্ছা হইলে, অগ্ৰে ভূপালের অনুমতি লইবে; রহস্য বিষয়ে কাহাকেও বিশ্বাস করিবে না এবং যথায় অন্যে পরাভব করিতে না পারে, এইরূপ স্থানে অবস্থান করিবে। যে ব্যক্তি ‘আমি মহারাজের প্রিয়’ এই মনে করিয়া তদীয় যান, পর্য্যঙ্ক, পীঠ, গজ বা রথে আরোহণ না করেন, তিনিই রাজগৃহে বাস করিতে সমর্থ হয়েন। যথায় উপবিষ্ট হইলে দুষ্ট লোকেরা আশঙ্কা করিবে, তথায় কদাচ উপবেশন করিবে না। ভূপাল জিজ্ঞাসা না করিলে তাঁহাকে কোন বিষয়ে অনুশাসন করা অকর্ত্তব্য এবং মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক তাঁহার আরাধনা ও অবসরক্রমে সমুচিত সৎকার করা বিধেয়। নৃপতিগণ অনূতবাদী মনুষ্যের প্রতি সঙ্গতত ঈৰ্ষা প্ৰকাশ ও মিথ্যাভাষী মন্ত্রীকে নিয়ত অবমাননা করিয়া থাকেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কদাচ রাজমহিষী, অন্তঃপুরচারী, রাজার দ্বেষ্য ও তাঁহার অহিতকারী ব্যক্তিগুণের সহিত মৈত্রী করবেন না। রাজার সমক্ষে সামান্য কাৰ্য্যও আগ্রহপূর্ব্বক সম্পাদন করিবে। এইরূপে রাজার পরিচর্য্যা করিলে কদাচ বিপদগ্ৰস্ত হইতে হয় না। উন্নত-পদপ্রাপ্ত ব্যক্তিও জিজ্ঞাসিত ও নিয়োজিত না হইলে স্বীয় মৰ্য্যাদানুরোধে জাত্যন্ধের [জন্মান্ধ] ন্যায় ব্যবহার করিবেন। পুত্র, পৌত্র বা ভ্ৰাতাও মৰ্য্যাদা অতিক্রম করিলে ভূপাল আর তাহাকে সমুচিত সমাদর করেন না। অগ্নি ও দেবতার ন্যায় রাজার উপাসনা করিবে। মিথ্যাবাদী মনুষ্যকে রাজা অবশ্যই বিনাশ করিয়া থাকেন। প্রমাদ, গর্ব্ব ও ক্ৰোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বামীর আজ্ঞানুবর্তী হইয়া কাৰ্য্য করিবে। কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নির্ণয়-স্থলে যাহা স্বামীর হিত ও প্রিয়কর মনে হয়, তাহাই বৰ্ণনা করিবে। যে স্থলে হিতকর প্রিয়বাক্য নিতান্ত দুর্লভ, সে স্থলে প্রভুর প্রিয়বাক্য উপেক্ষা করিয়া হিতবাক্য বলাই কর্ত্তব্য। কদাচ স্বামীবাক্যের প্রতিকূলাচরণ করিবে না এবং অপ্রিয় ও অহিত কথা তাহার নিকট বর্ণনা করিবে: না। পণ্ডিত ব্যক্তি আপনাকে প্রভুর অপ্রিয়পাত্ৰ মনে করিয়া তাহার সেবা করেন ও সর্ব্বদা অপ্ৰমত্ত-চিত্তে তাহার হিত ও প্রিয়কাৰ্য্যে তৎপর হয়েন। যে ব্যক্তি প্রভুর অনিষ্টচেষ্টা, তাঁহার অহিত্যাচারীদিগের সহবাস ও অনধিকারচর্চায় পরাঙ্মুখ হয়েন, তিনি রাজকুলে বাস করিবার উপযুক্ত পাত্রে। পণ্ডিতেরা রাজার দক্ষিণ অথবা বামপার্শ্বে উপবেশন করিবেন, অস্ত্রশস্ত্ৰধারী রক্ষকগণ তাঁহার পশ্চাদভাগে থাকিবে এবং সম্মুখে বিস্তীর্ণ আসন বিন্যস্ত থাকিলে তথায় উপবেশন করা নিষিদ্ধ।

“কোন গূঢ় বিষয় প্রত্যক্ষ হইলেও তাঁহা অন্যের নিকট ব্যক্ত করিবে না। তাহা হইলে সামান্য ব্যক্তিদিগেরও অবিশ্বাসভাজন হইতে হয়। রাজারা যদি মিথ্যাকথা বলেন, তাহা অন্যের নিকট কদাচ প্ৰকাশ করিবে না। তাঁহারা মিথ্যাবাদীর প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েন এবং পণ্ডিতভিমানী লোকদিগকে ঘৃণা করেন। “আমি বীর বা বুদ্ধিমান এই বলিয়া কদাচ রাজার নিকট গর্ব্ব প্রকাশ করিবে না। যিনি অপ্ৰমত্তচিত্তে সতর্কতাপূর্ব্বক রাজার প্রিয় ও হিতকাৰ্য্য করেন, তিনিই তাঁহার প্রণয়াস্পদ ও ঐশ্বৰ্য্যশালী হইয়া নানাবিধ ভোগসুখে কালব্যাপন করিতে পারেন। দেখ, যাঁহার কোপে অশেষ ক্লেশ এবং প্রসাদে মহাফললাভ হয়, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাঁহার অনভিমত কাৰ্য্যানুষ্ঠান করে?

“রাজসভায় স্থিরভাবে সমাসীন থাকিবে, হস্ত, পদ ও ওষ্ঠ প্রভৃতি সতত সঞ্চালন করিবে না; উচ্চৈঃস্বরে কথা কহিবে না এবং অতিগোপনে নিষ্টীবন ও বাতাদি পরিত্যাগ করিবে। কোন কোন প্রকার হাস্যের বিষয় উপস্থিত হইলে হৃষ্ট হইয়া অতি-হাস্য ও ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক হাস্যসংবরণ এই উভয়ই বিরুদ্ধ। অতিহাসে উন্মত্ততা ও হাস্যসংবরণে গাম্ভীৰ্য্যপ্রকাশ করা হয়, এই নিমিত্ত তৎকালে মৃদু হাস্য করা কর্ত্তব্য। যিনি লাভে হৃষ্ট ও অপমানে দুঃখিত হয়েন না এবং সর্ব্বদাই অপ্ৰমত্ত থাকেন, তিনিই রাজভবনের উপযুক্ত পাত্র। যে পণ্ডিত অমাত্য সর্ব্বদা রাজা ও রাজপুত্রের স্তব-স্তুতি করেন তিনি চিরকাল প্রিয়পাত্র হইয়া থাকেন। যে অনুগৃহীত অমাত্য কোন কারণবশতঃ নিগৃহীত হইয়াও রাজার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ না করেন, তিনি পুনরায় সম্পদলাভ করিতে পারেন। যিনি রাজার নিকট উপজীবিকা লাভ ও তাঁহার বিষয়ে বাস করেন, তিনি সতত ভূপতির সমক্ষে এবং পরোক্ষে তদীয় গুণানুবাদ করিবেন। যে অমাত্য বলপূর্ব্বক বিষয়ভোগ করিবার নিমিত্ত রাজার নিকট প্রার্থনা করেন, তিনি অচিরকালমধ্যে পদচ্যুত হয়েন এবং তাঁহার প্রাণসংশয় উপস্থিত হয়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি রাজকৃত উপকার সতত বিপক্ষের নিকট প্রকাশ করিবে না এবং রাজাকে সর্ব্বদা শিক্ষা-প্রদানে সমুদ্যত হইবে না। যে ব্যক্তি বলবান, আন্নান, সত্যবাদী, মৃদু ও শান্ত হইয়া সর্ব্বদা ছায়ার ন্যায় ভূপতির অনুগত হইতে পারেন তিনিই রাজকুলের উপযুক্ত। প্ৰভু অন্য ব্যক্তিকে কোনো কাৰ্য্যে নিয়োগ করিলে যিনি ‘কি করিব’ বলিয়া সেই কর্ম্মে অগ্রসর হয়েন, তিনিই রাজভবনে বাস করিবার যোগ্য পাত্ৰ। যিনি ভূপতি-কর্ত্তৃক গূঢ় বা প্রকাশ্য কাৰ্য্যে নিয়োজিত হইয়া তৎসাধনে পরাঙ্মুখ না হয়েন, তিনিই রাজগৃহে বাস করিবেন। যিনি প্রবাসিত হইয়া পরমপ্রণয়াস্পদ পুত্র, কলাত্র প্রভৃতি স্মরণ করেন না এবং সুখের নিমিত্ত দুঃখ সহ্য করিতে পারেন, তিনিই রাজগৃহে বাস করিবার উপযুক্ত। কদাচ রাজার সদৃশ বেশ-ভূষা করিবে না, তাহার সমীপে অতিহাস্য করিবে না এবং মন্ত্রণা বহু ব্যক্তির নিকট ব্যক্ত করিবে: না। অর্থস্পৃহা পরিত্যাগপূর্ব্বক কাৰ্য্য করবে। কারণ, কোন দ্রব্য অপহরণ করিলে বন্ধন অথবা প্ৰাণনাশ হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। প্ৰভু যান, বস্ত্ৰ, অলঙ্কার অথবা অন্য যে কোনো প্ৰসাদস্বরূপ প্ৰদান করিবেন, তাহাই সতত ধারণ করিবে। এইরূপে সাবধানে কালাতিপাত করিতে পারিলে রাজার প্রিয়পাত্র হওয়া যায়।

“হে পাণ্ডবগণ! সম্প্রতি তোমরা প্ৰযত্নাতিশয় সহকারে এইরূপে চিত্ত সংযত করিয়া আপনাদিগের সুশীলতা প্রদর্শনপূর্ব্বক বিরাট-নগরে সংবৎসরকাল অতিবাহিত কর। অনন্তর আপনাদিগের রাজ্য লাভ করিয়া স্বেচ্ছানুরূপ ব্যবহার করিবে।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দ্বিজসত্তম! আপনি যাহা আদেশ করিলেন, আমরা কদাচ তাহার অন্যথাচরণ করিব না। মাতা কুন্তী ও মহামতি বিদুর ভিন্ন আপনার ন্যায় সদুপদেষ্টা আর কেহই নাই। অতএব এক্ষণে আমরা কিরূপে এই দুঃখার্ণব উত্তীর্ণ হইব, কিরূপে প্ৰস্থান করিব ও কিরূপেই বা আমাদিগের জয়লাভ হইবে, তাহার উপায়বিধান করুন।”

দ্বিজোত্তম ধৌম্য যুধিষ্ঠির-কর্ত্তৃক এইরূপ উক্ত হইয়া প্রস্থানোচিত সমুদয় আয়োজন করিলেন এবং তাঁহাদিগের রাজ্যলাভ, সমৃদ্ধি ও বৃদ্ধির নিমিত্ত অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিয়া মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক আহুতি প্ৰদান করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবেরা সেই অগ্নি ও তপোধন ব্রাহ্মণদিগকে প্ৰদক্ষিণপূর্ব্বক দ্রৌপদীকে অগ্ৰে লইয়া প্ৰস্থান করিলেন। তাঁহারা গমন করিলে পর ধৌম্য অগ্নিহোত্ৰ গ্ৰহণ করিয়া পাঞ্চালনগরে উত্তীর্ণ হইলেন এবং ইন্দ্ৰসেন প্রভৃতি পূর্বোক্ত লোকেরা যাদবগণের নিকট গমনপূর্ব্বক সুসংবৃত হইয়া অশ্ব-রথ রক্ষা করিয়া পরম-সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।