৩৮. অর্জ্জুনসারথ্য উত্তরের যুদ্ধযাত্রা

৩৮তম অধ্যায়

অর্জ্জুনসারথ্য উত্তরের যুদ্ধযাত্রা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, তখন রাজকুমার অকুতোভয়ে রাজধানী হইতে বহির্গত হইয়া সারথিকে কহিলেন, “বৃহন্নলে! সত্বর কৌরবগণের সমীপে রথ উপনীত কর। আমি অবিলম্বে সেই দুরাত্মাদিগকে পরাজয় করিয়া গোধন গ্রহণপূর্ব্বক নগরে প্রত্যাগমন করিব।” অর্জ্জুন আজ্ঞা পাইবামাত্র দ্রুতবেগে অশ্বচালনা করিতে লাগিলেন। সুবৰ্ণভূষিত মারুতগামী তুরঙ্গগণ অতিবেগে ধাবমান হইল। বোধ হইতে লাগিল যেন, তাহারা আকাশমাগেই গমন করিতেছে।

তাঁহারা কিয়দ্দূর গমন করিয়া সেই শ্মশানসমীপস্থ শমীবৃক্ষের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তথা হইতে সাগরোপিম মহাবল কৌরবদল তাঁহাদিগের দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। সেই সকল সৈন্যগণের পাদাদ্ভূত পার্থিব রেণু নভোমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হওয়াতে বোধ হইল যেন, আকাশপথে একটি বহুলপাদপ মহারণ্য বিচরণ করিতেছে।

বিরাটতনয় কর্ণ, দুৰ্য্যোধন, কৃপাচাৰ্য্য, দ্রোণাচাৰ্য্য, অশ্বথামা ও ভীষ্ম প্রভৃতি বীরপুরুষগণে পরিরক্ষিত, গজশ্বরথসঙ্কুল সেই কৌরববাহিনী নিরীক্ষণ করিয়া রোমাঞ্চিত—কলেবর ও ভয়োদ্বিগ্নচিত্তে পার্থিকে কহিলেন, “সারথে! কৌরবদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে আমার সাহস হয় না। এই দেখ, আমার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়াছে। বহুবীরপরিরক্ষিত ভয়ঙ্কর কুরুসৈন্য দেবগণেরও দুরভিগম্য। অতএব আমি কিরূপে এই ভীমকামুকশালিনী পত্তিধ্বজসমাকীর্ণ রথনাগাশ্বসঙ্কুলা ভারতী সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইব? দ্রোণ, কৰ্ণ, বিকৰ্ণ, বিবিংশতি, ভীষ্ম, কৃপ, অশ্বত্থামা, সোমদত্ত, বাহ্লীক ও দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি যুদ্ধবিশারদ বীরপুরুষেরা ধনুৰ্দ্ধারণপূর্ব্বক নিরন্তর যাহাদিগকে রক্ষা করিতেছেন, তাহাদিগের সহিত যুদ্ধকরা দূরে থাকুক, দেখিবামাত্র আমার হৃদয় কম্পিত, অন্তঃকরণ নিরুৎসাহ ও শরীর অবসন্ন হইতেছে।”

রাজপুত্ৰ উত্তর সুচতুর অর্জ্জুনের বল-বিক্রম পরিজ্ঞাত ছিলেন না, সুতরাং তিনি মূর্খতা প্রযুক্ত তাঁহার নিকট আক্ষেপ প্রকাশ্যপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “বৃহন্নলে! পিতা আমাকে শূন্যগৃহে রাখিয়া সমস্ত সৈন্যসামন্তসমভিব্যাহারে ত্ৰিগর্ত্তদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে গমন করিয়াছেন। আমি একাকী, বালক, বিশেষতঃ পরিশ্রমে অপটু; কৌরবেরা কৃতান্ত্র ও বহুসংখ্যক; উহাদিগের সহিত আমার যুদ্ধ করা কোনক্রমেই যুক্তিসিদ্ধ নহে; অতএব তুমি প্রতিনিবৃত্ত হও।”

কৌরবদর্শনে ভীত উত্তরের প্রতি অর্জ্জুনের উৎসাহ প্ৰদান

বৃহন্নলা কহিলেন, “মহাশয়! এক্ষণে কাতর হইয়া শত্ৰুগণের হৰ্ষবৰ্দ্ধন করিতেছেন কেন? শত্রুগণ এমন কি কর্ম্ম করিয়াছে যে, আপনি এত ভীত হইলেন? আপনি পূর্ব্বে আমাকে কৌরবসেনামধ্যে লইয়া যাইতে আদেশ করিয়াছেন; অতএব আমি আপনাকে গোধনাপহারী আততায়ী কৌরবগণের সমীপে লইয়া যাইব। মহাশয়! যাত্রাকালে স্ত্রীপুরুষগণসমক্ষে তাদৃশ গর্ব্ব প্রকাশ করিয়াছিলেন, এক্ষণে কি নিমিত্ত যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হইতেছেন? যদি গোধন জয় না করিয়া গৃহে প্রতিনিবৃত্ত হয়েন, তাহা হইলে সমুদয় স্ত্রী-পুরুষ, বিশেষতঃ বীরগণ একত্রিত হইয়া আপনাকে উপহাস করিবে। অতএব আপনি ধৈৰ্য্যাবলম্বন করুন। সৈরিন্ধ্রী সর্ব্বসমক্ষে মুক্তকণ্ঠে আমার সারথ্যকাৰ্য্যের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত আমি ধেনু না লইয়া কোনক্রমেই গৃহে গমন করিতে পারিব না। আমি সৈরিন্ধ্রীর স্তুতিবাদে, উত্তরার অনুরোধে ও আপনার আদেশক্রমে আগমন করিয়াছি। অতএব কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ না করিয়া কিরূপে ক্ষান্ত হইব?”

উত্তর কহিলেন, “বৃহন্নলে! কৌরবগণ আমাদিগের যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করুক, আবালবৃদ্ধ-বনিতা সকলেই আমাকে উপহাস করুক, সমুদয় গোধন অপহৃত ও নগর শূন্য হউক বা পিতা আমাকে তিরস্কার করুন, আমি কোনক্রমেই যুদ্ধ করিতে পারিব না।” বিরাটতনয় এই কথা বলিয়া যৎপরোনাস্তি ভীত হইয়া ধনুর্ব্বাণের সহিত মান ও দৰ্পে জলাঞ্জল দিয়া রথ হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিলেন।

তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “মহাশয়! যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হওয়া ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম্ম নহে; ভীত হইয়া পলায়ন করা অপেক্ষা সমরে মরণও শ্রেয়স্কর।” মহাবীর ধনঞ্জয় এই কথা বলিয়া সত্বর রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক পলায়মান রাজপুত্রের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। গতিবেগে তাহার সুদীর্ঘ বেণী আলুলায়িত এবং বসনযুগল শিথিল ও ইতস্ততঃ বিধূয়মান [সঞ্চালিত] হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে কৌরবপক্ষীয় কতিপয় সৈনিক পুরুষ হাস্য করিয়া উঠিল।

ছদ্ম সারথিকে অর্জ্জুনজ্ঞানে কৌরববিমর্ষ

কৌরবেরা তথাবিধ অদ্ভূতরূপ দ্রুতপদগামী অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া বিতর্ক করিয়া কহিতে লাগিলেন, “ভম্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় ছদ্মবেশী এ ব্যক্তি কে? ইহার অবয়বের কিয়দংশ পুরুষের ন্যায় ও কিয়দংশ স্ত্রীলোকের ন্যায় দেখিতেছি। এ ক্লীবরূপী, কিন্তু ইহাতে অর্জ্জুর সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য লক্ষিত হইতেছে। ইহার মস্তক, গ্ৰীবা, বিশাল বাহুযুগল ও বলবিক্ৰম অবিকল অর্জ্জুনের ন্যায়। অতএব নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, এ ধনঞ্জয়, অন্য কেহ নহে। যেমন সুররাজ সমস্ত অমরগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সেইরূপ অর্জ্জুন ও সমুদয় মানবের প্রধান। সে ব্যতীত একাকী আমাদিগের সম্মুখীন হয়, এমন বীর ধরাতলে আর কে আছে? বোধ হয়, বিরাট-তনয় একাকী পুরমধ্যে বাস করিতেছিল, সে বালস্বভাব-নিবন্ধন স্বীয় পুরুষকার বিবেচনা করিতে না পারিয়া প্রচ্ছন্নবেশী অর্জ্জুনকে সারথি করিয়া যুদ্ধে আগমন করিয়াছে, এক্ষণে আমাদিগকে দেখিয়া ভয়ে পলায়ন করিতেছে, অর্জ্জুন উহাকে ধারণ করিবার নিমিত্ত উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইতেছে।”

কৌরবেরা ছদ্মবেশী অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া সকলেই এইরূপ বিতর্ক করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুই নিশ্চয় করিতে পারিলেন না।

এ দিকে অর্জ্জুন শতপদমাত্র গমন করিয়া পলায়মান উত্তরের কেশ ধারণ করিলেন। তখন বিরাটতনয় নিতান্ত কাতরতা প্রকাশপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “বৃহন্নলে! শীঘ্র রথ নিবৃত্ত কর। জীবিত থাকিলে অনেক শ্রেয়োলাভের সম্ভাবনা। আমি তোমাকে বিশুদ্ধ সুবর্ণনির্ম্মিত একশত দীনার [১০৮ সুবর্ণমুদ্রা], মহাপ্ৰভাসম্পন্ন হেমবদ্ধ অষ্ট বৈদূৰ্য্যমণি, সুশিক্ষিত-অশ্বসংযুক্ত, হেমদণ্ড-সুশোভিত রথ এবং দশটি মত্ত মাতঙ্গ প্ৰদান করিব, তুমি আমাকে পরিত্যাগ কর।”

উত্তর এইরূপে নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপপূর্ব্বক মূর্ছিত প্ৰায় হইলে অর্জ্জুন সহাস্য-বদনে তাহাকে রথের নিকট আনয়ন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে শক্ৰকৰ্ষণ! যদি যুদ্ধ করিতে তোমার উৎসাহ না হয়, তবে তুমি আমার সারথি হইয়া অশ্বচালনা কর; আমি স্বয়ং মহারথ বীরপুরুষগণের সহিত সংগ্রাম করিতেছি; তোমার কিছুমাত্র শঙ্কা নাই। আমি স্বীয় বাহুবলে তোমাকে রক্ষা করিব। হে অরাতি-নিপাতন! তুমি ক্ষত্রিয় হইয়া শক্ৰসমক্ষে এত বিষণ্ন হইতেছ কেন? আমি কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া তোমার ধেনুগণ প্রত্যানিয়ন করিব। এক্ষণে প্ৰস্তুত হও, আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই।”

জয়শীল অর্জন এইরূপ প্ৰবোধবাক্যে ভয়াপীড়িত উত্তরকে আশ্বাসিত করিয়া তাঁহাকে লইয়া রথারোহণপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন।