১৩. কৃষ্ণ কর্তৃক রাজসূয়ের বিবিধ বিঘ্ন বর্ণন

কৃষ্ণ কর্তৃক রাজসূয়ের বিবিধ বিঘ্ন বর্ণন

শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনি সর্ব্বগুণে গুণবান, অতএব রাজসূয় যজ্ঞ করা আপনার পক্ষে অবিধেয় নহে। আপনি সর্ব্বজ্ঞ, তথাপি আপনাকে কিঞ্চিৎ কহিতেছি, শ্রবণ করুন। পূর্ব্বে জমদগ্নিনন্দন পরশুরাম পৃথিবী নিঃক্ষত্ৰিয়া করেন। তৎপরে যাহারা ক্ষত্ৰকুলে জন্মিয়াছেন, তাহারা যথার্থক্ষত্ৰিয় নহেন; কিন্তু ক্ষত্ৰিয়ের ন্যায় আচার-ব্যবহার করিয়া থাকেন; তাহারা একত্ৰ হইয়া যে কুলনিয়ম সংস্থাপন করিয়াছেন, তাহাও আপনার বিদিত আছে। হে রাজন! অনেকানেক ভূপতিগণ ও ক্ষত্ৰিয়গণ ঐলবংশ ও ইক্ষাকুবংশের বৃত্তান্ত কহিয়া থাকেন। যে সকল নরপতিগণ ঐলবংশে ও ইক্ষাকুবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের হইতে একশত কুল সমুৎপন্ন হয়। তন্মধ্যে ভোজবংশীয় ভূপতি যযাতির বংশ ভূমণ্ডলের চতুর্দিকে বিত্তীর্ণ রহিয়াছে। হে রাজনী! যাবতীয় ক্ষত্ৰিয়গণ স্ব স্ব বংশলক্ষ্মী অধিকার করিয়া আসিতেছেন। এক্ষণে মহীপতি জরাসন্ধ স্বীয় বাহুবলে সমস্ত ভূপতিগণকে পরাজিত করিয়া স্ববশে আনয়নপূর্ব্বক তাহাদের কর্তৃক সেবিত হইয়া অখণ্ড ভূমণ্ডলে একাধিপত্য সংস্থাপন করিয়াছেন; হে মহারাজ! যে রাজা সকলের প্রভু এবং সমস্ত জগৎ যাহার হস্তগত, নিয়মানুসারে তিনিই সাম্রাজ্য প্রাপ্ত হয়েন। প্রতাপশালী শিশুপাল মহীপতি জরাসান্ধের আশ্রয় লইয়া তাঁহার সেনাপতি হইয়াছেন। মায়াযোধী বীৰ্য্যবান করুষাধিপতি বক্র শিষ্যের ন্যায় তাহাকে সেবা করিতেছেন। মহাবল পরাক্রান্ত হংস ও ডিম্ভক তাহার আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়াছেন। দস্তবক্র, করুষ, কারভ ও মেঘবাহন তাঁহার বশীভূত হইয়াছেন। যিনি মস্তকে দিব্য মণি ধারণ করেন, যিনি মুরু ও নরকদেশ শাসন করেন, যিনি বিরুণের ন্যায় পশ্চিমদেশে বদ্ধমূল হইয়াছেন, আপনার পিতৃবন্ধু মহাবলপরাক্রান্ত যবনাধিপতি বৃদ্ধ ভগদত্ত সতত তাহার প্রিয়কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। যিনি আপনার প্রতি আতিশয় স্নেহবান, যিনি পিতার ন্যায় আপনাকে ভক্তি করেন, যিনি পশ্চিমভাগের ও দক্ষিণসীমার অধিপতি এবং যিনি স্নেহবশতঃ আপনার নিকট সতত সন্নত থাকেন সেই পুরুজিৎ, কুস্তিবংশবৰ্দ্ধন, শক্ৰনিসূদন, আপনার মাতুল সেই জরাসন্ধের অনুগত। যে দুরাত্মা চেদিদেশে সুবিখ্যাত, যে আপনাকে পুরুষোত্তম বলিয়া স্বীকার করে, যে মোহবশতঃ সর্ব্বদা আমার চিহ্ন ধারণ করিয়া থাকে, যে বঙ্গ, পুণ্ড ও কিরাত। দেশের অধিপতি এবং ভূমণ্ডলে বাসুদেব বলিয়া বিখ্যাত, সেই মহাবল-পরাক্রান্ত পৌণ্ডক এক্ষণে র্তাহার আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়াছে। যিনি পৃথিবীর চতুর্থাংশ ভোগ করিতেছেন, ভোজ ও দেবরাজ ইন্দ্ৰ যাহার সখা, যিনি পাণ্ড্য, ক্ৰন্থ ও কৈশিকদেশ জয় করিয়াছেন, পরশুরামতুল্য তেজস্বী আকৃতি যাঁহার ভ্রাতা, সেই বিদ্যাবলসম্পন্ন, শক্ৰনিসূদন ভীষ্মকও তাঁহার বশবতী হইয়াছেন। ভীষ্মক আমাদের আত্মীয়, আমরা সর্ব্বদা তাঁহার প্রিয়ানুস্ঠান করি এবং বিনীতভাবে অনুগত থাকি, কিন্তু তিনি তথাপি আমাদের বশীভূত হয়েন না। তিনি জরাসন্ধের কীর্তিশ্রবণে বিমুগ্ধ হইয়া কি কুলাভিমান, কি বলাভিমান সমুদয়ে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্ব্বক তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছেন। উত্তর দেশনিবাসী রাজগণ ও অষ্টাদশ ভোজকুল জরাসন্ধের ভয়ে পশ্চিমদিকে পলায়ন করিয়াছেন। শূরসেন ভদ্রকার, বোধ, শাম্ব, পটাচ্চর, সুস্থল, মুকুট্ট, কুলিন্দ, কুন্তি, শালায়নবংশীয় নৃপতিগণ, দক্ষিণপাঞ্চলস্থ ভূপতিগণ এবং পূর্ব্বকোশলনিবাসী রাজগণ সোদর ও অনুচরগণ-সমভিব্যাহারে পশ্চিমদিকে পলায়ন করিয়াছেন। মৎস্য এবং সন্ন্যস্তপাদদেশীয় নরপতিগণও সাতিশয় ভীত হইয়া উত্তরদিক পরিত্যাগপূর্ব্বক দক্ষিণদিকে গমন করিয়াছেন। যাবতীয় পাঞ্চালদেশীয় মহীপতিগণ স্বস্ব রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ পলায়ন করিয়াছেন।

কিয়ৎকাল অতীত হইল, দানবরাজ কংস যাদবগণকে পরাভূত করিয়া সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। ঐ দুরাত্মা স্বীয় বাহুবলে জ্ঞাতিবৰ্গকে পরাজয় করিয়া সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান হইয়া উঠিল। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্ৰিয়গণ মূঢ়মতি কংসের দৌরাত্ম্যে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া জ্ঞাতিগণকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তৎকালে অক্রূরকে আহুককন্যা প্ৰদান করিয়া জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধনাৰ্থে বলভদ্ৰ-সমভিব্যাহারে কংস ও সুনামাকে সংহার করিলাম। তাহাতে কংস-ভয় নিবারিত হইল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরেই জরাসন্ধ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠিল। তখন আমরা জ্ঞাতিবন্ধুগণের সহিত একত্র পরামর্শ করিলাম যে, যদি আমরা শত্ৰুনাশক মহাস্ত্র দ্বারা তিনশত বৎসর অবিশ্রাম জরাসন্ধের সৈন্য বধ করি, তথাপি নিঃশেষিত করিতে পারিব না। দেবতুল্য তেজস্বী মহাবল-পরাক্রান্ত হংস ও ডিম্ভক নামক দুই বীর তাহার অনুগত আছে; উহারা অস্ত্রাঘাতে কদাচ নিহত হইবে না। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, ঐ দুই বীর এবং জরাসন্ধ এই তিনজন একত্র হইলে ত্ৰিভুবন বিজয় করিতে পারে। হে ধর্ম্মরাজ! এই পরামর্শ কেবল আমাদের অভিমত হইল, এমত নহে; অন্যান্য ভূপতিগণও উহাতে অনুমোদন করিবেন।

হংস নামে সুবিখ্যাত এক নরপতি ছিলেন। বলদেব তাঁহাকে সংগ্রামে সংহার করেন। ডিম্ভক লোকমুখে হংস মরিয়াছে, এই কথা শ্রবণ করিয়া নামসাদৃশ্যপ্রযুক্ত তাহার সহচর হংস নিধনপ্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া স্থির করিল। পরে হংস বিনা আমার জীবনধারণে প্রয়োজন নাই, এই বিবেচনা করিয়া যমুনায় নিমগ্ন হইয়া প্ৰাণত্যাগ করিল। এদিকে তৎসহচর হিংসও পরম প্রণয়াস্পদ ডিম্ভক আপনি মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ-শ্রবণে প্রাণত্যাগ করিয়াছে শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া যমুনাজলে আত্মসমর্পণ করিল। জরাসন্ধ এই দুই বীরপুরুষের নিধনবার্তা-শ্রবণে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও শূন্যমনা হইয়া স্বনগরে প্রস্থান করিলেন। জরাসন্ধ বিমনা হইয়া স্বপুরে গমন করিলে পর আমরা পরমহ্লাদে মথুরায় বাস করিতে লাগিলাম।

কিয়দ্দিনানন্তর পতিবিয়োগদূঃখিনী জরাসন্ধনন্দিনী স্বীয় পিতার সমীপে আগমনপূর্ব্বক ‘আমার পতিহন্তাকে সংহার কর’ বলিয়া বারংবার তাহাকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমরা পূর্ব্বেই জরাসন্ধের বলবিক্রমের বিষয় স্থির করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহা স্মরণ করিয়া সাতিশয় উৎকণ্ঠিত হইলাম। তখন আমরা আমাদের বিপুল ধনসম্পত্তি বিভাগ করিয়া সকলে কিছু কিছু লইয়া প্রস্থান করিব, এই স্থির করিয়া স্বস্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক পশ্চিমদিকে পলায়ন করিলাম। ঐ পশ্চিমদেশে রৈবিতোপশোভিত পরামরমণীয় কুশস্থলীনামী পুরীতে বাস করিতেছি। তথায় এরূপ দুৰ্গসংস্কার করিয়াছি যে, সেখানে থাকিয়া বৃষ্ণিবংশীয় মহারাথিগণের কথা দূরে থাকুক, স্ত্রীলোকেরাও অনায়াসে যুদ্ধ করিতে পারে। হে রাজন! এক্ষণে আমরা অকুতোভয়ে ঐ নগরীমধ্যে বাস করিতেছি। মাধবগণ সমস্ত মগধদেশব্যাপী সেই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ রৈবতক পর্ব্বত দেখিয়া পরমহ্লাদিত হইলেন। হে কুরুকুলপ্রদীপ! আমরা সামৰ্থ্যযুক্ত হইয়াও জরাসন্ধের উপদ্রবভয়ে পর্ব্বত আশ্রয় করিয়াছি। ঐ পর্ব্বত দৈর্ঘ্যে তিন যোজন, প্রস্থে এক যোজনেরও অধিক এবং একবিংশতি শৃঙ্গযুক্ত। উহাতে এক এক যোজনের পর শত শত দ্বার এবং অত্যুৎকৃষ্ট উন্নত তোরণ-সকল আছে। যুদ্ধদুর্ম্মদ মহাবল-পরাক্রান্ত ক্ষত্ৰিয়গণ উহাতে সর্ব্বদা বাস করিতেছেন। হে রাজন! আমাদের কুলে অষ্টাদশ সহস্র ভ্রাতা আছেন। আহুকের একশত পুত্র। তাঁহারা সকলেই অমরতুল্য। চারুদেষ্ণ ও তাঁহার ভ্ৰাতা, চক্ৰদেব, সাত্যকি, আমি, বলভদ্র, যুদ্ধবিশারদ শাম্ব ও প্ৰদ্যুম্ন আমরা এই সাতজন রথী; কৃতবৰ্মা, অনাবৃষ্টি, শমীক, সমিতিঞ্জয়, কঙ্ক, শঙ্কু ও কুন্তি এই সাতজন মহারথ এবং অন্ধকভোজের দুই বন্ধু পুত্র ও রাজা এই মহাবলপরাক্রান্ত দৃঢ়-মধ্যমদেশ স্মরণ করিয়া যদুবংশীয়দিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন।

হে ভারতসত্তম! আপনি সম্রাটতুল্য গুণশালী, অতএব আপনার সম্রাট হওয়া নিতান্ত আবশ্যক; কিন্তু আমার নিশ্চয়বোধ হইতেছে, জরাসন্ধ জীবিত থাকিতে আপনি কখনই রাজসূয়ানুষ্ঠানে কৃতকাৰ্য্য হইতে পরিবেন না। সে বাহুবলে সমস্ত ভূপতিগণকে পরাজয় করিয়া, সিংহ যেমন পর্ব্বতকন্দরমধ্যে করিগণকে বদ্ধ রাখে, সেইরূপ তাঁহাদিগকে গিরিদুর্গে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। ঐ দুরাত্মা রাজসূয়-যজ্ঞার্থ প্রতিজ্ঞা করিয়া কঠোর তপানুষ্ঠান দ্বারা দেবাদিদেব মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়াছিল। পরে সমস্ত ভূপতিগণকে পরাজয় করিয়া আপনার প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করিল। সে ক্রমে ক্রমে সমস্ত ভূপালগণকে পরাজিত করিয়া আপনার পুরে আনয়নপূর্ব্বক বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। আমরা জরাসন্ধের ভয়ে ভীত হইয়া মথুরা পরিত্যাগপূর্ব্বক দ্বারাবতী নগরীতে পলায়ন করিয়াছি। হে মহারাজ! যদি আপনার রাজসূয় যজ্ঞ করিবার মানস থাকে, তবে অগ্রে জরাসন্ধ কর্তৃক বদ্ধ ভূপালগণকে মোচন ও দুরাত্মা জরাসন্ধের বধের নিমিত্ত যত্ন করুন, নচেৎ আপনি কোনক্রমে রাজসূয় সুসম্পন্ন করিতে পরিবেন না। হে কুরুনন্দন! আমার এই মত। এক্ষণে আপনি বিবেচনা করিয়া যাহা উচিত হয়, বলুন।”