১৭. রুদ্রবরে অশ্বত্থামার অলৌকিক শক্তিকথা

১৭শ অধ্যায়

রুদ্রবরে অশ্বত্থামার অলৌকিক শক্তিকথা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির দ্রোণপুত্র প্রভৃতি বীরত্রয়ের হস্তে স্বীয় সমস্ত সৈন্য ও পুত্রগণের নিধন নিবন্ধন নিতান্ত শোকসন্তপ্ত হইয়া বাসুদেবকে কহিলেন, “মধুসূদন! পাপাত্মা নরাধম অশ্বত্থামা কিরূপে আমার মহারথ পুত্রগণকে নিপাতিত করিল এবং যে কৃতাস্ত্র মহাবলপরাক্রান্ত ধ্রুপদতনয়গণ লক্ষ বীরের সহিত যুদ্ধ করিতে পারিত, তাহারা কি নিমিত্ত দ্রোণপুত্র কর্ত্তৃক নিহত হইল? মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে দ্রোণাচার্য্যও তাহার সম্মুখীন হইতে পারেন নাই। এক্ষণে সেই বীর কি কারণে অশ্বত্থামার হস্তে প্রাণত্যাগ করিল? ফলতঃ অশ্বত্থামা এমন কি উপায় অবলম্বন করিয়া একাকী আমার পক্ষীয় সমুদয় বীরের প্রাণ সংহার করিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

বাসুদেব কহিলেন, “মহারাজ! দ্রোণকুমার নিশ্চয়ই দেবদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হইয়াছিল এবং তাঁহারই প্রসাদে একাকী সমুদয় বীরকে নিপাতিত করিয়াছে। ভগবান্ রুদ্র প্রসন্ন হইলে বলবীর্য্যের কথা দূরে থাকুক, অমরত্ব পৰ্য্যন্ত প্রদান করিতে পারেন। তাঁহার প্রভাবে লোকে ইন্দ্রকেও নিপীড়িত করিতে সমর্থ হয়। আমি দেবদেব মহাদেবকে ও তাঁহার পুরাতন কাৰ্য্য-সমুদয় বিশেষরূপে বিদিত আছি। তিনিই সর্ব্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্তস্বরূপ। তাঁহার প্রভাবে এই জগতের সমুদয় কাৰ্য্য সুসম্পন্ন হইতেছে।

পূৰ্ব্বে লোকপিতামহ ব্রহ্মা লোক উৎপন্ন করিবার মানসে ভগবান রুদ্রকে কহিয়াছিলেন, তুমি অচিরাৎ ভূতগণের সৃষ্টি কর। ভগবান্ দেবদেব তাঁহার বাক্য-শ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বীকার করিলেন এবং সর্বাগ্রে প্রজা সৃষ্টি করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া সলিলে প্রবেশপূর্ব্বক দীর্ঘকাল তপস্যা করিতে লাগিলেন। বিধাতা তাঁহার নিমিত্ত বহুকাল প্রতীক্ষা করিয়া পরিশেষে ভূতসৃষ্টির নিমিত্ত আর একজন অমরের সৃষ্টি করিলেন। তিনি ভগবান্ রুদ্রকে জলমগ্ন দেখিয়া পিতাকে কহিলেন, ‘ভগবন্! যদি অন্য কেহ আমার অগ্রজ না থাকেন, তাহা হইলে আমি প্রজাগণের সৃষ্টি করিতে পারি। তখন কমলযোনি কহিলেন, ‘বৎস! এক্ষণে তোমার অগ্রজ কেহই নাই। মহাদেব জলমগ্ন হইয়াছেন। অতএব তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে আত্মকাৰ্য্য নিৰ্বাহ কর। তখন অমর ব্রহ্মার বাক্যানুসারে সমুদয় ভূত ও দক্ষাদি সপ্ত প্রজাপতির সৃষ্টি করিলেন। ঐ সমুদয় প্রজাপতি হইতেই এই চতুর্বিধ প্রাণীর সৃষ্টি হইয়াছে। অনন্তর প্রজাগণ নিতান্ত ক্ষুধাতুর হইয়া সৃষ্টিকর্ত্তাকে ভক্ষণ করিবার মানসে তাঁহার নিকট সহসা ধাবমান হইল। তখন তিনি ভীতচিত্তে লোকপিতামহ ব্রহ্মার নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ভগবন্! প্রজাগণের আহার নির্দেশ পূর্ব্বক আমাকে পরিত্রাণ করুন। ব্রহ্মা তাঁহার বাক্যশ্রবণে প্রজাগণের আহারার্থ ওষধি প্রভৃতি স্থাবর পদার্থ-সমুদয় নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিলেন। তাঁহারই নিয়মানুসারে দুর্ব্বল প্রাণীগণ বলবান দিগের আহারার্থ নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। তখন প্রজাগণ আপনাদিগের ভক্ষ্যদ্রব্য প্রাপ্ত হইয়া স্বেচ্ছানুসারে প্রস্থান করিল এবং সকলেই স্ব স্ব জাতিতে অনুরক্ত হইয়া জীবসংখ্যা পরিবর্ধিত করিতে লাগিল।

হে মহারাজ! প্রজাগণ এইরূপে পরিবর্ধিত ও লোকগুরু ব্রহ্মা পরিতুষ্ট হইলে ভগবান্ মহাদেব সলিল হইতে সমুত্থিত হইলেন এবং ঐ সমস্ত তেজঃপরিবর্ধিত অসংখ্য প্রজা-দর্শনে রোষাবিষ্ট হইয়া স্বীয় লিঙ্গ ভূতলে প্রবেশিত করিলেন। তখন ভগবান্ ব্রহ্মা বিবিধ বাক্যে তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, “মহাদেব! তুমি এত দীর্ঘকাল সলিলমধ্যে অবস্থান করিয়া কি কাৰ্য্য করিলে আর কি নিমিত্তই বা এক্ষণে আপনার লিঙ্গ ভূতলে প্রবেশিত করিয়াছ? তখন মহাদেব কোপাবিষ্ট হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘বিধাতঃ! আমার অগোচরে আর একজন এই সমস্ত প্রজার সৃষ্টি করিয়াছে। অতএব আমার এই লিঙ্গে আর প্রয়োজন কি? আমি জলমধ্যে তপস্যা করিয়া প্রজাগণের নিমিত্ত অন্ন সৃষ্টি করিয়াছি। প্রজাদিগের ন্যায় ওষধি-সমুদয়ও পরিবর্ধিত হইবে।’ ভগবান্ রুদ্র এই বলিয়া ক্রোধভরে তপঃসাধনার্থ মুঞ্জবান্ পর্ব্বতে প্রস্থান করিলেন।”