৩২. সুশর্ম্মার সহিত পাণ্ডবগণের যুদ্ধ

৩২তম অধ্যায়

সুশর্ম্মার সহিত পাণ্ডবগণের যুদ্ধ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবল-পরাক্রান্ত মৎস্যগণ মহতী সেনা-সমভিব্যাহারে অপরাহ্নকালে নগর হইতে নিৰ্গত হইয়া গোধনাপহারী ত্রিগর্ত্তদিগকে আক্রমণ করিলেন। রণদুর্ম্মদ ত্ৰিগর্ত্ত ও মৎস্যগণ গো-গ্ৰহণাভিলাষে ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া পরস্পর তর্জন-গর্জন করিতে লাগিলেন। উভয়-পক্ষীয় যুদ্ধকুশল প্রধান প্রধান সৈনিক পুরুষেরা গজারোহণপূর্ব্বক রণক্ষেত্রে অগ্রসর হইয়া তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ করিল। তাহাদিগের সেই ঘোরতর সংগ্রাম সন্দর্শন করিলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। রণনিহত জনসমূহ দ্বারা যমপুর পরিপূর্ণ হইল।

ক্ৰমে ভগবান ভাস্কর অস্তাচলচুড়া অবলম্বন করিলে উভয়পক্ষীয় চতুরঙ্গিণী সেনা অধিকতর বলবিক্রম প্রকাশ্যপূর্ব্বক পরস্পরকে আক্রমণ করিতে লাগিল। ফলতঃ তৎকালে সেই যুদ্ধ দেবাসুর-সংগ্রামের ন্যায় অতি ভীষণ হইয়া উঠিল। সেনাগণের পাদবিক্ষুণ্ন মহীতল হইতে ধূলিরাশি সমুত্থিত হইয়া চতুর্দ্দিক অন্ধকারময় করিল; পক্ষিগণ ধূলিপটলসংবৃত ও বিলুপ্তদৃষ্টি হইয়া ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল; সুদূরপ্রস্থিত শরজালে সূৰ্য্যমণ্ডল তিরোহিত হইয়া গেল। তখন বোধ হইতে লাগিল, যেন অন্তরীক্ষ খদ্যোতমালায় বিভূষিত হইয়াছে। সব্য-দক্ষিণ [বামদক্ষিণ] প্রধাবিত বলবান ধানুকগণের শরাসন-সকল পরস্পর সংঘটিত হইতে লাগিল। রথী রথীর সহিত, অশ্বারোহী অশ্বারোহীর সহিত, পদাতি পদাতির সহিত ও গজারূঢ় গজারূঢ়ের সহিত সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত হইল। মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষেরা ক্ৰোধে প্রজ্বলিত হইয়া অসি, পট্টিশ, প্রাস, শক্তি ও তোমর প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ প্রহারপূর্ব্বক শত শত লোক নিহত করিতে লাগিলেন। উভয় পক্ষই তুল্যবল, কেহ কাহাকে পরাঙ্মুখ করিতে সমর্থ হইল না। আহত সৈন্যগণের ওষ্ঠ, নাসিকা ও কেশবিহীন মস্তক-সকল ছিন্নভিন্ন হইয়া ধরাতলে নিপতিত ও ধূলিধূসরিত হইতে লাগিল। তাহাদিগের শালস্কন্ধসন্নিভ শরীরসমুদয় নিশিত ইষু-প্রহারে খণ্ড খণ্ড হইয়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইল। মহাকায় ক্ষত্ৰিয়গণের চন্দনচর্চিত বিশাল বাহু ও কুণ্ডল-বিভূষিত মস্তক দ্বারা রণক্ষেত্রের অনির্ব্বচনীয় শোভা হইতে লাগিল। নিহত প্রাণীগণের শোণিতপ্রবাহে ভূমণ্ডলস্থ ধূলিরাশি কর্দ্দমভাব প্রাপ্ত হইল।

এইরূপে ক্ৰমে ক্ৰমে সমরসাগর উদ্বেল হইয়া উঠিলে অনেকেই মূৰ্ছাপন্ন হইতে লাগিল। গৃধ্র প্রভৃতি রুধিরমাংসলোলুপ পক্ষিগণ বীরগণের শরে উদ্বেজিত হইয়াও তথায় উপবেশন করিতে লাগিল। পরস্পর-নিহন্তা রণদুৰ্ম্মদ বীরপুরুষদিগের সমরপ্রভাবে অন্তরীক্ষগামী প্রাণীগণেরও দৃষ্টি বিলুপ্ত হইয়া গেল। অনন্তর মহারথ শতানীক একশত ও মহাবল পরাক্রান্ত, বিশালাক্ষ চতুঃশত শত্রুসৈন্য সংহারপূর্ব্বক বিপক্ষপক্ষীয় রথ ব্ৰজ লক্ষ্য করিয়া মহতী ত্ৰিগর্ত্তসেনা-মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন এবং বাহুবলে তাহাদিগের কেশাকর্ষণ ও রথাক্রমপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। বিরাটরাজ সূৰ্য্যদত্তকে অগ্ৰে ও মদিরাক্ষকে পশ্চাতে লইয়া বিপক্ষপক্ষীয় পঞ্চশত রথী, পঞ্চ মহারথ ও অষ্টশত অশ্ব নিহত করিয়া রণক্ষেত্রে ইতস্ততঃ বিচরণ করিয়া সুবৰ্ণরথারূঢ় সুশর্ম্মাকে আক্রমণ করিলেন। এখন সেই মহাবল-পরাক্রান্ত বীরযুগল পরস্পর স্পৰ্দ্ধাপূর্ব্বক গোষ্ঠস্থিত বৃষভদ্বয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।

তদনন্তর রণবিশারদ ত্রিগর্ত্তরাজ মৎস্যরাজকে আক্রমণ করিয়া দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন জলদকালে ঘনঘটা গভীর গর্জনপূর্ব্বক অনবরত বারিধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ তাঁহারা রোষপরবশ হইয়া পরস্পর তর্জন-গর্জনপূর্ব্বক অবিরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। উভয়েই কৃতাস্ত্র ও লঘুহস্ত; তাঁহারা সুতীক্ষ্ন বাণ, অসি, শক্তি ও গদা প্রভৃতি অস্ত্ৰ-শস্ত্র-প্রয়োগবিষয়ে স্ব স্ব নৈপুণ্য প্রকাশ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে বিরাটরাজ, সুশর্ম্মাকে দশ বাণে ও তাঁহার অশ্বচতুষ্টয়কে পঞ্চ পঞ্চ বাণে বিদ্ধ করিলেন। সর্ব্বাস্ত্ৰকুশল রণবিশারদ সুশৰ্মাও বিরাটপতির প্রতি নিশিত পঞ্চশত শর নিক্ষেপ করিলেন। সৈন্যপদোত্থিত ধূলিপটলে চতুর্দ্দিক সমাবৃত হইলে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ কে কোথায় রহিল, পরস্পর তাহার কিছুই জানিতে পারিল না।