০৩৭. অর্জ্জুনের যুদ্ধবিদ্যাস্ত্ৰলাভার্থ তপস্যা

৩৭তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের যুদ্ধবিদ্যাস্ত্ৰলাভার্থ তপস্যা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, কিয়ৎকাল অতীত হইলে রাজা যুধিষ্ঠির ব্যাসবাক্য স্মরণ ও মুহুর্ত্তকাল বনবাসের বিষয় চিন্তা করিয়া নির্জ্জনে সহাস্যবদনে সান্ত্ববাদ প্রয়োগ এবং হস্তদ্বারা গাত্ৰ স্পর্শপুর্ব্বক অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে বৎস! এক্ষণে ভীষ্ম, দ্ৰোণ, কৃপ, কর্ণ ও অশ্বথামা ইহারা পূর্ণচতুষ্পাদ ধনুর্ব্বেদ সম্যক অধিকারলাভ করিয়াছেন। ইহারাই ব্রাহ্ম, দৈব ও মানুষ প্রভৃতি অস্ত্রসমূহের ধারণ-প্রহরণরূপ প্রয়োগ ও পর-প্রযুক্ত অস্ত্রের প্রতিকার এই সমস্ত বিষয়ে সুশিক্ষিত হইয়াছেন। দুৰ্য্যোধন ইহাদিগকে সান্ত্বনা, প্রচুর অর্থদান ও সন্তুষ্ট করিয়া গুরুর ন্যায় সম্মান করিয়া থাকে এবং যোদ্ধৃবর্গের প্রতি সর্ব্বদা প্রীত আছে। আচাৰ্য্যেরাও সম্মানিত ও সন্তুষ্ট হইয়া শান্ত ব্যবহার করিয়া থাকেন এবং কাৰ্য্যকাল উপস্থিত হইলে প্ৰতিপূজিত হইয়া আপনাদিগের বলবীৰ্য্য প্রকাশ করিবেন। এক্ষণে গ্রামনগরসংযুক্ত সাগর, বন ও আকরপরিবৃত এই অখণ্ড মহীমণ্ডল দুৰ্য্যোধনের অধিকৃত হইয়াছে। হে অর্জ্জুন! তুমিই আমাদিগের প্রিয়পাত্র এবং তোমাতেই সমগ্ৰ ভার সমাপিত হইয়াছে, এক্ষণে সময়োচিত কর্ত্তব্য নিরূপণ করিয়া কহিতেছি, শ্রবণ কর। আমি মহর্ষি বেদব্যাস হইতে রহস্যবিদ্যা গ্রহণ করিয়াছি, ঐ বিদ্যা প্রয়োগ করিলে সমস্ত বিশ্ব উদ্ভাসিত হইয়া উঠে। তুমি ঐ বিদ্যা-সংযুক্ত ও সুসমাহিত হইয়া তপস্যায় মনোনিবেশপূর্ব্বক যথাকলে দেবতাদিগের প্রসাদ লাভের অপেক্ষা করিবে; অতএব এক্ষণে ধন, কবচ ও খড়্গগ্রহণপূর্ব্বক সাধুব্রতধারী মুনি হইয়া উত্তরদিকে প্রস্থান কর, কিন্তু কাহাকেও পথ প্রদান [তপস্যার গূঢ়রহস্য প্রকাশ] করিও না। পূর্ব্বে দেবগণ বৃত্ৰাসুর হইতে ভীত হইয়া ইন্দ্রকে সমস্ত দিব্যাস্ত্ররূপ সামর্থ্য সমর্পণ করিয়াছিলেন। তুমি একস্থানস্থ সেই সমস্ত অস্ত্র দেবরাজ হইতেই প্রাপ্ত হইবে, অতএব তাহার নিকটে গমন কর, তিনিই তোমাকে সমুদয় অস্ত্র প্রদান করিবেন। তুমি অদ্যই দীক্ষিত হইয়া পুরন্দরকে সন্দর্শন করিবার নিমিত্ত যাত্রা কর।”

এই বলিয়া ধর্ম্মরাজ অর্জ্জুনকে রহস্য-বিদ্যা অধ্যয়ন করাইলেন। অনন্তর অর্জ্জুনকে ব্যাসবিহিত নিয়মানুসারে দীক্ষিত ও কায়মনোবাক্যে সংযত করিয়া প্রস্থানের আদেশ প্রদান করিলেন। অর্জ্জুন ঐরূপ আদিষ্ট হইয়া পুরন্দর-সন্দর্শনার্থ গাণ্ডীব ধনু, অক্ষয় তূণীর, কবচ, বর্ম্ম ও গোধাঙ্গুলিত্র ধারণপূর্ব্বক প্রজ্বলিত হুতাশনে আহুতি প্ৰদান করিলেন। অনন্তর নিষ্ক [স্বর্ণমুদ্রা] দ্বারা ব্ৰাহ্মণদিগকে স্বস্তিবাচন করাইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্র-বধ-সাধনাৰ্থ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও উৰ্দ্ধে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। এই অবসরে সিদ্ধ ব্রাহ্মণগণ ও অন্তর্হিত [গূঢ়-লুক্কায়িত– লোকদৃষ্টির বহির্ভূত] ভূতেরা গৃহীত-শরাসন অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া কহিলেন, “হে মহাবীর! অনতিকালমধ্যেই তোমার সংকল্প সিদ্ধ হইবে।” অনন্তর ব্রাহ্মণের “তুমি প্রস্থান কর, নিশ্চয় তোমার জয়লাভ হইবে।” এই বলিয়া অর্জ্জুনের প্রতি আশীর্ব্বাদ প্রয়োগ করিলেন। দ্রৌপদী মহাকায় অর্জ্জুনকে প্রস্থানোন্মুখ দেখিয়া কারুণ্যরসে সকলের মন অভিষিক্ত করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো! তুমি জন্মগ্রহণ করিলে আৰ্য্যা কুন্তী যাহা অভিলাষ করিয়াছিলেন ও তোমার যেরূপ ইচ্ছা, তৎসমুদয় সফল হউক। এক্ষণে প্রার্থনা করি, যেন ক্ষত্ৰিয়কুলে আর কাহারও জন্ম না হয়। যাহারা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করেন, সেই ব্রাহ্মণদিগকে প্রতিনিয়ত নমস্কার করি। পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন রাজসভায় বহুবিধ অযুক্তবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক আমাকে ‘গরু গরু’ বলিয়া যে উপহাস করিয়াছিল, সেই দুরপনেয় দুঃখ অপেক্ষা এক্ষণে তোমার বিয়োগজনিত দুঃখ গুরুতর বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। তোমার ভ্রাতৃগণ বারংবার তোমারই বীরকার্য্যের কথা উল্লেখ করিয়া সর্ব্বদা আনন্দিত হইবেন। হে নাথ! তুমি দীর্ঘপ্রবাসজনিত প্ৰয়াস স্বীকার করিলে আমাদিগের ভোগ, ধন বা জীবনে কদাচ সন্তোষ জন্মিবে না। আমাদিগের সুখ, দুঃখ, জীবন, মরণ, রাজ্য ও ঐশ্বৰ্য্য এই সমস্ত একমাত্র তোমাতেই সমাহিত হইয়া রহিয়াছে। এক্ষণে তোমাকে আমন্ত্রণ করিতেছি, তুমি মঙ্গল প্রাপ্ত হও। তুমি যে কাৰ্য্যসাধন করিতে উদ্যত হইয়াছ, উহা বলবানেরই কাৰ্য্য; অতএব তুমি জয়লাভের নিমিত্ত নির্ব্বিঘ্নে শীঘ্ৰ প্ৰস্থান কর। ধাতা ও বিধাতাকে নমস্কার করি, তুমি প্রবাসে যাত্রা কর; মঙ্গল হইবে। হ্রী, শ্ৰী, কীর্ত্তি, দ্যুতি, উত্তমা পুষ্টি, লক্ষ্মী ও সরস্বতী ইহারা গমনকালে পথিমধ্যে তোমাকে রক্ষা করিবেন। তুমি জ্যেষ্ঠের অর্চনা ও আজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া থাক, অতএব আমি তোমার শান্তিলাভার্থ বসু, রুদ্র, আদিত্য, মরুদগণ, বিশ্বদেব ও সাধ্যগণকে আরাধনা করিব। অন্তরীক্ষচর, পার্থিব, দিব্য এবং অন্যান্য বিঘ্নকর ভূতগণ তোমার মঙ্গল বিধান করুন।”

যশস্বিনী দ্রৌপদী অর্জ্জুনকে এইরূপে আশীর্ব্বাদ প্ৰদান করিয়া বিরত হইলে মহাবীর পার্থ ভ্রাতৃগণ ও পুরোহিত ধৌম্য মহাশয়কে প্ৰদক্ষিণ করিয়া রুচির শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক যাত্রা করিলেন। ভূতগণ ইন্দ্ৰযোগযুক্ত [ইন্দ্রসদৃশ লক্ষণযুক্ত] প্রবলপরাক্রান্ত তেজঃপুঞ্জকলেবর অর্জ্জুনকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া তদীয় গমনমার্গ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইল। তখন তিনি তপস্বিগণনিষেবিত বহুসংখ্যক অচল অতিক্রম করিয়া একদিবসমধ্যে অতি পবিত্র দেবগণ-পরিবৃত দিব্য হিমাচলে উপনীত হইলেন। অনন্তর ধনঞ্জয় বেগে হিমালয় ও গন্ধমাদন পর্ব্বত উল্লঙ্ঘনপূর্ব্বক অহোরাত্র অতীন্দ্রিত [নিরলস—আলস্য-বিহীন] হইয়া দুৰ্গম স্থান-সকল অতিক্ৰম করিয়া পরিশেষে ইন্দ্ৰকীল পর্ব্বতে উপস্থিত হইলেন। সেই সময় অন্তরীক্ষ হইতে ‘তিষ্ঠ’ এই বাক্য তাঁহার কর্ণগোচর হইবামাত্র তিনি ইতস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন তরুতলে তপস্বীকে দেখিতে পাইলেন। তপস্বী অর্জ্জুনকে তথায় দণ্ডায়মান দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে তাত! ক্ষত্ৰিয়-ব্রতধারী হইয়া ধনু, বর্ম্ম, ও শর গ্রহণপূর্ব্বক পরিকরে [কটিতে] অসিকোষ বন্ধনপূর্ব্বক এস্থানে আগমন করিলে, তুমি কে? ইহা শান্তপ্রকৃতি বিনীতক্ৰোধ তপস্বী ব্রাহ্মণদিগের আশ্রম; এখানে সংগ্রাম-প্রসঙ্গ সুদূরপরাহত, অতএব শস্ত্রের আবশ্যকতা নাই, সুতরাং ধনুর্ব্বাণ ধারণ করা নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন। এক্ষণে শরাসন দূরে নিক্ষেপ কর, তুমি পরামগতি প্ৰাপ্ত হইয়াছে।”

অর্জ্জুনের অস্ত্ৰলাভার্থ ইন্দ্রের উপদেশপ্রদান

অসামান্য ওজঃ ও তেজঃসম্পন্ন ব্রাহ্মণ সহাস্য-আস্যে এইরূপ কহিলেও দৃঢ়ব্ৰত অর্জ্জুনকে কোনক্রমেই ধৈৰ্য্যচ্যুত করিতে পারিলেন না। অনন্তর প্রীত ও প্ৰসন্নমনে কহিলেন, “হে বৎস! তুমি অভীষ্ট হিতকর বর প্রার্থনা কর। আমি দেবরাজ ইন্দ্র।” তখন কুরুকুলতিলক মহাবীর অর্জ্জুন কৃতাঞ্জলিপুটে প্ৰণতিপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “ভগবন! আমি আপনার নিকট সমগ্ৰ অস্ত্ৰ শিক্ষা করিবার অভিলাষে আসিয়াছি, আপনি অনুকম্পা প্রকাশপূর্ব্বক আমাকে এই বর প্রদান করুন।”

তখন দেবরাজ ইন্দ্ৰ প্ৰীতমনে সহাস্যবদনে প্রত্যুত্তর করিলেন, “বৎস! তুমি এই স্থলে আগমন করিয়াছ, তোমার অস্ত্ৰ-শস্ত্রে আর কি প্রয়োজন? এক্ষণে অভীষ্টলোকলাভে যত্ন কর, তুমি পরমগতি প্রাপ্ত হইয়াছ।” ধনঞ্জয় কহিলেন, “ভগবন! আমি লোভ, কাম, দেবত্ব ও সুখপ্ৰাপ্তির প্রত্যাশা করি না; দেবতাদিগের ঐশ্বর্যকেও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বিবেচনা করি। আমি ভ্ৰাতৃবৰ্গকে অরণ্যে পরিত্যাগ করিয়া বৈরনির্য্যাতনের নিমিত্ত আসিয়াছি, ইহার ব্যতিক্রম ঘটিলে ত্ৰিলোকমধ্যে চিরকাল আমার এই অপযশ বর্ত্তমান থাকিবে।” সর্ব্বলোকপূজিত দেবরাজ এইরূপ অভিহিত হইয়া অর্জ্জুনকে মধুরবাক্যে সান্ত্বনাপূর্ব্বক কহিলেন, “হে তাত! তুমি যৎকালে ত্রিশূলধারী ভূতনাথ শঙ্করের সন্দর্শন পাইবে আমি সেই অবসরে তোমাকে সমস্ত দিব্য অস্ত্ৰ প্ৰদান করিব। অতএব তাঁহার সাক্ষাৎকারলাভের নিমিত্ত সর্ব্বতোভাবে যত্ন কর;; তাঁহার সন্দর্শনে তোমার সমুদয় অভীষ্টসিদ্ধি হইবে।” দেবরাজ ইন্দ্র ধনঞ্জয়কে এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়া তিরোহিত হইলে তিনি যোগসাধনে মনোনিবেশপূর্ব্বক তথায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

অর্জ্জুনাভিগমনপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।