১৫. দ্ৰৌপদীপ্রত্যাখ্যাত কীচকের সুদেষ্ণানুরোধ

১৫তম অধ্যায়

দ্ৰৌপদীপ্রত্যাখ্যাত কীচকের সুদেষ্ণানুরোধ

বৈশম্পায়ন কহিলেণ, মহারাজ! অনন্তরর অনঙ্গশরজর্জরিত দুরাত্মা কীচক রাজকুমারী বাজ্ঞসেনী কর্ত্তৃক এইরূপে প্রত্যাখ্যাত হইয়া দেবী সুদেষ্ণাকে কহিল, ‘হে কৈকেয়ি! গজগামিনী সৈরিন্ধ্রী যে উপায়ে আমাকে ভজনা করে, তুমি তাহার উপায় অবধারণ কর। যদি নিতান্তই আমার সৈরিন্ধ্রী লাভ না হয়, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব।”

তখন বিরাট-মহিষী সুদেষ্ণা বারংবার কীচকের এইরূপ বিলাপবাক্য শ্রবণ করিয়া একান্ত কৃপাপরবশ হইলেন এবং ক্ষণকাল দ্রৌপদীর অধ্যবসায় অনুধাবন করিয়া কহিলেন, “হে সূতনন্দন! তুমি পর্বোপলক্ষে সুরা ও অন্ন প্রস্তুত করিও, আমি সূরা আহরণ করিবার নিমিত্ত সৈরিন্ধ্রীকে তোমার নিকটে প্রেরণ করিব। তুমি সেই সুযোগে প্রতিবন্ধকশ্বন্য নির্জন প্রদেশে ইচ্ছানুরূপ সাত্ত্বনা করিও, তাহা হইলে বোধ হয়, তোমার প্রতি অনুরক্ত হইতে পারে।”

কীচক স্বীয় ভগিনী সুদেষ্ণার আশ্বাসবাক্যে কথঞ্চিৎ পরিসাত্ত্বিত হইয়া তথা হইতে সহসা নিষ্ক্রান্ত হইল এবং অনতিবিলম্বে সুপটু পাচক দ্বারা বিবিধ অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত ও রাজসেবনোপযোগী পরিষ্কৃত সুরা আহরণ করাইয়া রাজমহিষীকে সংবাদ দিল। তখন সুদেষ্ণা দ্ৰৌপদীকে কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! আমি বলবতী পিপাসায় নিতান্ত কাতর হইয়াছি, অতএব তুমি কীচকের আলয়ে গমন করিয়া সত্বর পাণীয় আনয়ন কর।”

দ্ৰৌপদী কহিলেন, “হে রাজমহিষী! আমি কীচকের গৃহে কদাচি গমন করিতে পারিব না; সে যেরূপ নির্লজ্জ, আপনি তাহা বিলক্ষণ জানেন। আমি আপনার আলয়ে স্বেচ্ছাচারিণীর ন্যায় বাস করিতে পারিব না। পূর্ব্বে আমি যে নিয়মে আপনার আবাসে প্রবেশ করিয়াছিলাম, তাহা আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন! হে সুকেশি! সেই কামোন্মত্ত কীচক আমাকে দেখিবামাত্রই অবমানিত করিবে; অতএব আমি কোনক্রমেই তথায় গমন করিতে পারিব না। আপনার অন্যান্য অনেক পরিচারিকা আছে, আপনি তাহাদিগের একজনকে প্রেরণ করুন।”

সুদেষ্ণা কহিলেন, “হে সৈরিন্ধ্রী! তুমি মৎকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া তথায় গমন করিতেছ, কীচক কদাচ তোমার অবমাননা করিতে পরিবে না।” এই বলিয়া রাজমহিষী তাঁহার হস্তে আচ্ছাদনযুক্ত এক হিরন্ময় পাত্ৰ প্ৰদান করিলেন।

তখন দ্রৌপদী বাস্পাকুলালোচনে ভীত-মনে দৈবের উপর নির্ভর করিয়া অগত্যা সূরা আহরণার্থ কীচকালয়ে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন; মনে মনে কহিতে লাগিলেন, “আমি ভর্ত্তৃগণ ভিন্ন স্বপ্নেও অন্য পুরুষের মুখাবলোকন করি নাই, সেই পুণ্যাবলে কীচক যেন আমাকে বশীভূত করিতে না পারে।” এই বলিয়া দ্ৰৌপদী মুহূর্ত্তকাল সূৰ্য্যদেবের আরাধনা করিলেন। সূৰ্য্যদেব দ্রৌপদীর মনোগত ভাব অবগত হইয়া এক রাক্ষসকে প্রচ্ছন্নভাবে তাহাকে রক্ষা করিতে আদেশ দিলেন। রাক্ষস তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে নিরন্তর রক্ষা করিতে লাগিল।

অনন্তর পতিপরায়ণা দ্রুপদতনায়া চকিত মৃগীর ন্যায় বিত্ৰস্তচিত্তে ক্ৰমে ক্ৰমে কীচকভবনের সমীপবর্তী হইলেন। দুরাত্মা কীচক তাঁহাকে আগমন করিতে দেখিয়া, যেমন পারগামী নৌকা লাভ করিলে আনন্দিত হয়, তদ্রূপ সাতিশয় সন্তুষ্টচিত্তে সত্বর গাত্ৰোখানপূর্ব্বক কহিতে লাগিল।