০১৫. দণ্ডপ্রশংসাপ্রসঙ্গে অর্জ্জুনের হিংসাসমর্থন

১৫শ অধ্যায়

দণ্ডপ্রশংসাপ্রসঙ্গে অর্জ্জুনের হিংসাসমর্থন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাত্মা অৰ্জ্জুন দ্রৌপদীর বাক্য শ্রবণ করিয়া পুনরায় জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে যথোচিত সম্মানপুৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! দণ্ড প্রজাদিগকে শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে। সকলে নিদ্রায় অভিভূত হইলেও দণ্ড একাকী জাগরিত থাকে। পণ্ডিতেরা দণ্ডকে প্রধান ধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। দণ্ড ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করে বলিয়া উহা ত্রিবর্গ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। দণ্ডপ্রভাবে ধন ও ধান্য রক্ষিত হয়। আর দেখুন, অনেকানেক পাপপরায়ণ পামরেরা রাজদণ্ডভয়ে, অনেকে যমদণ্ডভয়ে, অনেকে পরলোকভয়ে এবং অনেকে লোকভয়ে পাপানুষ্ঠান করিতে পারে না। অনেকে কেবল দণ্ডভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে না। ফলতঃ সংসারে প্রায় সমুদয় কার্য্যই দণ্ডভয়ে নির্ব্বাহ হইতেছে। দণ্ড সংসার রক্ষা করিলে সমুদয়ই গাঢ় অন্ধকারে নিমগ্ন হইত। দণ্ড দুর্দ্দান্তদিগকে দমন ও দুৰ্ব্বিনীত ব্যক্তিদিগকে শাসন করিয়া থাকে। দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ডনামে নির্দিষ্ট হইয়াছে। ব্রাহ্মণের তিরস্কার, ক্ষত্রিয়ের বেতন প্রদান না করা, বৈশ্যের রাজসমীপে দ্রব্যজাত[ধনাদি সম্পত্তি আহরণ] সমর্পণ এবং শূদ্রের সৰ্ব্বস্বাপহরণই [সমস্ত ধন অপহরণ] সমুচিত দণ্ড। মনুষ্যের মোহান্ধকার নিরাস ও অর্থরক্ষার নিমিত্ত জনসমাজে দণ্ডের নিয়ম সংস্থাপিত হইয়াছে। দণ্ডের কলেবর কৃষ্ণ ও নেত্র লোহিতবর্ণ [হৃদয় নির্ম্মম ও চক্ষু রক্তবর্ণ— অন্যায়ে খাতির করিলে এবং নেত্রে ক্রোধের ভাব প্রকাশ না পাইলে শাসন হয় না; ইহাই রূপকাকারে প্রদর্শিত]। যে স্থানে দণ্ডের প্রাদুর্ভাব এবং রাজার সাধুদর্শিতা থাকে, তথায় প্রজারা কদাচ মোহে অভিভূত হয় না। ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও ভিক্ষুক ইহারা দণ্ডের ভয়েই স্ব স্ব পথে অবস্থান করিতেছেন। ভীত না হইলে কেহই যজ্ঞানুষ্ঠান, দান ও নিয়ম প্রতিপালন করিতে ইচ্ছা করে না। আর দেখুন, অন্যের মৰ্ম্মচ্ছেদন, দুষ্কর কাৰ্য্যসাধন এবং মৎস্যঘাতীর ন্যায় লোকের প্রাণসংহার না করিলে বিপুল ঐশ্বৰ্য্য, কীৰ্ত্তি ও প্রজালাভ হয় না। দেবরাজ বৃত্তাসুরকে সংহার করিয়াই ইন্দ্রত্ব লাভ করিয়াছিলেন। দেখুন, যেসকল দেবতা অসুরঘাতী, লোকে তাঁহাদিগকে ভক্তিসহকারে অর্চ্চনা করিয়া থাকে। রুদ্র, কার্ত্তিকেয়, ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, যম, কাল, মৃত্যু, কুবের, সূৰ্য্য এবং বসু, মরুৎ, সাধ্য ও বিশ্বদেবগণ ইঁহারা সকলেই অসুরঘাতী; মনুষ্যেরা ইঁহাদিগের প্রবল প্রতাপ স্মরণপূর্ব্বক ইঁহাদিগকে নমস্কার করে। ব্রহ্মা বিধাতা প্রভৃতি সুরগণের নিকট সকলে প্ৰণত[ব্রহ্মা ও প্রজাপতি প্রভৃতি দেবতারা কাহাকেও বধাদিরূপ দণ্ড প্রদান করেন না বলিয়া ইন্দ্রাদির মত সকলের প্রণম্য নহে] হয় না। শান্তিপরায়ণ ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল উদাসীন দেবগণ[সূৰ্য্যাদি দেবতারা] কেবল কতকগুলি সৰ্ব্বকার্য্যানুষ্ঠানতৎপর লোককর্ত্তৃক পূজিত হইয়া থাকেন। আর দেখুন, এই জীবলোকে কেহ হিংসা না করিয়া জীবনধারণ করিতে পারে না। বলবান জীবগণ দূর্ব্বল জন্তুদিগের হিংসা করিয়া প্রাণধারণ করিতেছে। নকুল মূষিককে, মার্জ্জার[বিড়াল] নকুলকে, কুকুর মার্জারকে, চিত্রব্যাঘ্ৰ কুকুরকে এবং মনুষ্য সেই চিত্রব্যাঘ্রকে ভক্ষণ করিয়া থাকে। বিধাতা স্বয়ং স্থাবরজঙ্গমাত্মক পদার্থসমুদয়কে জীবের জীবনধারণোপযোগী অন্নস্বরূপ নির্দেশ করিয়া দিয়াছেন, এই নিমিত্ত বিজ্ঞেরা হিংসাসহকারে জীবিকানির্ব্বাহ করিতে কিছুতেই সঙ্কুচিত হয়েন না।

দণ্ডের গুণ—দণ্ডাভাবে বিবিধ দোষদর্শন

“হে মহারাজ! আপনি ক্ষত্রিয়যোনিতে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন, অতএব ক্ষত্রিয়ের ন্যায় ব্যবহার করাই আপনার কৰ্ত্তব্য। মূঢ়েরাই ক্রোধ ও হর্ষ পরাজয় করিয়া বানপ্রস্থাশ্রম অবলম্বন করিয়া থাকে। দেখুন, তাপসগণও হিংসা না করিয়া জীবনধারণ করিতে পারেন না। সলিলে, ভূতলে ও ফলসমুদয়ে। বহুসংখ্যক জীব বাস করিয়া থাকে। লোকে প্রাণধারণের নিমিত্ত সেই জীবগণের জীবন বিনাশ করিতেছে। এই পৃথিবীতে এরূপ সূক্ষ্ম জীব আছে যে, কেবল তর্কদ্বারা তাহাদিগের সত্তা অবগত হইতে হয়। লোকের অক্ষিপক্ষ্মের[চক্ষুর রোমের] আঘাতেও সেইসকল জীবের প্রাণনাশ হইতেছে। অনেক মুনি রাগদ্বেষপরিহারপূর্ব্বক গ্রাম হইতে নিষ্ক্রান্ত ও অরণ্যবাসী হইয়াও বিমুগ্ধচিত্তে গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন। আর অনেক সামান্য মনুষ্যও ভূমি ভেদ এবং ওষধি, পশু, পক্ষী ও বৃক্ষাদি ছেদন করিয়া। যজ্ঞানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক স্বর্গলাভ করিতেছে। যাহা হউক, দণ্ডনীতির প্রভাবেই সকল জীবের সকল কার্য্যসিদ্ধ হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই। যদি এই জীবলোকে দণ্ডের প্রাদুর্ভাব না থাকিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্ৰজাসকল বিনষ্ট হইত এবং বলবান্ মনুষ্য দুর্ব্বল মনুষ্যগণকে মৎস্যের ন্যায় ভক্ষণ করিত।

“ব্রহ্মা পূৰ্ব্বে কহিয়া গিয়াছেন যে, সুবিহিত দণ্ড প্রজাদিগকে রক্ষা করিয়া থাকে। বিধাতার এই বাক্যে কিছুমাত্র সংশয় নাই। দেখুন, হুতাশন একবার প্রশান্তভাব অবলম্বন করিয়াও ফুৎকারপ্রভাবে ভীত হইয়া পুনরায় প্রজ্বলিত হয়েন। যদি দণ্ড সৎ ও অসতের বিচার না করিত, তাহা হইলে এই জীবলোক গাঢ়তিমিরপরিবৃতের ন্যায় লক্ষিত হইত; আর কোন বিষয়ই অনুভূত হইত না। দেখুন, বেদনিন্দক নাস্তিকদিগকে দণ্ডপ্রভাবে নিপীড়িত হইয়া অবিলম্বে নিয়ম অবলম্বন করিতে হয়। ফলতঃ সমুদয় লোকই দণ্ডের আয়ত্ত। যথার্থ শুদ্ধস্বভাবসম্পন্ন লোক নিতান্ত দুর্লভ। বিধাতা বর্ণচতুষ্টয়ের ভেদনিৰ্দেশ, উৎকৃষ্ট নীতিপ্রবর্ত্তন এবং ধর্ম্ম ও অর্থ রক্ষা করিবার নিমিত্তই দণ্ডের সৃষ্টি, করিয়াছেন। দণ্ডভয় না থাকিলে বায়স ও হিংস্র পশুগণ যজ্ঞীয় হবিঃ এবং অন্যান্য পশুও মনুষ্যগণকে ভক্ষণ করিত। মনুষ্যেরা বেদাধ্যয়ন ও সবৎসা ধেনু[গাভী] দোহন করিত না, স্ত্রীলোকের ব্যভিচারিণী হইত; সমস্ত বস্তু উচ্ছিন্ন ও নিয়মাবলী বিলুপ্ত হইয়া যাইত, সকলে সকল বস্তুই আপনার বলিয়া পরিগ্রহ করিতে পারিত; প্রভূতদক্ষিণাসম্পন্ন সংবৎসরব্যাপী যজ্ঞসমুদয় নির্ব্বিঘ্নে সম্পন্ন হইত না, কেহই বিধানানুসারে আশ্ৰমধৰ্ম্ম প্রতিপালন ও বিদ্যানুশীলন করিত না। উষ্ট্র, বলীবর্দ্দ [বলদ], অশ্ব, অশ্বতর [খচ্চর] ও গর্দ্দভেরা যানবাহনে প্রবৃত্ত হইত না; ভৃত্যেরা প্রভুর আজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইত এবং বালিকা পিতার আদেশ উল্লঙ্ঘন করিয়া অধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিত। ফলতঃ সমস্ত প্রজা দণ্ডেরই একান্ত বশবর্ত্তী। মনুষ্যেরা দণ্ডপ্রভাবে স্বর্গলাভ ও ভূলোকে সুখে বাস করিয়া থাকে। যে স্থানে শত্রুবিনাশ দণ্ড বিরাজমান আছে, তথায় পাপ ও প্রতারণার কিছুমাত্র প্রাদুর্ভাব নাই। যদি দণ্ড উদ্যত থাকিত, তাহা হইলে কুকুর হবিঃ নিরীক্ষণ করিবামাত্রই অবলেহন [জিহ্বাদ্বারা আস্বাদগ্রহণ—চাটা] ও কাকসকল পুরোডাশ [যজ্ঞীয় পিষ্টক—যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার পিঠে] অপহরণ করিত, সন্দেহ নাই।

“হে মহারাজ! এক্ষণে এই রাজ্য ধর্ম্মানুসারে বা অধৰ্ম্মানুসারেই হউক, আমাদিগেরই আয়ত্ত হইয়াছে; এ বিষয়ে শোকপ্রকাশ করিবার আর আবশ্যক নাই। অতঃপর আপনি উদ্‌যোগী হইয়া স্বেচ্ছানুসারে এই রাজ্য ভোগ করুন। পরমসুন্দর উৎকৃষ্ট পরিচ্ছদধারী মনুষ্যেরা পুত্রকলত্রসমভিব্যাহারে উৎকৃষ্ট অন্নভোজনপূৰ্ব্বক অক্লেশে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকেন। সমস্ত কার্য্যেই অর্থের প্রয়োজন; সেই অর্থ আবার দণ্ডেরই আয়ত্ত, অতএব আপনি দণ্ডের যে কতদূর গৌরব, তাহা অনুধাবন করিয়া দেখুন। ধৰ্ম্ম লোকাত্ৰানির্ব্বাহের নিমিত্তই সংস্থাপিত হইয়াছে। যদি কেহ প্রবল জন্তুকে দুর্ব্বল জন্তুর বিনাশার্থ উদ্যত দেখিয়া প্রবলের বিনাশসাধন না করে, তাহা হইলে তাহাকে সেই দুর্ব্বল জন্তুর হিংসায় একপ্রকার হস্তক্ষেপ করা হয়, অতএব সেস্থলে প্রবল জন্তুকে বিনাশ করিয়া দুর্ব্বলকে পরিত্রাণ করাই প্রধান ধৰ্ম্ম। সকল কার্য্যেই আংশিক দোষ ও আংশিক গুণ থাকে। কোন কার্য্যই সম্পূর্ণ দোষযুক্ত বা সম্পূর্ণ গুণসম্পন্ন হয় না। মনুষ্যেরা পশুগণের বৃষণ ছেদ [অণ্ডকোষ ছেদন— ষাঁড়কে কোষ ছাড়াইয়া বলদ করিয়া] ও নাসিকা ভেদ করিয়া [গো-মহিষাদির নাকে ছেঁদা করিয়া—নাকে দড়ি দিয়া] তাহাদের দ্বারা ভারবহন করাইয়া লয় এবং তাহাদিগকে প্রহারও করিয়া থাকে। জীবলোকের সমুদয় কাৰ্য্যই এইরূপে দণ্ডপ্রভাবে নির্ব্বাহ হইতেছে; অতএব আপনি নীতিপথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক পূর্ব্বতন ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করুন। যজ্ঞানুষ্ঠান, দান, প্রজাপালন, মিত্রগণের রক্ষা ও শত্ৰুদিগের বিনাশসাধনপূর্ব্বক স্বধৰ্ম্ম-প্রতিপালনে প্রবৃত্ত হউন, শত্রুবিনাশবিষয়ে দীনভাব অবলম্বন করিবেন না; শাস্ত্রানুসারে শত্রু বিনাশ করিলে কিছুমাত্র পাপ জন্মে না। শস্ত্রদ্বারা আততায়ী ব্রাহ্মণকে বিনাশ করিলেও ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না। কারণ, ক্রোধই ঐ হত্যার মূলীভূত। বিশেষতঃ আত্মা অবধ্য; সুতরাং আত্মাকে বিনাশ করা কখনই সম্ভবপর নহে। যেমন কোন ব্যক্তি পুরাতন গৃহ পরিত্যাগ করিয়া নূতন গৃহে প্রবেশ করে, তদ্রূপ জীবাত্মা এক শরীর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্য কলেবর আশ্রয় করিয়া থাকে। তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতেরা উহাকেই মৃত্যু বলিয়া নির্দেশ করেন।”