১৬. বনবাসার্থ কুন্তীর ধৃতরাষ্ট্রসহ গমন

বনবাসার্থ কুন্তীর ধৃতরাষ্ট্রসহ গমন

বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্র রাজপথে সমুপস্থিত হইলে, অট্টালিকা ও অন্যান্য স্থানসমুদয় হইতে স্ত্রী-পুরুষদিগের ক্রন্দনকোলাহল শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। তখন অন্ধরাজ বিনীতভাবে অতিকষ্টে ক্রমে ক্রমে সেই নরনারীসঙ্কুল রাজমার্গ অতিক্রমপূৰ্ব্বক হস্তিনানগরের অত্যুচ্চ বহিদ্বার হইতে বহির্গত, হইয়া অনুগামী ব্যক্তিদিগকে বিদায় করিতে লাগিলেন। মহাবীর কৃপাচার্য্য ও যুযুৎসু ধৃতরাষ্ট্রকর্ত্তৃক যুধিষ্ঠিরের হস্তে সমর্পিত হইয়া বনগমনবাসনা পরিত্যাগ করিলেন। কিন্তু মহাত্মা বিদুর ও সঞ্জয় কিছুতেই নিবৃত্ত না হইয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন।

অনন্তর ক্রমে ক্রমে সমুদয় পৌরবর্গ প্রতিনিবৃত্ত হইলে, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠতাতের আজ্ঞানুসারে কামিনীগণের সহিত নগরমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে বাসনা করিয়া স্বীয় জননী কুন্তীকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মাতঃ! আপনি বধূগণের সহিত নগরে প্রতিনিবৃত্ত হউন, বরং আমি জ্যেষ্ঠতাতের সহিত অরণ্যে গমন করি। ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা কৌরবনাথ তপস্যা করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়াছেন, সুতরাং উহারই এক্ষণে অরণ্যবাস আশ্রয় করা কৰ্ত্তব্য।”

বনবাসে যুধিষ্ঠিরাদির নিষেধ—কুন্তীর উপেক্ষা

পাণ্ডবজননী কুন্তী ধৰ্ম্মরাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া বাষ্পকুলিতলোচনে গান্ধারীকে ধারণপূর্ব্বক গমন করিতে করিতে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! তুমি সহদেবের প্রতি কখন তাচ্ছিল্য করিও না। সে তোমার ও আমার প্রতি একান্ত অনুরক্ত। আর পূর্ব্বে আমি দুর্বুদ্ধিবশতঃ যে মহাবীরকে তোমাদের বিপক্ষে সংগ্রাম করিতে অনুমোদন করিয়াছিলাম, সেই মহাত্মা কর্ণও যেন তোমার স্মৃতিপথের বহির্ভূত না হয়। হায়! আমার তুল্য অভাগ্যবতী আর কেহই নাই। যখন সূৰ্য্যতনয় বৎস কর্ণকে না দেখিয়া আমার হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হইতেছে না, তখন নিশ্চয় বুঝিলাম, উহা লৌহদ্বারা নির্ম্মিত হইয়াছে। পূৰ্ব্বে যখন আমি তোমার নিকট তাহার পরিচয় প্রদান করি নাই, তখন আমাকেই তাহার বধবিষয়ে সম্পূর্ণ অপরাধিনী বলিতে হইবে। যাহা হউক, এখন আর তাহার কিছুমাত্র প্রতিকার হইবার সম্ভাবনা নাই। এক্ষণে তুমি ভ্রাতৃগণের সহিত সমবেত হইয়া তোমার সেই জ্যেষ্ঠভ্রাতার সদ্গতির নিমিত্ত বিবিধ ধনদান করিবে। কদাপি দ্রৌপদীর অপ্রিয়াচরণ করিও না। সৰ্ব্বদা ভীমসেন, অর্জ্জুন ও নকুলের রক্ষণাবেক্ষণ করিবে। আজ কুরুকুলের ভার তোমার উপর সম্পূর্ণরূপে অর্পিত হইল। আমি এক্ষণে অরণ্যে গমন করিয়া তপানুষ্ঠান এবং তোমার জ্যেষ্ঠতাত ও গান্ধারীর শুশ্রূষা করিব।”

মনস্বিনী কুন্তী এই কথা কহিলে ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা যুধিষ্ঠির নিতান্ত দুঃখিত হইয়া, ভ্রাতৃগণের সহিত ক্ষণকাল অপোবদনে চিন্তা করিয়া জননীকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মাতঃ! এক্ষণে আপনার বুদ্ধি এরূপ বিচলিত হইল কেন? আমার প্রতি এরূপ নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। আমি কখনই আপনার বনগমনবিষয়ে অনুমোদন করিতে পারিব না। আপনি আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হউন। পূৰ্ব্বে মহাত্মা বাসুদেবের নিকট বিদুলার বাক্যসমুদয় কীৰ্ত্তনপূর্ব্বক আমাদিগকে বিবিধরূপে উৎসাহ প্রদান করিয়া এক্ষণে এরূপ কঠিন বাক্য প্রয়োগ করা আপনার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। আমরা বাসুদেবের মুখে আপনার উপদেশ শ্রবণপূৰ্ব্বক আপনার বুদ্ধিবলে ভূপতিদিগকে নিপাতিত করিয়া রাজ্যলাভ করিয়াছি। এক্ষণে আপনার সেই বুদ্ধি ও জ্ঞান কোথায় গেল? আমাকে ক্ষাত্রধর্ম্ম আশ্রয় করিতে অনুজ্ঞা করিয়া এক্ষণে আমায় পরিত্যাগ করা আপনার কখনই কৰ্ত্তব্য নহে। আপনি রাজ্য ও আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া কিরূপে গহনকাননে বাস করিবেন? অতঃপর আপনি আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হউন।”

পাণ্ডবজননী কুন্তী ধৰ্ম্মরাজের এইরূপ করুণবাক্য শ্রবণ করিয়াও প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। তিনি অপূর্ণলোচনে অন্ধরাজের অনুগমন করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা ভীমসেন তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মাতঃ! এক্ষণে পুত্রনির্জ্জিত রাজ্যভোগ ও রাজধৰ্ম্মসমুদয় লাভ করিয়া আপনার এরূপ বুদ্ধিবিপর্য্যয় উপস্থিত হইল কেন? যদি আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া বনে গমন করাই আপনার অভিপ্রায় ছিল, তবে আপনি কেন আমাদিগের দ্বারা পৃথিবীকে বীরশূন্যা করিলেন? আর আমরা যৎকালে নিতান্ত বালক ছিলাম, তখনই বা কি নিমিত্ত আমাদিগকে ও মাদ্ৰীতনয়কে বন হইতে আনয়ন করিয়াছিলেন? এক্ষণে আপনি প্রসন্ন হইয়া বনগমনের বাসনা পরিহারপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজের বাহুবলার্জ্জিত রাজ্যভোগ করুন।”

ভীমসেন ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ এইরূপে বহুবিধ বিলাপ করিলেও মহানুভবা কুন্তী বাগমন-বাসনা পরিত্যাগ করিলেন না। তখন মনস্বিনী দ্রৌপদী বিষণ্নবদনে রোদন করিতে করিতে সুভদ্রার সহিত তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। কুন্তী তাহাতেও ক্ষান্ত হইয়া রোরুদ্যমান পুত্রদিগকে বারংবার সস্নেহনয়নে নিরীক্ষণ করিতে করিতে অন্ধরাজের অনুগমন করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা পাণ্ডবগণ নিতান্ত বিষণ্নচিত্তে ভৃত্য ও পরিজনবর্গের সহিত জননীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।