২১. জরাসন্ধ কর্তৃক নিজ অপরাধ জিজ্ঞাসা

জরাসন্ধ কর্তৃক নিজ অপরাধ জিজ্ঞাসা

জরাসন্ধ কহিলেন, “হে বিপ্ৰগণ! আমি কোন সময়ে তোমাদের সহিত শক্রতা বা তোমাদের অপকার করিয়াছি, তাহা আমার স্মরণ হইতেছে না। তবে কি নিমিত্ত বিনাপরাধে তোমরা আমাকে শত্রুজ্ঞান করিতেছ? দেখ, ধর্ম্ম বা অর্থের উপঘাত [বাধা-বিরুদ্ধভাব] দ্বারাই মনঃপীড়া জন্মে; কিন্তু যে ব্যক্তি ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া ধর্ম্মজ্ঞ হইয়া বিনাপরাধে লোকের ধর্ম্মার্থে উপঘাত করে, তাহার ইহকালে অমঙ্গল ও পরকালে নরকে গমন হয়; সন্দেহ নাই। আর দেখ, ত্ৰিলোকীমধ্যে সৎপথগামিগণের পক্ষে ক্ষত্রধর্ম্মই শ্রেষ্ঠ; ধর্ম্মবিৎ ব্যক্তিরা কেবল ক্ষাত্রধর্মেরই প্ৰশংসা করিয়া থাকেন। আমি স্বধর্মে নিরত প্ৰজাগণের কোন অপকার করি নাই; তবে তোমরা কি নিমিত্ত আমাকে শত্রু বলিয়া স্থির করিয়াছ? বোধ হয়, তোমাদের প্রমাদ হইয়া থাকিবে।”

শ্ৰীকৃষ্ণসহ ভীমাদির আত্মপ্রকাশ

শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে মহাবাহো! যে কুল-প্রদীপ একাকী কুলকার্য্যের ভার বহন করিতেছেন, আমরা তাঁহার নিয়োগক্রমে তোমার প্রতি সমুদ্যত হইয়াছি। হে রাজন! ক্ষত্ৰিয়গণকে পূজোপহার-স্বরূপ করিবার মানস করাতে তুমি যৎপরোনাস্তি অপরাধী হইয়াছ, তবে কি বলিয়া আপনাকে নিরাপরাধ বোধ কর? হে নৃপসত্তম! নিরপরাধ অন্যান্য ভূপতিগণের প্রতি হিংসাচরণ করা কি রাজার কর্তব্য কর্ম্ম? তবে তুমি কি জন্য নৃপতিগণকে আনয়নপূর্ব্বক মহাদেবের নিকট উপহার প্রদান করিতে বাসনা করিয়াছ? হে বৃহদ্রাথনন্দন! আমাদিগকেও ত্বৎকৃত পাপে পাপী হইতে হইবে, যেহেতু, আমরা ধর্ম্মচারী ও ধর্ম্মরক্ষণে সমর্থ। আমরা কখন নরবলি দেখি নাই; তুমি কি বলিয়া নরবলি প্রদানপূর্ব্বক ভগবান পশুপতির পূজা করিতে বাসনা করিতেছ? রে বৃথামোত জরাসন্ধ! তোমা ব্যতিরেকে আর কোন ব্যক্তি সুবর্ণের পশুসংজ্ঞা করিতে পারে? দেখ, যে ব্যক্তি যে যে অবস্থায় যে যে কর্ম্ম করে, সে সেই সেই অবস্থায় তাহার ফলভাগী হয়। আমরা দুঃখার্ত ব্যক্তির অনুসরণ করিয়া থাকি; তুমি জ্ঞাতিক্ষয়কারী, অতএব আমরা এক্ষণে জ্ঞাতি-বৃদ্ধির নিমিত্ত তোমাকে সংহার করিতে সমাগত হইয়াছি। তুমি মনে মনে স্থির করিয়াছ যে, এই ভূমণ্ডলমধ্যে ক্ষত্ৰিয়কুলে তোমার ন্যায় ক্ষমতাশালী পুরুষ আর কেহই নাই, সে কেবল তোমার বুদ্ধিভ্রমমাত্র। কোন স্বজাতীয় পক্ষপাতী ক্ষত্ৰিয়কুলসভূত ভূপতি আত্মীয়জনরক্ষার্থে যুদ্ধে প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক অতুল স্বৰ্গভোগ করিতে বাসনা না করে? দেখ, ক্ষত্ৰিয়গণ স্বৰ্গে থাকিয়াও রণযজ্ঞে দীক্ষিত হইয়া লোকদিগকে জয় করেন। হে রাজন! বেদাধ্যয়ন, মহৎ যশঃ, তপানুষ্ঠান ও যুদ্ধে মৃত্যু, এই সমুদয়ই স্বর্গের হেতু বটে, কিন্তু নিয়মপূর্ব্বক বেদাধ্যায়নাদি না করিলে স্বৰ্গপ্রাপ্তি হয় না; কিন্তু যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিলে স্বৰ্গলাভ হইবে, উহাতে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম নাই। দেখ, সুরপতি ইন্দ্র স্বীয় গুণবান পুত্ৰ জয়ন্তের প্রভাবে অসুরগণকে পরাজয় করিয়া জগৎপালন করিতেছেন। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমাদের সহিত শত্রুতা তোমার পক্ষে যেরূপ স্বৰ্গগমনের হেতু হইতেছে, সেরূপ আর কাহারও ঘটে না। তুমি বহুসংখ্যক মাগধ সৈন্যের বলে দর্পিত হইয়া অন্যান্য ব্যক্তিগণকে অপমান করিও না। প্রত্যেক ব্যক্তিরই পরাক্রম আছে। এই ভূমণ্ডলে তোমার সমতেজঃ ও তোমা অপেক্ষা অধিক তেজস্বী অনেক আছেন। হে রাজন! এই বিষয় অজ্ঞাত থাকাতেই তোমার এতাদৃশ অহঙ্কার হইয়াছে। উহা আমাদের নিতান্ত অসহ্য হওয়াতে তোমাকে জানাইয়া দিলাম। হে ভূপতে! তুমি সদৃশ ব্যক্তির উপর অভিমান ও দর্প পরিত্যাগ কর, নতুবা পুত্র, অমাত্য ও সৈন্যগণসমভিব্যাহারে যমালয়ে গমন করিতে হইবে। মহারাজ কর্তবীৰ্য্য, উত্তর ও বৃহদ্ৰথ অতিদৰ্পে আপন আপন মঙ্গলের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া সসৈন্যে বিনষ্ট হইয়াছেন। হে রাজন! তোমাকে কপটে সংহার করিবার মানসে এরূপ বেশ পরিগ্রহ করিয়াছি, আমরা বস্তুতঃ ব্ৰাহ্মণ নহি, ক্ষত্রিয়। আমি বসুদেবনন্দন কৃষ্ণ, আর এই দুই বীরপুরুষ পাণ্ডুতনয়। আমরা তোমাকে যুদ্ধ করিতে আহ্বান করিতেছি, এক্ষণে হয় সমস্ত ভূপতিগণকে পরিত্যাগ কর, না হয় যুদ্ধ করিয়া যমালয়ে গমন কর।”

জরাসন্ধ কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! আমি কোন রাজাকেও জয় না করিয়া আনয়ন করি নাই। যাহাকে আমি পরাজয় করি নাই এবং যে আমার সহিত বিরোধ করিতে সমর্থ, এই ভূমণ্ডলে এমত কোন ব্যক্তি আছে? হে বাসুদেব! বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক লোককে আপনার বশে আনিয়া তাহার প্রতি স্বেচ্ছানুসারে ব্যবহার করাই ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম্ম। আমি ক্ষত্ৰিব্ৰতাবলম্বী; দেবপূজার নিমিত্ত রাজগণকে আনয়ন করিয়াছি; এখন কি নিমিত্ত ভয় পাইয়া তাঁহাদিগকে পরিত্যাগ করিব? আমি একাকী বৃহমধ্যস্থিত এক, দুই বা তিন মহারথের সহিত এককালে বা পৃথক পৃথক যুদ্ধ করিতে পারি।”

মহারাজ জরাসন্ধ এই কথা বলিয়া ঐ ভীমকর্ম্মা ব্যক্তিগণের সমভিব্যাহারে যুদ্ধ করিবার অভিলাষে স্বীয় পুত্ৰ সহদেবের রাজ্যাভিষেকে আজ্ঞা করিলেন এবং কৌশিক ও চিত্ৰসেন নামক দুই সেনাপতিকে আহ্বান করিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ সত্যসন্ধ হলধরানুজ মধুসূদন ঐ ভীমপরাক্রম শার্দুলসমবিক্রান্ত বৃহদ্ৰথতনয় জরাসন্ধাকে যাদবগণের অবধ্য স্মরণ করিয়া ব্ৰহ্মার আদেশানুসারে স্বয়ং তাহার সংহারে প্রবৃত্ত হইলেন না।