০০২. ব্ৰাহ্মণগণের পাণ্ডবসহ বনগমনেচ্ছা!

২য় অধ্যায়

ব্ৰাহ্মণগণের পাণ্ডবসহ বনগমনেচ্ছা!

বৈশম্পায়ন কহিলেন, রজনী প্ৰভাত হইলে ভিক্ষাভোগী ব্রাহ্মণগণ বনগমনোন্মুখ পাণ্ডবগণের পুরোভাগে উপস্থিত হইলেন। রাজা যুধিষ্ঠির তাহাদিগকে কহিলেন, “আমরা গতসর্ব্বস্ব, হৃতরাজ্য ও শ্ৰীভ্রষ্ট হইয়াছি; এক্ষণে ফলমূলামিষাহারী হইয়া অরণ্যে গমন করিতেছি, অরণ্য হিংস্র-জন্তুপরিপূর্ণ অতি ভয়ঙ্কর স্থান; তথায় গমন করিলে আপনাদের ক্লেশের পরিসীমা থাকিবে না; ব্রাহ্মণগণের ক্লেশে আমার কথা দূরে থাকুক, দেবতাগণকেও অবসন্ন হইতে হয়; অতএব আপনারা এই স্থান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হউন।”

ব্ৰাহ্মণগণ কহিলেন, “রাজন! আপনাদের যে গতি, আমরাও সেই গতি প্ৰাপ্ত হইতে উদ্যত হইয়াছি। আমরা ধমর্দ্দশী ও আপনাতে নিতান্ত অনুরক্ত, আমাদিগকে প্রত্যাখ্যান করা আপনার উচিত নহে। দেবতারাও অনুরক্তগণ, বিশেষতঃ ধর্ম্মচারী ব্রাহ্মণগণের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করিয়া থাকেন; অতএব আমাদিগের পরিত্যাগ করিবেন না।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দ্বিজগণ! আমি ব্রাহ্মণগণের প্রতি যথেষ্ট ভক্তি করিয়া থাকি, কিন্তু এই নিরবলম্ব অবস্থা আমাকে অবসন্ন করিতেছে। যাহারা ফল, মূল ও মৃগ আহরণ করিয়া আপনাদিগকে প্রতিপালন করিবেন, সেই ভ্রাতৃগণ দ্রৌপদীর নিগ্ৰহ ও রাজ্যপহরণ-জনিত শোক-দুঃখে বিমোহিত আছেন, আমি তাঁহাদিগকে ক্লেশকর কর্ম্মে নিয়োগ করিতে পারিব না।”

ব্ৰাহ্মণেরা কহিলেন, “মহারাজ! আমাদের ভরণপোষণ জন্য চিন্তা করিবেন না, আমরা স্বয়ং অন্নাহরণপূর্ব্বক জীবন-ধারণ করিয়া জপ ও ধ্যান দ্বারা আপনাদের মঙ্গল-বিধান এবং মনোহর উপাখ্যান কথন দ্বারা চিত্তবিনোদন করিব।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দ্বিজগণ হইতে আমার সকল শোকসন্তাপ দূরীভূত হইবে, তাহাতে সন্দেহ কি? কিন্তু আমি আপনার অসমৰ্থতাবশতঃ তদ্বিষয়ে হতাশ হইতেছি। হে বিপ্ৰগণ! আপনারা কেবল আমার প্রতি অনুরাগ করিয়া যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ভোগ ও স্বয়ং আহরণ করিয়া ভোজন করিবেন, ইহা আমি কি প্রকারে দর্শন করিব? আঃ পাপাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ! তোমাদিগকে ধিক!” এই বলিয়া যুধিষ্ঠির শোকাভিভূত হইয়া ভূমিতলে উপবিষ্ট হইলেন।

ঋষি শৌনকের সযৌক্তিক উক্তি

তখন অধ্যাত্মতত্ত্ববিৎ সাংখ্যযোগাভিজ্ঞ শৌনক নামা দ্বিজ যুধিষ্ঠিরকে তদাবস্থা অবলোকন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! শোকস্থান সহস্ৰ সহস্র এবং ভয়স্থান শত শত আছে। শোক ও ভয় মূঢ় ব্যক্তিকেই প্রতিদিন আক্রমণ করে, পণ্ডিতের কিছুই করিতে পারে না। ভবাদৃশ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা জ্ঞানবিরুদ্ধ, বহু-দোষাকর, অশ্রেয়স্কর কর্ম্মে কদাচ আসক্ত হয়েন না। হে রাজন! আপনার বুদ্ধি অষ্টাঙ্গসম্পন্ন, অশিবনাশিনী ও শ্রুতিস্মৃতির অনুগামিনী, অতএব ভবাদৃশ ব্যক্তিরা কি অর্থকৃচ্ছ্র কি দুৰ্গতি, কি আত্মীয়জনের বিপদ, কি শারীরিক ও মানসিক দুঃখ কিছুতেই অবসন্ন হয়েন না। পূর্ব্বকালে মহাত্মা জনক যে সকল আত্মব্যবস্থাপক শ্লোক গান করিয়া গিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করুন। বিশ্বসংসার শারীরিক ও মানসিক এই দ্বিবিধ দুঃখে পীড়িত হইয়া আছে, যে উপায় দ্বারা তাহার প্রত্যেক বা সমুদয়ের উপশম করা যায়, তাহা কহিতেছি। ব্যাধি, অনিষ্টপাত, পরিশ্রম ও ইষ্টবিনাশ এই চতুর্ব্বিধ কারণ শারীরিক দুঃখের প্রবর্ত্তক। প্রতিকার দ্বারা ব্যাধির ও অননুধ্যান দ্বারা আধির শান্তি হয়। এই নিমিত্ত বুদ্ধিমান বৈদ্যেরা প্ৰথমেই প্রিয়কথন ও ভোগ্যবিষয় প্ৰদান করিয়া মানবের মানসিক দুঃখ প্রশমিত করেন। যেমন আয়ঃপিণ্ড [লৌহগোলক-লৌহনির্ম্মিত গোলাকার বস্তু] পরিতপ্ত হইলে তদ্বারা কুম্ভস্থিত জলও উত্তপ্ত হইয়া উঠে, সেইরূপ মানসিক দুঃখ উপস্থিত হইলে শরীরও পরিতাপিত হয়। যেমন জল দ্বারা অগ্নি নির্ব্বাপিত করিতে হয়, সেইরূপ জ্ঞান দ্বারা মানসিক দুঃখ বিনাশ করিবে। মনোব্যথা প্রশমিত হইলে শারীরিক দুঃখও বিনষ্ট হইয়া যায়। স্নেহ মানসিক দুঃখের মূল; জীবগণ স্নেহপরতন্ত্র হইয়া দুঃখ প্রাপ্ত হয়। স্নেহ কেবল দুঃখের মূল, এমত নহে, উহা ভয়, শোক, হর্ষ এবং আয়াসেরও প্রবর্ত্তক; স্নেহ হইতে মনের বিকৃতি ও বিষয়াশক্তি উৎপন্ন হয়। এই দুই দোষের মধ্যে প্রথমটি অতিশয় গুরুতর। কোটরস্থিত অগ্নি যেমন বৃক্ষের সমুদয় অংশ ভস্মসাৎ করে, সেইরূপ বিষয়াসক্তি অত্যল্প হইলেও সমুদয় ধর্ম্মার্থ ধ্বংস করিয়া থাকে। বিষয় হইতে বিমুক্ত হইলেই বিষয়ত্যাগী হয় না; কিন্তু যে ব্যক্তি বিষয়-সমাগমসময়েও দোষদর্শী, নির্ব্বিরোধ ও নিরবগ্রহ [বিপদে অনভিভূত] হয়, সেই ব্যক্তিই যথার্থ বৈরাগ্যলাভ করে। অতএব অর্থসঞ্চয় দ্বারা মিত্ৰগণ হইতে মোহলাভ করিবার অভিলাষ করিবে না এবং জ্ঞান দ্বারা স্বীয় স্নেহকে বিনিবর্ত্তিত করিবে। জল যেমন পদ্মাপত্রে সংসাক্ত হইতে পারে না, সেইরূপ মোহও জ্ঞানবান, কৃতাত্মা, শাস্ত্ৰজ্ঞ যোগীতে আসক্ত হইতে পারে না।

“বিষয়ানুরাগ হইতে কামনা উৎপন্ন হয়, কামনা হইতে ইচ্ছা! জন্মে, ইচ্ছা হইতে তৃষ্ণা সংবৰ্দ্ধিত হয়। এই সর্ব্বপাপময়ী তৃষ্ণ নিয়ত উদ্বেগকারী, অধর্ম্মবহুলা এবং পাপপ্ৰসবিনী। দুর্ম্মতিগণ যাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারে না, পুরুষ জীৰ্ণ হইলেও যে জীর্ণ হয় না, সেই প্রাণান্তকারী রোগস্বরূপ তৃষ্ণাকে যে ব্যক্তি পরিত্যাগ করিতে পারে, সেই-ই যথার্থ সুখী। এই তৃষ্ণা নরগণের পরিমিত দেহের অন্তর্গত বটে, কিন্তু ইহার আদিও নাই, অন্তও নাই; ইহা অযোনিজ অনলের ন্যায় সমস্ত প্রাণীকে বিনষ্ট করে। কাষ্ঠ যেমন স্বসমুত্থিত হুতাশনে দগ্ধ হয়, সেইরূপ অকৃতাত্মা ব্যক্তি সহজাত লোভদ্বারা বিনষ্ট হইয়া থাকে। প্রাণীগণ যেরূপ মৃত্যুকে ভয় করে, সেইরূপ অর্থবান ব্যক্তি রাজা, সলিল, অগ্নি, চৌর ও স্বজন হইতে প্রতিনিয়ত ভয়প্রাপ্ত হয়। যেমন আমিষ আকাশে থাকিলে পক্ষিগণ, ভূতলে থাকিলে শ্বাপদগণ ও সলিলে থাকিলে মৎস্যগণ ভক্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ ধনবান ব্যক্তি যেখানে থাকুক, সর্ব্বত্রই আক্রান্ত হয়। কোন কোন ব্যক্তির অর্থ কেবল অনার্থের মূল হইয়া উঠে। যে ব্যক্তি অর্থে একান্ত আসক্ত, সে অন্য কোন প্রকার শ্ৰেয়ঃই লাভ করিতে পারে না। এই জন্য প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সর্ব্বপ্রকার অর্থগমকে লোভ, মোহ, ভয়, কৃপণতা, দৰ্প, অভিমান ও উদ্বেগের মূলীভূত বলিয়া জানেন। লোকে অর্থের উপার্জ্জন, রক্ষণ ও ব্যয় এই তিন বিষয়েই যৎপরোনাস্তি ক্লেশ সহ্য করিয়া থাকে; অনেকে অর্থের নিমিত্ত প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করে। অজ্ঞ ব্যক্তিরা দুঃখ নিবারণের নিমিত্ত অতিকষ্টে অর্থরূপ শক্রকে লাভ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে, কিন্তু উহা যে প্ৰাণনাশের কারণ হইয়া উঠে, তাহা একবারও চিন্তা করে না।

“মূঢ় ব্যক্তিরাই অসন্তোষপরায়ণ হয়, পণ্ডিতগণ সর্ব্বদা সন্তুষ্ট থাকেন; পিপাসার অন্ত নাই; সন্তোষই পরম সুখ; এই জন্য পণ্ডিতগণ এই সংসারে সন্তোষকে প্রধান বলিয়া জানেন।

“রূপ, যৌবন, রত্নসঞ্চয়, ঐশ্বৰ্য্য এবং প্ৰিয়নিবাস সকলই অনিত্য, পণ্ডিতগণ এই সমস্ত অচিরস্থায়ী বিষয়ে কদাচ লোভ করেন না। ধনসঞ্চয় সর্ব্বতোভাবে পরিত্যাগ করিবে। কোন সঞ্চয়ী ব্যক্তিকেই নিরুপদ্রব দেখিতে পাওয়া যায় না; এই নিমিত্ত ধার্ম্মিক পুরুষেরা অর্থোপার্জ্জনপরাঙ্মুখ ব্যক্তিকেই প্রশংসা করিয়া থাকেন। যিনি ধর্ম্মকাৰ্য্যে ব্যয় করিবার নিমিত্ত অর্থোপার্জ্জন করিতে চেষ্টা করেন, তাহার সে চেষ্টা না করাই শ্ৰেয়ঃ। পঙ্কলিপ্ত হইয়া পুনরায় তাহা প্ৰক্ষালন করা অপেক্ষা পঙ্ক স্পর্শ না করাই উচিত। অতএব হে যুধিষ্ঠির! আপনি সকল বিষয়ে নিম্পৃহ হউন; যদি ধর্ম্মোপার্জ্জনে অভিলাষ থাকে, তাহা হইলে অর্থাকাঙক্ষা পরিত্যাগ করুন।’

শৌনকবাক্যে যুধিষ্ঠিরের প্রত্যুত্তর

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মান্‌! স্বয়ং উপভোগ করিবার নিমিত্ত আমি অর্থলাভের ইচ্ছা করিতেছি না। আমার অর্থাকাঙ্ক্ষা কেবল বিপ্ৰগণের ভরণপোষণ করিবার নিমিত্ত, লোভপ্রযুক্ত নহে। মাদৃশ গৃহস্থেরা অনুগতজনের ভরণপোষণ না করিয়া কিরূপে ক্ষান্ত থাকিতে পারে? দেখিতে পাওয়া যায় যে, সকল প্রাণীই বিভাগ করিয়া ভোজন করে এবং যাহারা স্বয়ং পাক করেন না, গৃহস্থগণ তাঁহাদিগকে অন্নদান করিয়া থাকেন। সাধুগণের গৃহে তৃণ, ভূমি, জল ও সুনৃতবাক্য এই চারি দ্রব্যের কোন কালেই অপ্রতুল থাকে না। গৃহস্থ ব্যক্তি পীড়িত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্ৰান্ত ব্যক্তিকে আসন, তৃষিত ব্যক্তিকে পানীয়, ক্ষুধিত ব্যক্তিকে ভোজন ও অভ্যাগত ব্যক্তির প্রতি নয়ন [অবধান-পূর্ণমনোযোগ], মন ও প্ৰিয়বাচন প্রয়োগ এবং উত্থানপূর্ব্বক আসন প্রদান করিবেন, ইহাই সনাতন ধর্ম্ম। প্রত্যুত্থানপূর্ব্বক সকলের সমীপে গমন ও ন্যায়তঃ সকলের অৰ্চনা করা উচিত। অগ্নিহোত্ৰ, বৃষভ, জ্ঞাতি, অতিথি, বান্ধব, পুত্র, কলাত্র ও ভৃত্যগণ ইহারা সৎকার প্রাপ্ত না হইলে গৃহস্থকে দগ্ধ করে। আপনার নিমিত্ত অন্ন পাক করিবে না, বৃথা পশুহিংসা করিবে না এবং যাহা বিধিপূর্ব্বক বপন করা হয় নাই, স্বয়ং তাহা উপযোগ করিবে না। সায়ং ও প্রাতঃকালে কুকুর, চণ্ডাল এবং পক্ষিগণের উদ্দেশে ভূমিতে অন্নবপনারূপ বৈশ্বদেবনামক বলিপ্ৰদান করিবে। ভুক্তশেষ বিঘাস [দেবতা-পিতৃগণের ভুক্তাবশিষ্ট অন্ন] ও যজ্ঞশেষ অমৃতস্বরূপ হয়; অতএব লোকে প্রতিদিন বিঘসাশী ও অমৃতভোজী হইবে। গৃহস্থ সকল কর্ম্মে চক্ষু ও মন প্রদান করিবে, সতত সুনৃতবাদী [সত্যবাদী] হইবে; এবং সযজ্ঞ ও পঞ্চদক্ষিণা [ব্ৰহ্মযজ্ঞ, 

নৃযজ্ঞ, দৈবযজ্ঞ, পিতৃ যজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ—এই সকলের অনুষ্ঠায়ী] হইয়া অনুগমন ও উপাসনা করিবে। যে ব্যক্তি অদৃষ্টপূর্ব্ব শ্ৰান্ত পথিককে অবিশ্রান্ত অন্নদান করেন, তিনিই মহৎ পুণ্যফল লাভ করেন। হে বিপ্ৰ! যিনি গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়া এই প্রকার ব্যবহার করিতে পারেন, তাহার ধর্ম্মই প্রধান ধর্ম্ম বলিয়া কথিত হইয়াছে। মহাশয়! আপনি কি বোধ করেন?”

শৌনকের প্রত্যুত্তর

শৌনক কহিলেন, “হা! কি কষ্টের বিষয়! এ জগতে কিছুরই সামঞ্জস্য নাই; সাধু ব্যক্তি যে কর্ম্মে লজ্জিত হন, অসজ্জনেরা তাহাতে পরিতুষ্ট থাকে। মোহ, রাগ ও বিষয়ের বশবর্ত্তী মূঢ় লোক শিশ্নোদরপরায়ণ হইয়া জীবন ধারণ করে। যেমন দুষ্ট অশ্ব সারথিকে কুপথে লইয়া যায়, তদ্রূপ ইন্দ্ৰিয়গণ ভ্ৰান্তচেতাঃ মনুষ্যকে কুপথগামী করে। ইন্দ্ৰিয়গণ স্ব স্ব বিষয় প্রাপ্ত হইলেই তাহাদের নিকট পূর্ব্বসঙ্কল্পজনিত মনোবৃত্তির প্রাদুর্ভাব হইয়া উঠে। মূঢ় ব্যক্তির মন যখন ইন্দ্ৰিয়-বিষয়ভোগে ধাবিত হয়, তৎকালে তাহার ঔৎসুক্য ও প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দেয়, তদনন্তর ঐ মূঢ় সঙ্কল্পের বীজভূত কামনা কর্ত্তৃক বিষয়শরে বিদ্ধ হইয়া জ্যোতিলুব্ধ [জ্বালিত অগ্নিদর্শনে আকৃষ্ট] পতঙ্গের ন্যায় লোভাগ্নিতে পতিত হয় এবং পরে যথেচ্ছ আহার বিহারে মুগ্ধ হইয়া ভোগসুখে এরূপ নিমগ্ন থাকে যে, আপনাকেও বুঝিতে পারে না। অজ্ঞ ব্যক্তিরা এই প্রকারে ইহসংসারে অবিদ্যা, কর্ম্ম ও তৃষ্ণা দ্বারা চক্ৰবৎ ভ্ৰাম্যমাণ হইয়া নানা রূপ ধারণপূর্ব্বক কখন জলে, কখন ভূতলে, কখন বা আকাশে পুনঃ পুনঃ জন্মপরিগ্রহ করিয়া ব্ৰহ্মা অবধি তৃণপৰ্য্যন্ত সর্ব্বভূতে পরিবর্ত্তিত হইতে থাকে। হে যুধিষ্ঠির! মূঢ়গণের গতি এই প্রকার; এক্ষণে পণ্ডিতগণের বিষয় শ্রবণ করা। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা মোক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষায় সতত সাবধান হইয়া কল্যাণকর ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন। অতএব হে রাজন! আপনি কর্ম্মকাণ্ড পরিত্যাগপূর্ব্বক এই বেদবাক্যের অনুবর্ত্তী হউন। অভিমানসহকারে ধর্ম্মাচরণ করবেন না। যজ্ঞ, অধ্যয়ন, দান, তপ, সত্য, ক্ষমা, দম এবং আলোভ, এই অষ্ট প্রকার ধর্ম্মের পথ। ইহার মধ্যে পূর্ব্বচতুষ্টয় পিতৃলোক-গমনের উপায়, অভিমান পরিত্যাগ করিয়া কেবল কর্ত্তব্যবোধে তাঁহারই অনুষ্ঠান করা উচিত; আর উত্তর চতুষ্টয় দেবলোক গমনের উপায়; সাধুগণ সতত এই উপায়-চতুষ্টয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। অতএব বিশুদ্ধাত্মা হইয়া এই অষ্টবিধ উপায়ের অনুষ্ঠান করিবে। যাহারা সংসারজয় করিতে ইচ্ছা! করেন, তাহারা সম্যকরূপে সঙ্কল্প, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ, ব্ৰতবিশেষানুষ্ঠান, গুরুসেবা, নিয়মিত আহার, অধ্যয়ন, কর্ম্মফল পরিত্যাগ ও চিত্তনিরোধন করিয়া থাকেন। দেবতারা রাগদ্বেষবিনিম্মুক্ত হইয়া ঐশ্বৰ্য্যলাভ করিয়াছেন। সাধ্যগণ, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয় ইহারা যোগসম্পত্তি দ্বারাই এই সকল প্ৰজা পালন করিতেছেন। অতএব হে কৌন্তেয়! আপনিও সেই প্রকার শম অবলম্বন করিয়া তপঃসিদ্ধি ও যোগসিদ্ধির চেষ্টা করুন। আপনি পিতৃময়ী [ইহলোকে ও পরলোকে ফলপ্ৰদা সিদ্ধি পিতৃমাতৃময়ী], মাতৃময়ী [যজ্ঞবুদ্ধাদি কর্ম্মরূপ সাধনপ্রধানা সিদ্ধি কর্ম্মময়ী] ও কর্ম্মময়ী সিদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছেন, এক্ষণে দ্বিজগণের ভরণপোষণের নিমিত্ত তপঃসিদ্ধির অন্বেষণ করুন। সিদ্ধব্যক্তিরা যাহা ইচ্ছা করেন, তপঃপ্রভাবে তাহাই করিতে পারেন, অতএব তপস্যা অবলম্বন করিয়া আত্মমনোরথ সফল করুন।’