০৬. যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব

৬ষ্ট অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব

বৈশম্পায়ন কহিলেন, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির রমণীয় বিরাটনগরে গমনপূর্ব্বক মনে মনে ত্ৰিভুবনেশ্বরী ভগবতী দুর্গার স্তব করিতে লাগিলেন। “হে যশোদানন্দিনী, নারায়ণপ্রণয়িনি, কুলবিবর্দ্ধিনি, কংসধ্বংসকারিণি, অসুরবিনাশিনি, ভগবতি, বরদে, কৃষ্ণে! আপনাকে নমস্কার। আপনি ব্ৰহ্মচর্য্যস্বরূপ, বাসুদেবের ভগিনী। দুৰ্দান্ত কংস বলপূর্ব্বক আপনাকে আকর্ষণ করিয়া শিলাতলে নিক্ষেপ করিতে উদ্যত হইলে আপনি অনায়াসে তাহার হস্ত হইতে আকাশপথে গমন করিয়াছিলেন। হে ভুবনেশ্বরি! আপনি দিব্য বস্ত্র ও মাল্যে বিভূষিত হইয়াছেন। আপনার করতলে সুতীক্ষ্ন খড়গ ও খেটক শোভা পাইতেছে। হে ত্ৰৈলোক্যতারিণি! যাঁহারা ভূভার অবতারণ জন্য কায়মনোবাক্যে আপনাকে স্মরণ করেন, আপনি দুস্তর পাপপঙ্ক হইতে তাঁহাদিগকে উদ্ধার করিয়া থাকেন।

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সহিত দেবীকে সন্দর্শন করিবার মানসে পুনরায় বহুবিধ স্তব করিতে লাগিলেন, “হে বালার্কসদৃশে, চতুর্ভুজে, চতুর্ব্বক্ত্রে, ময়ুরপিচ্ছবলয়ে, পীনপয়োধরে, পৃথুনিতস্বিনি, কেয়ূরাঙ্গধারিণি দেবি! আপনি লক্ষ্মীর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। আপনার মুখমণ্ডল চন্দ্ৰ-মণ্ডল বিস্পর্ন্ধী [চন্দ্ৰকান্তির ন্যায় স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল], শ্রবণযুগল সুবর্ণকুণ্ডলে বিভূষিত, মুকুট অতি বিচিত্র এবং কেশপাশ পরম-রমণীয়। হে নানা-আয়ুধধারিণি! আপনার বিপুল বাহু শক্ৰধ্বজসদৃশ। আপনি ভুজঙ্গভোগরূপ মেখলাদামে বিভূষিত হইয়া বিষধরপরিদৃত মন্দগিরির শ্ৰী ধারণ করিয়াছেন। শিখিপিচ্ছবিনির্ম্মিত উন্নত ধ্বজদণ্ডে আপনার কি অনির্ব্বাচনীয় শোভা হইয়াছে। হে ত্ৰিদশেখরি! আপনি কৌমারব্ৰত ধারণপূর্ব্বক সুরলোক পবিত্ৰ করিয়াছিলেন বলিয়া ত্ৰিদশগণ নিরন্তর আপনার স্তব ও পূজা করিয়া থাকেন। আপনি ত্ৰৈলোক্য রক্ষা করিবার নিমিত্ত মহাসুর বরদা ও সংগ্রামে বিজয়প্রদা; অতএব এক্ষণে আমার প্রতি প্ৰসন্ন হউন, কৃপা করিয়া আমাকে বিজয় দান করুন। হে সীধু [মদ্য] মাংসপশুপ্রিয়ে, কামচারিণি! নগেন্দ্র বিদ্যাচল আপনার শাশ্বত বাসস্থান, আপনি যাত্ৰা করিলে ভূতগণ আপনার অনুগমন করে [প্রলয়ে ব্ৰহ্মাদি সর্ব্ব-জীব আপনাতে লীন হয়]। হে কালি! হে মহাকালি। যাহারা ভারাবতরণমানসে প্ৰভাতে আপনার স্মরণ ও প্ৰণাম করেন, তাহাদিগের ধনপুত্ৰলাভ দুর্লভ হয় না। হে দুৰ্গে। আপনি দুর্গ হইতে উদ্ধার করেন বলিয়া লোকে আপনাকে দুর্গ বলিয়া থাকে। কান্তারে অবসন্ন, জলধিজলে নিমগ্ন ও দস্যুহস্তে নিপতিত জনের আপনিই একমাত্র গতি। হে দেবি! জলপ্ৰতরণে [জলযানে], কান্তারে ও অটবীতে বিপন্ন হইয়া ভক্তিপূর্ব্বক আপনাকে স্মরণ করিলে আর অবসন্ন হইতে হয় না। হে সুরেশ্বরি! আপনি কীর্ত্তি, লক্ষ্মী, ধূতি, সিদ্ধি, লজ্জা, বিদ্যা, সন্ততি, বুদ্ধি, সন্ধ্যা, রাত্রি, প্রভা, নিদ্রা, জ্যোৎস্না কান্তি, ক্ষমা ও দয়া। আপনার পূজা করিলে নরের বন্ধন, মোহ, পুত্ৰনাশ, ধনক্ষয়, ব্যাধি, মৃত্যু ও ভয় কিছুই থাকে না। হে ভক্তবৎসল, শরণাগতপালিকে, দুর্গে। আমি রাজ্যভ্রষ্ট হইয়াছি; এক্ষণে আপনার শরণাপন্ন, আপনাকে প্ৰণাম করি, আপনি আমাকে রক্ষা করুন।’

যুধিষ্ঠিরের দেবীসাক্ষাৎকার-রাজ্যপ্ৰাপ্তিরূপ বরলাভ

দেবী রাজার এবংবিধ স্তবে পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহার সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে রাজন! আমার প্রসাদে অচিরকালমধ্যে তোমার সংগ্রামে বিজয়লাভ হইবে। তুমি নিখিল কৌরববাহিনী পরাজয় করিয়া ভ্রাতৃগণের সহিত পরম প্রীতিমনে নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগ করিবে এবং তোমার সৌখ্য ও আরোগ্য লাভ হইবে। হে ধর্ম্মরাজ! যে সকল নিম্পাপ ব্যক্তিরা আমার নাম-সঙ্কীর্ত্তন করে, আমি প্রসন্ন হইয়া তাহাদিগকে রাজ্য, আয়ূ অপূর্ব্ব দেহ এবং পুত্ৰ প্ৰদান করি। যাহারা প্রবাস, নগর, শত্ৰুসঙ্কট, সংগ্রাম, কান্তার, গহনকানন, পর্ব্বত ও সাগর প্রভৃতি দুৰ্গম স্থলে বিপন্ন হইয়া এইরূপে আমাকে স্মরণ করে তাহাদিগের কিছুই দুর্লভ থাকে না। যাহারা ভক্তিপূর্ব্বক এই উৎকৃষ্ট স্তোত্র শ্রবণ বা পাঠ করে, তাহাদিগের সমুদয় কাৰ্য্য সিদ্ধ হয়। হে পাণ্ডবগণ! আমি প্রসন্ন হইয়া বলিতেছি, তোমরা বিরাট-নগরে অবস্থিতি করিলে তত্ৰত্য লোক ও কৌরবেরা কেহই তোমাদিগকে জানিতে পরিবে না।’”

দেবী যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলিয়া পাণ্ডবগণকে রক্ষা করিয়া সেইখানেই অন্তর্হিত হইলেন।