০০১. জম্মুখণ্ডনির্ম্মাণপৰ্ব্বাধ্যায়

১ম অধ্যায়

জম্মুখণ্ডনির্ম্মাণপৰ্ব্বাধ্যায়

[সপ্তদ্বীপা পৃথিবী—সাতটি দ্বীপদ্বারা পৃথিবীর মানচিত্ৰ আৰ্য্য ইতিহাসশাস্ত্ৰে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে। জম্বুদ্বীপ ঐ সপ্তদ্বীপের অন্যতম। এই জম্বুদ্বীপের অন্তৰ্গত ভারতবর্ষ]

নারায়ণ, নরোত্তম, নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করবে।

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! কৌরব, পাণ্ডব ও সোমক [সোমবংশে—চন্দ্ৰবংশীয়—চন্দ্ৰবংশ যোজনায় প্রয়োজন হয় না। সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত অসিদ্ধ বলিয়া চন্দ্ৰবংশীয়েরা সোমকনামে উল্লিখিত হইয়াছেন]-প্রভৃতি মহাবলপরাক্রান্ত ও নানাদেশ সমাগত পার্থিবগণ কিরূপে যুদ্ধ করিয়াছিলেন?

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! কৌরব, পাণ্ডব ও সোমকেরা তপঃক্ষেত্ৰ [তপস্যার একটি উত্তম স্থান। রাজর্ষি কুরু এই ক্ষেত্রে তপস্যা করেন। তিনি স্বয়ং কর্ষণ করিয়া তপস্যাস্থান নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন এজন্য ইহা কুরুক্ষেত্র’— এবং তাঁহার তপস্যাস্থান বলিয়াও পরমপবিত্র। বেদের ঐতরেয়াদি ব্ৰাহ্মাণে এই ক্ষেত্রের নাম উল্লেখ আছে। শ্ৰাদ্ধদানাদি বা পুণ্যকাৰ্য্যে তীর্থস্মরণে এই কুরুক্ষেত্রের নাম প্রথমেই স্মরণীয় হয়-‘কুরুক্ষেত্ৰং গয়া-গঙ্গাং’ ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে অনেক ব্ৰহ্মার্ষি, দেবর্ষি, মহর্ষি, রাজর্ষি তপস্যা করিয়াছেন, কাজেই ইহার পুণ্যবত্তার ইয়ত্ত হয় না] কুরুক্ষেত্রে যেরূপে যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহা শ্রবণ করুন। বেদাধ্যয়নসম্পন্ন সমরাভিলাষী পাণ্ডবগণ জিগীষাপরবশ [জয়াভিলাষে সবিশেষ আগ্ৰহান্বিত] হইয়া সোমকসমভিব্যাহারে কুরুক্ষেত্রে গমনপূর্ব্বক কৌরবদিগের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং স্ববীৰ্য্যপ্রভাবে বিজয়লাভের অভিলাষে নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ ধাৰ্ত্তরাষ্ট্র [ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুৰ্য্যোধন] সৈন্যগণের অভিমুখে গমনপূর্ব্বক সসৈন্যে প্রাঙ্মুখীন [পূর্ব্বমুখ] হইয়া পশ্চিমদিকে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির সমন্তপঞ্চক [পরশুরাম এই স্থানে পাঁচটি হ্রদ নির্ম্মাণ ও ক্ষত্ৰশোণিতে পূর্ণ করিয়া তদ্দ্বারা পিতৃতর্পণ করিয়াছিলেন। এই সমস্ত পঞ্চকও কুরুক্ষেত্রের অন্তৰ্গত।] তীর্থের বহির্ভাগে [যুদ্ধ তমোমিশ্র রজোবহুল কাৰ্য্য; তাহা তীর্থক্ষেত্রমধ্যে হওয়া অসঙ্গীতবোধে বিশেষতঃ সৈন্যসমাবেশে—সৈন্যগণের ব্যবহার ক্ষেত্র অপবিত্র না হয়, এজন্য যুধিষ্ঠির তীর্থক্ষেত্রের বাহিরে যুদ্ধক্ষেত্র নির্ম্মাণ করেন। এখানে যে “তপঃক্ষেত্র’ এবং শ্ৰীমদভগদগীতায় যে ‘ধর্ম্মক্ষেত্র’ বলা হইয়াছে, উহাও ক্ষেত্র-উপলক্ষিত তৎসন্নিহিত স্থানের বোধক।] বিধানানুসারে সহস্ৰ-সহস্ৰ শিবির সংস্থাপন করিলেন, সমস্ত ভূবলয় [পৃথিবীর বেষ্টনী—সীমারেখার পার্শ্বস্থ স্থান] হইতে সৈন্যগণ আগমন করিতে লাগিল, তখন বালবৃদ্ধবিশিষ্ট পুরুষবিহীন [বালক ও বৃদ্ধ বাদ দিয়া সমস্ত যুবা প্রৌঢ় পুরুষ এবং যুদ্ধোপযোগী সমস্ত গজ ও অশ্ব সমরে সংগৃহীত হইল] রথাশ্বকুঞ্জররহিত মেদিনীমণ্ডল যেন শূন্যপ্রায় হইয়া উঠিল। সর্ব্বজাতীয় মানবগণ সেই সৈন্যের অন্তর্গত ছিল; তাহারা একত্ৰ হইয়া শৈল, কানন, দেশ ও নদীসকল অধিকারপূর্ব্বক বহু যোজনাব্যাপী এক বিস্তৃত মণ্ডল [শ্রেণীবিভাগসমন্বিত বৃহৎ বাসস্থান] প্রস্তুত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিল। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির যানবাহনের সহিত সেইসকল লোকের অত্যুৎকৃষ্ট ভক্ষ্য-ভোজ্য-প্রদানের আদেশ করিয়া বিশেষরূপে পাণ্ডবগণের সৈন্যকে অবগত হইবার নিমিত্ত বিবিধ আখ্যা [নাম ও চিহ্ন—এমন এক কৌশলীযুক্ত নাম ও চিহ্ন প্ৰদান করা হইল যে, সেই অবগতি সৈন্যের মধ্যেও তাহাদিগকে বিশ্বস্তভাবে চিনিয়া লওয়া যায়] প্ৰদান করিলেন। পরে সংগ্রামকাল সমুপস্থিত হইলে সকলকে অভিজ্ঞান ও অলঙ্কার প্রদান করিতে লাগিলেন।

এদিকে রাজা দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবগণের ধ্বজাগ্ৰ সন্দর্শন করিয়া সকল ভূপালের সহিত চক্রব্যূহ [দুর্ভেদ্য সেনাসন্নিবেশ] রচনায় প্রবৃত্ত হইলেন। ভৃত্যেরা তাঁহার মস্তোকপরি পাণ্ডুবৰ্ণ আতপত্ৰ [শ্বেতবর্ণ রাজচ্ছত্র] ধারণ করিল। পাঞ্চলেরা ভ্রাতৃগণপরিবৃত দুৰ্য্যোধনকে নাগসহস্রের [বহু হস্তীর] মধ্যবর্ত্তী নিরীক্ষণ করিয়া একান্ত হৃষ্ট ও নিতান্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং মহাস্বন [মহাশব্দ] শঙ্খ ও মুধুররবসম্পন্ন ভেরী[রামশিঙা]ধবনি করিতে লাগিলেন। পরে পাণ্ডবগণ ও বাসুদেব স্বীয় সৈন্যসমূহকে অবলোকন করিয়া অতিশয় আনন্দিত হইলেন। অনন্তর ধনঞ্জয় ও কৃষ্ণ হৃষ্টান্তঃকরণে রথে অবস্থান করিয়া দিব্যশঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। কৌরবদিগের যোদ্ধৃগণ কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য ও অর্জ্জুনের দেবদত্ত শঙ্খের অতি গভীর নিনাদ শ্রবণ করিয়া মূত্ৰ-পুরীষ পরিত্যাগ [ভীতিবশতঃ মলমূত্ৰত্যাগ] করিতে লাগিল। যেমন মৃগগণ সিংহনাদ শ্রবণ করিলে ভীত হইয়া থাকে, তদ্রূপ তাহারাও সেই উভয় শঙ্খের ধ্বনি শ্রবণ করিয়া নিতান্ত শঙ্কিত ও সাতিশয় বিষণ্ন হইল।

এই অবসরে ভূতল হইতে ধূলিপটল [ধূলিজাল] সমুত্থিত হইয়া সকল বস্তুই সমাচ্ছাদিত করিল; কিছুই আর অনুভূত হইল না। সৈন্যগণ সেই ধূলায় আবৃত হইল, দিবাকর ধূলিসমাবৃত হইয়া অদৃশ্য হইলে মনে হইল, যেন তিনি অস্তাচলে গমন করিয়াছেন। জলধর [মেঘ] চতুর্দ্দিকে মাংসশোণিত বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। উহা সকলেরই নিতান্ত অদ্ভুত বলিয়া প্রতীয়মান হইল। সমীরণ প্রাদুর্ভুত হইয়া কর্কর [কাঁকর] বর্ষণপূর্ব্বক সৈন্যগণকে আহত করিতে লাগিল। তখন ক্ষুভিত সাগরসদৃশ উভয় পক্ষীর সৈন্য হৃষ্টান্তঃকরণে [সানন্দচিত্তে] যুদ্ধার্থ কুরুক্ষেত্রে সমাগত হইল; ঐ অদ্ভুত সেনাসমাগম প্ৰলয়কালীন সাগরদ্বয় সমাগমের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। কৌরবগণ সেই সেনাসমুদয় সংগ্ৰহ করিলে বালবৃদ্ধবিশিষ্ট পৃথিবী শূন্যপ্রায় হইয়া উঠিল।

যুদ্ধের নিয়মবন্ধন

অনন্তর কৌরব, পাণ্ডব ও সোমকেরা সময় নির্দেশপূর্ব্বক যুদ্ধের নিয়ম নির্দ্ধারিত করিলেন; তুল্যবল—সমযোগ্য ব্যক্তিরাই পরস্পর ন্যায়যুদ্ধ করিবে, কোনরূপ প্রতারণা করা হইবে না, ইহাতে আরদ্ধ যুদ্ধ নিবৃত্ত হইলে পুনর্ব্বার পরস্পরের প্রীতি সংস্থাপিত হইবে; বাগযুদ্ধ আরব্ধ হইলে বাক্যদ্বারাই যুদ্ধ হইবে; সেনা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলে তাহাকে প্রহার করা হইবে না; রথী রথীর সহিত, গজারোহী গজারোহীর সহিত, অশ্বরূঢ় অশ্বারূঢ়ের সহিত এবং পদাতি পদাতির সহিত যোগ্যতা, উৎসাহ, বল ও অভিলোষানুসারে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইবে; অগ্রে সতর্ক করিয়া পশ্চাৎ প্রহার করিবে; বিশ্বস্ত ও ভয়বিহ্বল ব্যক্তিকে আঘাত করিবে না। যে কোন এক ব্যক্তির সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়া ক্ষীণ-শস্ত্ৰ [নিঃশেষিত অস্ত্ৰ], বর্ম্মবিরহিত ও সমরপরাঙ্মুখ হইবে, কদাচ তাহাকে প্রহার করিবে না। সারথি, বাহন, অস্ত্রশস্ত্ৰাদিবাহক, ভেরী ও শঙ্খবাদককে কদাচ আঘাত করা হইবে না; কৌরব, পাণ্ডব ও সোমকেরা এইরূপ নিয়ম নিৰ্দ্ধারণপূর্ব্বক পরস্পর নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, পরে সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া সৈন্যগণের সহিত সাতিশয় সন্তোষ লাভ করিলেন।