০০৫. জম্বুদ্বীপের অবতারণা

৫ম অধ্যায়

জম্বুদ্বীপের অবতারণা

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! নদী, পর্ব্বত, জনপদ, কানন প্রভৃতি যেসকল পদার্থ ভূতল আশ্রয় করিয়া আছে, তাহাদের নাম ও সমস্ত পৃথিবীর প্রমাণ কীৰ্তন কর।” সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! এই পঞ্চ মহাভূতদ্বারা পৃথিবীস্থ সমস্ত পদার্থ প্রস্তুত হইয়াছে; এই নিমিত্ত মনীষিগণ ঐসকল পদার্থকে তুল্যরূপ বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। আকাশ, বায়ু, তেজ, জল ও ভূমি, এই পঞ্চ মহাভূত উত্তরোত্তর সমধিক গুণসম্পন্ন, তত্ত্ববিৎ মহর্ষিগণ কহিয়াছেন—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ, এই পাঁচটি ভূমির গুণ; অতএব ভূমিই প্রধান। শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস, এই চারিটি সলিলের গুণ; তাহাতে কেবল গন্ধ নাই। শব্দ, স্পর্শ ও রূপ, এই তিনটি তেজের গুণ; শব্দ ও স্পর্শ এই দুইটি বায়ুর গুণ এবং একমাত্র শব্দই আকাশের গুণ। হে মহারাজ! পঞ্চভূতাত্মক লোকমধ্যে এই পাঁচটি গুণ বিদ্যমান আছে। এই সকল গুণ সমভাব অবলম্বন করিলে পরস্পর প্রশান্তভাবে অবস্থান করে ও পরস্পর বিষমভাব ধারণ করিলে দেহী দেহ হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকে। এই সমস্ত গুণ আনুপূর্বিক উৎপন্ন হইয়া আনুপূর্বিক বিনাশ প্রাপ্ত হয়। এই সকল গুণ ঈশ্বরতুল্য। অপরিমেয় তৎসমুদয়ের পরিমাণ করা নিতান্ত দুষ্কর। প্রত্যেক পদার্থেই পাঞ্চভৌতিক প্রকৃতি পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে; মনুষ্যগণ তর্কদ্বারা ঐ পঞ্চভূতময় পদার্থপুঞ্জের প্রমাণ নির্দেশ করে। কিন্তু যেসমস্ত পদার্থ অচিন্ত্যনীয়, তাহা তৰ্কদ্বারা নির্দেশ করা নিতান্ত কঠিন।

“হে মহারাজ। এক্ষণে জম্বুদ্বীপের বিষয় কীর্ত্তন করি, শ্রবণ করুন। উহার অপর নাম সুদর্শনদ্বীপ; ঐ দ্বীপ চক্রাকার, নিতান্ত দুর্লক্ষ্য, নদী ও জলে সমাচ্ছন্ন; মেঘসন্নিভ পর্ব্বত, বিবিধ নগর, সুরম্য জনপদ ও ফলপুষ্পে সুশোভিত পাদপনিবহে সমাকীর্ণ ও চতুর্দ্দিকে লবণসমূদ্রদ্বারা পরিবেষ্টিত আছে। যেমন মনুষ্য দৰ্পণতলে আপনার মুখমণ্ডলের প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করে, তদ্রূপ জম্বুদ্বীপের প্রতিবিম্ব চন্দ্ৰমণ্ডলে [১] পরিদৃশ্যমান হইয়া থাকে। এই জম্বুদ্বীপের দুই অংশ পিপ্পলস্থান [২] ও দুই অংশ মহাশশস্থান [৩]; তাহার চতুর্দ্দিক সর্ব্বপ্রকার ওষধি এবং সলিলরাশিদ্বারা পরিবেষ্টিত। হে রাজন! এক্ষণে জম্বুদ্বীপের অবশিষ্ট বিষয় সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।”

[ ১-৩। “পিপ্পল অর্থাৎ অশ্বত্থবৃক্ষদ্বারা এবং মহাশশ অর্ধাৎ চন্দ্রের মধ্যস্থিত মৃগমুণ্ডাকৃতি শশীকচিহ্নদ্বারা জম্বুদ্বীপের চারিটি অংশ চিহ্নিত করা হইয়াছে।” উক্ত পিপ্পল ও মহাশশ এই পদাৰ্থদ্বয়ের অন্তর্গূঢ় অপর অর্থও আছে। বিরাট পুরুষের মন হইতে চন্দ্রের উৎপত্তি, সেই চন্দ্ৰমণ্ডলনামক মনের এক অংশ কাৰ্য্যকারণরূপ—জীবাত্মস্বরূপ স্থূল সূক্ষ্ম-দুইটি অশ্বত্থবৃক্ষ। গীতায় এই অব্যয় অশ্বত্থবৃক্ষকে বিশ্বময় ব্রহ্মের রূপক করা হইয়াছে। সেই মনের অপর অংশে মহান পরমাত্মা শীঘ্ৰগতিবিশিষ্ট নিয়ম ও নিয়ামকরূপে দুইটি শশকের মত জীব ও ঈশ্বরভাবে অধিষ্ঠিত আছেন। ]