৩৯. দ্রোণাদির সমরসতর্কতা

৩৯তম অধ্যায়

দ্রোণাদির সমরসতর্কতা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, “মহারাজ! এদিকে ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখ মহারথগণ ছদ্মবেশী অর্জ্জুনকে উত্তরসমভিব্যাহারে রথারোহণপূর্ব্বক শমীবৃক্ষের অভিমুখে গমন করিতে দেখিয়া একান্ত শঙ্কিত হইলেন। তখন দ্রোণাচাৰ্য্য সকলকে ভগ্নোৎসাহ ও ভয়ঙ্কর উৎপাত উপস্থিত দেখিয়া কহিলেন, “দেখ, সমীরণ অনবরত কর্কর [ক্ষুদ্র প্রস্তরকণা-কাঁকর] বর্ষণপূর্ব্বক প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত হইতেছে; নভোমণ্ডল ভস্মাকার গাঢ়তর তিমিরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে; শিবাগণ সূৰ্য্যাভিমুখে অতি কঠোরস্বরে চীৎকার করিতেছে; দিগদাহ উপস্থিত; অশ্বগণ অশ্রুমোচন করিতেছে, অকস্মাৎ কোষ হইতে বিবিধ শস্ত্ৰজাল স্বলিত হইতেছে এবং ধ্বজদণ্ড চালিত না হইয়াও কম্পিত হইতেছে।

“হে বীরগণ! এইরূপ অন্যান্য বহুতর ভয়ানক উৎপাত উপস্থিত হইয়াছে; অতএব এক্ষণে সাবধান হইয়া যত্নসহকারে আত্মরক্ষার্থে ব্যূহরচনা কর এবং গোধন রক্ষা করিতে যত্নবান হও। নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, মহাবীর অর্জন ক্লীববেশে আগমন করিতেছে।”

দ্রোণাচাৰ্য্য সমুদয় বীরপুরুষগণকে এইরূপ কহিয়া পরিশেষে ভীষ্মকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে শান্তনুতনয়! মহাবলপরাক্রান্ত পার্থ অদ্য আমাদিগকে পরাজয় করিয়া নিশ্চয়ই গোধন লইয়া যাইবে। বীরবরাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় সমুদয় দেবাসুরগণের সহিতও সংগ্ৰাম করিতে পরাঙ্মুখ হয় না। ঐ মহাবীর দেবলোকে দেবরাজ ইন্দ্রের সাহায্যে অস্ত্ৰশিক্ষা করিয়াছে। বিশেষতঃ অরণ্যবাসক্লেশে নিতান্ত ক্লিষ্ট ও একান্ত অমৰ্ষপরবশ হইয়াছে, সুতরাং বিনা যুদ্ধে কদাচ নিবৃত্ত হইবে না। কিন্তু আমাদিগের মধ্যে এমন কোন বীরই নাই যে, উহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে পারে। শুনিয়াছি, অর্জ্জুন হিমাচলে কিরাতবেশধারী ভগবান ত্ৰিলোচনকে স্বীয় যুদ্ধবিদ্যাপারদর্শিতা প্রদর্শনপূর্ব্বক সন্তুষ্ট করিয়াছে।”

তখন কৰ্ণ কহিলেন, “হে আচাৰ্য্য! আপনি সর্ব্বদাই অর্জ্জুনের গুণকীর্ত্তন ও আমাদিগের নিন্দা করিয়া থাকেন, কিন্তু আমার ও মহারাজ দুৰ্য্যোধনের যেরূপ ক্ষমতা অর্জ্জুনের তাহার ষোড়শাংশের একাংশও নাই।”

দুৰ্য্যোধন কর্ণের বাক্যানুসারে তাহাকে কহিলেন, “হে কর্ণ। যদি এই অঙ্গনাবেশধারী পুরুষ যথার্থই অর্জ্জুন হয়, তাহা হইলে আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইবে; কারণ, পাণ্ডবেরা এক বৎসর অজ্ঞাতসারে কালব্যাপন করিবে বলিয়া পূর্ব্বে অঙ্গীকার করিয়াছে; এক্ষণে জ্ঞাত হইলে তাহাদিগকে পুনরায় দ্বাদশ বৎসর অরণ্যবাস স্বীকার করিতে হইবে, সেন্দহ নাই; আর যদি অন্য কেহ ক্লীববেশে আগমন করিয়া থাকে তাহা হইলে আমি নিশিত শরপ্ৰহারে এখনই উহার প্রাণসংহার করিব।”

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও অশ্বথামা মহারাজ দুৰ্য্যোধনের এইরূপ পৌরুষবাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সবিশেষ প্ৰশংসা করিতে লাগিলেন।