০৬. শিবিরদ্বারে অশ্বত্থামার অদ্ভুত দর্শন

৬ষ্ঠ অধ্যায়

শিবিরদ্বারে অশ্বত্থামার অদ্ভুত দর্শন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচার্য্য অশ্বত্থামাকে দ্বারদেশে অবস্থিত অবলোকন করিয়া কি করিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! এইরূপে মহারথ অশ্বত্থামা ক্রোধভরে শিবিরদ্বারে আগমন করিয়া তথায় চন্দ্র ও সূর্য্যের ন্যায় প্রজাসম্পন্ন এক মহাকায় পুরুষকে অবলোকন করিলেন। তাঁহার বদনমণ্ডল বিচিত্র-সহস্র নেত্ৰ-সমলঙ্কৃত, বাহু-সকল সুদীর্ঘ, স্থূল ও নাগাঙ্গদ-বিভূষিত[সর্পের বালা] এবং আস্যদেশ ব্যাদিত দংষ্ট্রাকরাল [হাঁ করা মুখ ভয়ঙ্কর দাঁতে অতি ভয়ঙ্কর] ও অগ্নিশিখায় প্রদীপ্ত। তাঁহার পরিধানে শোণিতা ব্যাঘ্রচর্ম্ম, উত্তরীয় কৃষ্ণাজিন। সেই নাগযজ্ঞোপবীতধারী [সর্পের পৈতা] ভীষণদর্শন মহাপুরুষের আকার ও বেশ বর্ণনা করা নিতান্ত দুষ্কর। তাঁহাকে দেখিলে পৰ্বত-সকলও বিদীর্ণ হইয়া যায়। তৎকালে সেই দিব্যপুরুষের মুখ, নাসিকা, কর্ণযুগল ও সহস্র নেত্র হইতে তেজোরাশি নির্গত হইতেছিল। সেই তেজঃপুঞ্জ হইতে শঙ্খচক্রগদাধারী অসংখ্য হৃষীকেশ প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিলেন।

মহারথ অশ্বত্থামা সেই সর্ব্বভূতভয়ঙ্কর অদ্ভুতাকার মহাপুরুষকে অবলোকন করিয়া বিন্দুমাত্র ভীত না হইয়া তাঁহার প্রতি দিব্যাস্ত্রজাল নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন; মহাকায় পুরুষও বাড়বানল যেমন সমুদ্রের সলিলপ্রবাহ গ্রাস করিয়া থাকে, তদ্রূপ দ্রোণপুত্রনিক্ষিপ্ত শরনিকর গ্রাস করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা আপনার দিব্যাস্ত্রজাল নিতান্ত নিষ্ফল হইল দেখিয়া তাঁহার প্রতি এক প্রদীপ্ত অগ্নিশিখার ন্যায় রথশক্তি নিক্ষেপ করিলেন। প্রলয়কালে মহোল্কা যেমন সূৰ্য্যদেবকে আহত করিয়া নভোমণ্ডল হইতে পরিভ্রষ্ট হয়, তদ্রূপ সেই প্রদীপ্ত রথশক্তি মহাপুরুষকে আহত করিয়া বিদীর্ণ ও নিপতিত হইল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা এক আকাশসদৃশ নীলবর্ণ সুবর্ণমুষ্টিসমলঙ্কৃত খড়্গ বিবরনিঃসারিত ভীষণ ভুজঙ্গমের ন্যায় কোষ হইতে নিষ্কাশিত করিয়া তাঁহার প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। খড়্গ দিব্য পুরুষের দেহে নিপতিত হইয়া গৰ্ত্তমধ্যে লুক্কায়িত নকুলের ন্যায় তিরোহিত হইল। মহাবীর অশ্বত্থামা তদ্দর্শনে নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহার প্রতি এক ইন্দ্ৰধ্বজসদৃশ প্রজ্বলিত গদা নিক্ষেপ করিলেন; তিনিও তৎক্ষণাৎ তাহা গ্রাস করিয়া ফেলিলেন।

এইরূপে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ক্ষয় হইলে মহাবীর অশ্বত্থামা ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক দেখিলেন, সেই মহাপুরুষের তেজোরাশি-বিনির্গত অসংখ্য হৃষীকেশ এককালে আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়াছেন। তিনি সেই অদ্ভুত ব্যাপার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া কৃপাচাৰ্য্যের বাক্য স্মরণপূর্ব্বক সন্তপ্তচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন, যে ব্যক্তি সুহৃদের হিতকর বাক্য অপ্রিয় বোধে অনাদর করে, তাহাকে আমার ন্যায় বিপত্সাগরে নিমগ্ন হইয়া শোক প্রকাশ করিতে হয়, সন্দেহ নাই। যে ব্যক্তি শাস্ত্রসম্মত পথ অতিক্রম করিয়া শত্ৰুসংহারের অভিলাষ করে, তাহাকে ধর্ম্মপথপরিভ্রষ্ট হইয়া কুপথে প্রতিহত হইতে হয়। বৃদ্ধ লোকে সর্ব্বদা এইরূপ উপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন যে-গো, ব্রাহ্মণ, নৃপ, স্ত্রী, সখা, মাতা, গুরু এবং মৃতপ্রায়, জড়, অন্ধ, নিদ্রিত, ভীত, মদমত্ত, উন্মত্ত ও অনবহিত ব্যক্তিদিগের প্রতি কদাচ শস্ত্রপ্রহার করিবে না। আমি সেই শাস্ত্রবিহিত [প্রতিবিধানে অনবধান] সনাতন পথ অতিক্রমপূর্ব্বক কুপথে পদার্পণ করিয়া এই ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়াছি। বিজ্ঞ ব্যক্তিদিগের মতে কোন মহৎ কার্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক অশক্তি নিবন্ধন ভীত হইয়া তাহা হইতে বিরত হওয়াই ঘোরতর বিপদের বিষয়। দৈব অপেক্ষা পুরুষকার কদাচ গুরুতর নহে। যদি কেহ কোন কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া দুর্বৈবশতঃ উহা সিদ্ধ করিতে না পারে, তাহা হইলে তাহাকে ধর্ম্মপথপরিভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত হইতে হয়। যদি কোন ব্যক্তি অগ্রে প্রতিজ্ঞাসহকারে কোন কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া পশ্চাৎ ভয়প্রযুক্ত তাহা হইতে বিরত হয়, তাহা হইলে সেই ব্যক্তির অগ্রে ঐরূপ প্রতিজ্ঞা করা নিতান্ত অজ্ঞতার কাৰ্য্য বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। এক্ষণে আমি অসৎকাৰ্য্যসংসাধনে উদ্যত হইয়াছি বলিয়া আমার এই মহাভয় উপস্থিত হইয়াছে। এই যে মহাপুরুষ উদ্যত দৈবদণ্ডের ন্যায় এই স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া আমার প্রতিবন্ধকতাচরণ করিতেছেন, আমি বারংবার চিন্তা করিয়াও ইহাকে বিদিত হইতে সমর্থ হইতেছি না; বোধ হয়, ইনি আমার অধর্ম্মে প্রবৃত্ত কলুষিত বুদ্ধির ভয়ঙ্কর ফলস্বরূপ। আমি কদাচ সমরে পরাঙ্মুখ হই নাই, এক্ষণে কেবল দৈবই আমাকে সমরবিমুখ করিলেন, সন্দেহ নাই। অতঃপর দৈববল প্রাপ্ত না হইলে আমি কদাচ এই কার্য্যসাধনে সমর্থ হইব না। অতএব এক্ষণে দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হই, তিনিই আমার এই দুর্দৈব শান্তি করিয়া দিবেন। ভগবান্ উমাপতি তপ ও বিক্রমপ্রভাবে সমস্ত দেবগণকে অতিক্রম করিয়াছেন; অতএব তাঁহারই আশ্রয় গ্রহণ করা কর্ত্তব্য।