০৪. অশ্বত্থামার ক্রোধশান্তির জন্য কৃপের কৌশল

৪র্থ অধ্যায়

অশ্বত্থামার ক্রোধশান্তির জন্য কৃপের কৌশল

কৃপাচার্য্য কহিলেন, বৎস! আজ ভাগ্যক্রমে তোমার বৈরনিৰ্যাতনে বুদ্ধি হইয়াছে। স্বয়ং পুরন্দরও তোমার নিবারণে সমর্থ নহেন। এক্ষণে তুমি বৰ্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক এই রাত্রি বিশ্রাম কর, কল্য প্রভাতে যুদ্ধযাত্রা করিবে। আমিও কৃতবর্ম্মার সমভিব্যাহারে বর্ম্মধারণ ও রথারোহণপূর্ব্বক তোমার অনুগমন করিব। তাহা হইলে তুমি নিশ্চয়ই পাঞ্চালগণ ও তাঁহাদের অনুচরগণের বধসাধনে সমর্থ হইবে। তোমার বহুদিন ক্রমাগত জাগরণ হইতেছে; অতএব আজ রাত্রিতে নিদ্রাসুখ অনুভব কর, তাহা হইলে বিশ্রাম ও স্থিরচিত্ত হইয়া নিঃসন্দেহেই অরাতিগণকে বিনাশ করিতে পারিবে। আমি তোমার সমভিব্যাহারে থাকিলে এবং কৃতবর্ম্মা তোমাকে রক্ষা করিলে অন্যের কথা দূরে থাকুক, দেবরাজ ইন্দ্রও তোমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন না। তোমার ও আমার নিকট অনেক দিব্যাস্ত্র আছে আর মহাধনুর্দ্ধর কৃতবর্ম্মাও রণপণ্ডিত; অতএব আজ আমরা নিদ্রাসুখ অনুভব করিয়া শ্রমহীন হইলে কল্য প্রাতঃকালে একত্র সমবেত হইয়া সমস্ত শত্ৰু সংহারপূর্ব্বক যার পর নাই প্রীতি প্রাপ্ত হইব। হে দ্রোণতনয়! আজ তুমি নিরুদ্বেগে নিদ্রিত হইয়া যামিনী-যাপন কর। কল্য প্রভাতে অরাতিগণের শিবিরমধ্যে প্রবেশ ও স্বীয় নামোচ্চারণপূর্ব্বক শত্রুগণকে বিনাশ করিয়া সমস্ত মহাসুরঘাতী সুররাজীর ন্যায় পরমসুখে বিহার করিতে পারিবে। পূর্বে মহাত্মা বিষ্ণুও যেমন দৈত্যসেনা পরাজিত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমিও পাঞ্চালসৈন্যগণকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে। কি আমি ও কি কৃতবর্ম্মা, আমরা পাঞ্চালগণকে পরাজিত না করিয়া কখনই সমর হইতে নিবৃত্ত হইব না। হয় আমরা পাণ্ডবগণের সহিত পাঞ্চালদিগকে বিনাশ করিব, না হয় তাহাদিগের হস্তে নিহত হইয়া স্বর্গ প্রাপ্ত হইব। ফলতঃ আমি সত্য কহিতেছি, কল্য প্রভাতে কৃতবর্ম্মার সহিত সর্ব্বপ্রকারে তোমার সহায়তা করিব।

হে মহারাজ! মহাত্মা কৃপাচার্য্য এইরূপ হিতকথা কহিলে মহাবীর অশ্বত্থামা রোষারুণনয়নে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, মাতুল! আতুর, অমর্ষিত, চিন্তাব্যাপৃত, কামুক ব্যক্তিরা কখনই নিদ্রাসুখ অনুভবে সমর্থ হয় না। আজ অমর্ষপ্রভাবে আমার নিদ্রাবিচ্ছেদ হইয়াছে। দেখুন, ইহলোকে পিতৃবধস্মরণ অপেক্ষা আর কি অধিক কষ্টকর হইতে পারে? পিতৃবধস্মরণেই অহোরাত্র আমার হৃদয় দগ্ধ হইতেছে, কিছুতেই তাহার শান্তি হইতেছে না। পাপাত্মারা যেরূপে আমার পিতাকে নিহত করিয়াছে, তাহা আপনার অবিদিত নাই। তাদৃশ পিতৃবধ বৃত্তান্তশ্রবণে মাদৃশ কোন্ ব্যক্তি মুহূর্ত্তকালও জীবন ধারণ করিতে সমর্থ হয়? এক্ষণে সমরাঙ্গনে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিনাশ না করিয়া কোনক্রমেই আমার জীবনধারণে বাসনা হইতেছে না। ঐ দুরাত্মা আমার পিতাকে বিনাশ করিয়াছে বলিয়া তাহাকে এবং তাহার সমভিব্যাহারীদিগকে বিনাশ করিব; আর রাজা দুৰ্য্যোধন ভগ্নোরু ও সমরাঙ্গনে নিপতিত হইয়া আমার সমক্ষে যেরূপ বিলাপ করিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিয়া কোন্ পাষাণহৃদয় বিদীর্ণ না হয়? নির্দ্দয় ব্যক্তি বাষ্পবেগ সংবরণ করিতে পারে? আমি বিদ্যমান থাকিতে মিত্রপক্ষের এরূপ পরাজয় হওয়াতে আমার শোকসাগর, সমুচ্ছলিত হইতেছে। আমি পাঞ্চালগণের বিনাশসাধনে একাগ্রচিত্ত হইয়াছি; অতএব আমার আজ নিদ্রা বা সুখানুভবের সম্ভাবনা কি? আমার বোধ হয়, বাসুদেব ও অর্জুন পাণ্ডবপক্ষীয়দিগকে রক্ষা করিলে ইন্দ্রও যে তাহাদিগের পরাক্রম সহ্য করিতে সমর্থ হয়েন না, ইহা আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, তথাপি কোনরূপেই ক্রোধাবেগসংবরণে সমর্থ হইতেছি না। এক্ষণে আমাকে এই ক্রোধ হইতে মুক্ত করে, এরূপ কোন লোকও নেত্রগোচর হইতেছে না; সুতরাং আমি যাহা স্থির করিয়াছি, তাহাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ। দূতমুখে মিত্রপক্ষের পরাভব ও পাণ্ডবগণের জয়লাভ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অবধি আমার হৃদয় ক্রোধানলে দগ্ধ হইতেছে, অতএব আজ রাত্রেই নিদ্রিত শত্রুগণকে বিনাশপূর্ব্বক সূস্থচিত্ত হইয়া বিশ্রাম ও নিদ্রাসুখ অনুভব করিব।