৪৫. পাণ্ডব-পরিচয়ে উত্তরের আশ্বস্তি

৪৫তম অধ্যায়

পাণ্ডব-পরিচয়ে উত্তরের আশ্বস্তি

“আমি আপনার সারথ্যিকাৰ্য্য স্বীকার করিতেছি, এক্ষণে আপনি এই সুসজ্জিত রথে আরোহণপূর্ব্বক কোন স্থানে গমন করিবেন, আজ্ঞা করুন, আমি সেনাসমূহ পরিত্যাগ করিয়া আপনারই সহিত গমন করিব।”

অর্জ্জুন কহিলেন, “হে রাজকুমার! আমি তোমার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছি, এক্ষণে আর ভয় নাই, আমি একাকী তোমার শত্ৰুসকল সংহার করিব। তুমি আর উৎকণ্ঠিত হইও না; এই সকল তৃণীর শীঘ্র আমার রথে বন্ধনপূর্ব্বক সুবৰ্ণ-সমুজ্জ্বল এক খড়গ আহরণ কর!”

এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র উত্তর সত্বর অর্জ্জুনের সমস্ত অস্ত্ৰ গ্রহণপূর্ব্বক শমীবৃক্ষ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “হে উত্তর! আমি কৌরবদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া অনতিবিলম্বেই তোমার গোধন-সকল প্রত্যাহরণ করিব, আমার বাহুযুগল তোমার নগরের প্রাকারে ও তোরণস্বরূপ হইবে। ক্ষণকালমধ্যে তোমার নগর জ্যাঘোষ-নিনাদিত দুন্দুভিধ্বনিমুখরিত হইয়া উঠিবে। ভয় কি? রণস্থলে গাণ্ডীবাশরাসন ধারণপূর্ব্বক রথারোহণ করিলে শত্ৰুগণ কদাচ তোমাকে পরাজয় করিতে পরিবেন।

উত্তর কহিলেন, “হে বীর! আমি এক্ষণে বিপক্ষ হইতে ভীত হইতেছি না, আপনার বল-বীৰ্য্য সমুদয় জ্ঞাত হইয়াছি, আপনি যুদ্ধে বৃষ্ণিবংশাবতংস কৃষ্ণ বা দেবরাজ ইন্দ্রের তুল্য, তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু আপনি এরূপ সুরূপ ও শুভলক্ষণসম্পন্ন হইয়া কি প্রকারে কর্ম্মবিপাকবশতঃ ক্লীবত্ব প্রাপ্ত হইলেন, ইহা মনে মনে আন্দোলন করিয়া একান্ত বিমোহিত হইতেছি। আমি নিতান্ত মন্দবুদ্ধি, সুতরাং এক্ষণে কিছুই নির্ণয় করিতে সমর্থ হইতেছি না, বোধ হয়, আপনি কীববেশধারী ভগবান, শূলপাণি, গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ অথবা ভীতাত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্ৰ হইবেন।”

অর্জ্জুন কহিলেণ, “হে রাজকুমার! তুমি আমাকে প্রকৃত ক্লীব বলিয়া বোধ করিও না। আমি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিয়োগপরতন্ত্র হইয়া সংবৎসরকাল এইরূপ ব্ৰতানুষ্ঠান করিতেছি, এক্ষণে ব্ৰতকাল অতীত হইয়াছে।” উত্তর কহিলেন, “আজি আপনি নিতান্ত অনুগ্রহ প্ৰদৰ্শন করিলেন। ফলতঃ ঈদৃশ আকার কদাচ ক্লীব হইতে পারে না। আমি পূর্ব্বে যে সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা এক্ষণে নিষ্ফল হইল না। আজি আমি সহায়সম্পন্ন হইলাম; বলিতে কি, দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিতেও আমার উৎসাহ হইতেছে। মনোমধ্যে কিছুমাত্র ভয়ের উদ্রেক হইতেছে না। আপনার কি কাৰ্য্যসাধন করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন। আমি সুশিক্ষিত ব্যক্তি হইতে সারথকাৰ্য্য শিক্ষা করিয়াছি, এক্ষণে আপনার অশ্বচালনা করিব। বাসুদেবের দারুক ও সুররাজ ইন্দ্রের মাতলির ন্যায় আমিও অশ্বচালনায় নিপুণতা লাভ করিয়াছি। যে অশ্ব রথের দক্ষিণ ধুর বহন করিতেছে, সে ভগবান বিষ্ণুর সুগ্ৰীব তুল্য এবং গমনকালে ভূতলে তাহার পাদক্ষেপ কদাচ অনুভূত হয় না। যে অশ্ব রথের বাম ধুর বহন করিতেছে, সে ভগবান বিষ্ণুর হেমপুষ্প অশ্বের ন্যায় গমন করিয়া থাকে, সে ভগবান বিষ্ণুর শৈব্য অশ্বের ন্যায় বলবান। আর যে অশ্ব দক্ষিণ-পার্ষ্ণিভাগ বহন করিতেছে, সে মেঘ অপেক্ষাও বীৰ্য্যবান। এই সকল অশ্ব রথে যোজনা করিয়াছি; সুতরাং ইহা আপনাকে অনায়াসে বহন করিতে পরিবে; অতএব আপনি ইহাতে আরোহণ করিয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হউন।”

অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন বাহুযুগল হইতে বলয় উন্মোচনপূর্ব্বক কাঞ্চন নির্ম্মিত বর্ম্ম ধারণ ও শুক্লবসন দ্বারা কৃষ্ণবর্ণ কুটিল কেশকলাপ বন্ধন করিলেন; পরে পবিত্র ও প্রাঙ্মুখ হইয়া সেই দিব্য রথে আরোহণপূর্ব্বক অস্ত্ৰ-সমুদয় ধ্যান করিতে লাগিলেন। তখন অস্ত্ৰসকল প্রাদুর্ভূত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে পার্থকে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক কহিল, “হে মহাভাগ! এই আজ্ঞাবহ কিঙ্করগণ সমুপস্থিত, এক্ষণে কি আজ্ঞা হয়?” তখন অর্জ্জুন তাহাদিগকে নমস্কার ও প্রফুল্লবদনে হৃষ্টমনে প্রতিগ্রহ করিয়া কহিলেন, “হে অস্ত্ৰগণ! তোমরা রণস্থলে অবস্থান করিয়া আমার কাৰ্য্য সম্পাদন কর।”

অনন্তর তিনি অনতিবিলম্বে গাণ্ডীবে-জ্যারোপণপূর্ব্বক টঙ্কার প্রদান করিলেন। যাদৃশ শৈলের উপর শৈল নিক্ষেপ করিলে ভীষণশব্দ সমুৎপন্ন হয়, তদ্রূপ গাণ্ডীবে প্রচণ্ড রব সকলের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল, পৃথিবী শব্দায়মান হইয়া উঠিল, প্রবলবেগে বায়ু বহিতে লাগিল, দিকসকল প্রগাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, চতুর্দ্দিকে ঘন ঘন উল্কাপাত হইতে লাগিল এবং নভোমণ্ডলে ধ্বজদণ্ড-সকল উদভ্ৰান্ত ও পাদপরাজি বিচলিত হইয়া উঠিল। তখন কৌরবগণ অশনিনিৰ্ঘোষসদৃশ সেই ভয়াবহ শব্দ শ্রবণ করিয়া বুঝিলেন, ইহা যে মহাবীর অর্জ্জুনের গাণ্ডীবধ্বনি, তাহাতে সন্দেহ নাই।

উত্তর কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! আপনি একাকী, কিন্তু সর্ব্বাস্ত্রপারগ মহারথ কৌরবগণ বহুসংখ্যক, অতএব আপনি উহাদিগকে কিরূপে পরাজয় করিবেন? এই চিন্তা করিয়া নিতান্ত ভীত হইতেছি।” তখন অর্জ্জুন সহাস্যমুখে কহিলেন, “হে উত্তর! তুমি ভীত হইও না; দেখ, যখন আমি ঘোষযাত্রায় মহাবলপরাক্রান্ত গন্ধর্ব্বগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখন কে আমার সহায় হইয়াছিল? যখন সুরাসুর-পরিবৃত অতিভীষণ খাণ্ডবারণ্যে যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখন কে আমার সহায় হইয়াছিল? যখন দেবরাজ ইন্দ্রের নিমিত্ত মহাবল পৌলোম ও নিবাতকবচগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখন কে আমার সহায় হইয়াছিল? যখন দ্রৌপদী-স্বয়ংবরে বহুসংখ্যক ভূপালগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখনই বা কে আমার সাহায্য করিয়াছিল? হে উত্তর! আমি এক্ষণে দ্রোণাচাৰ্য্য, ইন্দ্ৰ, বরুণ, যম, কুবের, বহ্নি, কৃপকৃষ্ণ ও পিনাকপাণি মহাদেবের অনুগ্রহে অবশ্যই ইহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইব।”