৪৭. পণভঙ্গে পুনঃ বনবাসালয়ে দুৰ্য্যোধনের প্রীতি

৪৭তম অধ্যায়

পণভঙ্গে পুনঃ বনবাসালয়ে দুৰ্য্যোধনের প্রীতি

তদনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্যকে কহিলেন “আমি ও কর্ণ উভয়েই এই বিষয় বারংবার কহিয়াছি এবং পুনরায় কহিতেছি; দূতক্রীড়া-সময়ে আমাদিগের এইরূপ পণ হইয়াছিল যে, যাঁহারা পরাজিত হইবেন, তাঁহাদিগের দ্বাদশ বৎসর অরণ্যবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিতে হইবে। অদ্যাপি তাঁহাদিগের প্রতিজ্ঞাত সময় অতিক্রান্ত হয় নাই; তথাপি অর্জ্জুন আজি আমাদিগের সহিত সমাগত হইল। নির্ব্বাসনকাল অতিক্রান্ত না হইতেই যদ্যপি ধনঞ্জয় আগমন করিয়া থাকে, তাহা হইলে পাণ্ডবগণকে পুনর্ব্বার দ্বাদশ বৎসর বনবাসী হইতে হইবে। কিন্তু পাণ্ডবেরা লোভাবশতঃ সময়ভঙ্গ করিল অথবা আমাদিগেরই ভ্ৰান্তি হইতেছে, তাহা বলিতে পারি না; কোন বিষয়ে দ্বৈধ উপস্থিত হইলে প্রতিনিয়তই সংশয় হইয়া থাকে। কোন বিষয় একপ্রকার অবধারিত হইলেও তাহার অন্যথা হইয়া থাকে। ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তিরাও স্বার্থচিন্তাসময়ে ভ্ৰমকূপে নিপতিত হয়েন। অতএব পাণ্ডবগণের প্রতিজ্ঞাত সময় অবশিষ্ট আছে কিংবা অতিক্রান্ত হইয়াছে, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান হইতেছি; কিন্তু বোধ হয়, পিতামহ সবিশেষ অবগত আছেন।

“মৎস্যসেনাগণ যুদ্ধ করিবার মানসে উত্তর গোগৃহে গমন করিয়াছে, যদ্যপি ধনঞ্জয় তাহাদিগের সমভিব্যাহারে আগমন করিয়া থাকে, তাহা হইলে আমাদিগের কোন অপরাধ নাই। মৎস্যগণ ত্রিগর্ত্তদিগের বহুবিধ অপকার করিয়াছে, তাহারা ভয়াভিকুলিত হইয়া সেই বিষয় আমাদিগের কীর্ত্তন করাতে আমরা তাহাদিগের সাহায্যাৰ্থ এইরূপ অঙ্গীকার করিয়াছিলাম যে, ত্ৰিগর্ত্তগণ সপ্তমীতে অপরাহ্নে মৎস্যগণের গোধনসকল গ্রহণ করিবে, পরে মৎস্যরাজ যুদ্ধার্থী হইয়া গোষ্ঠে আগমন করিলেও আমরা অষ্টমীতে সূৰ্য্যোদয়সময়ে এই সমস্ত গোধন গ্রহণ করিব, এক্ষণে তদনুসারে মৎস্যদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে আসিয়াছি।

কর্ণকর্ত্তৃক যুদ্ধে উত্তেজনা-প্রদান

“বোধ হয়, ত্ৰিগর্ত্তগণ বিরাটরাজের গোধন-সকল আনয়ন করিবে, কিংবা যদি তাহারা পরাজিত হইয়া থাকে, তাহা হইলেও আমাদিগের সহিত মিলিত হইয়া মৎস্যগণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই, অথবা মৎস্যগণ জনপদবাসী লোক ও সমুদয় সেনা-সমভিব্যাহারে কেবল এই রাত্রি আমাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত আগমন করিতেছে কিংবা তাহাদিগের কোন বীরপুরুষ অগ্রসর হইয়া আগমন করিতেছে অথবা স্বয়ং বিরাটরাজ সমাগত হইতেছেন। মৎস্যরাজই আগমন করুন আর ধনঞ্জয়ই বা আসুক, আমাদিগকে অবশ্য যুদ্ধ করিতে হইবে, ইহা আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিকৰ্ণ, অশ্বথামা প্রভৃতি মহারথগণ এমন সময়ে কি নিমিত্ত উদভ্ৰান্তচিত্তে রথোপরি দণ্ডায়মান আছেন? বিনা যুদ্ধে কাহারও নিস্তার নাই, অতএব সকলেই সতর্ক হইয়া যত্ন করুন। যদ্যপি বজ্রধর [ইন্দ্র] বা দণ্ডধর [যম] বলপূর্ব্বক আমাদিগের গোধন হরণ করেন, তথাপি কোন ব্যক্তি বিনা যুদ্ধে হস্তিনাপুরে প্রতিগমন করিবে? পদাতিক হউক বা অশ্বারোহী হউক, সমরে পরাঙ্মুখ হইলে কেহই আমার শরে জীবিত থাকিবে না, অতএব এক্ষণে আচাৰ্য্যকে উপেক্ষা করিয়া যুদ্ধের নিয়ম-সকল নিৰ্দ্ধারণ করুন; তিনি আমাদিগের সৈন্যগণের মত বিলক্ষণ অবগত আছেন, এই নিমিত্ত তাহাদিগের অন্তঃকরণে ভয়ের সঞ্চার হইতেছে, অর্জ্জুনের প্রতি তাঁহার অধিক প্রীতি আছে, ফলতঃ পাণ্ডবগণ চিরকালই আচাৰ্য্যের প্রণয়ভাজন। দেখুন, ধনঞ্জয় নিকটে আগমন করিতেছে দেখিয়াই উনি তাঁহার প্রশংসা করিতেছেন, তাঁহার অশ্বের হ্রেষিত শ্রবণমাত্রেই আচাৰ্য্য মহাশয়ের অন্তঃকরণ বিচলিত হইয়া উঠিয়াছে, অতএব সেনাগণ যাহাতে মহারণ্যপ্রবিষ্ট বৈদেশিক ব্যক্তির ন্যায় ভ্ৰান্ত বা বিপথ-প্রবিষ্ট না হয়, এইরূপ নীতি-বিধান করা কর্ত্তব্য।

‘পাণ্ডবগণ আচাৰ্য্যের সবিশেষ প্রীতিপাত্র, তাহা উনি স্বয়ংই কহিতেছেন; নতুবা অশ্বগণের হ্রেষিত শ্রবণমাত্রেই কোন ব্যক্তি যোদ্ধার প্রশংসা করিয়া থাকে? অশ্বগণ স্বস্থানে অবস্থান করিবার বা গমন করিবার সময়ে স্বভাবতই হ্রেষারব করিয়া থাকে: সমীরণ সর্ব্বদাই প্রবাহিত হয়, বাসব দেব সর্ব্বদাই বর্ষণ করেন, জলধরপটলের উদয় হইলেই অশনিনির্ঘোষ শ্রুতিগোচর হইয়া থাকে, ইহাতে অর্জ্জুনের কি অলৌকিক বীরত্ব প্রকাশিত হইতেছে? আর কি নিমিত্তই বা তিনি তাঁহাকে প্রশংসা করিতেছেন? প্ৰজ্ঞতম আচাৰ্য্যগণ আমাদের প্রতি কোন অভিলাষ, বিদ্বেষ বা রোষপরবশ না হইয়া কারুণ্যরসবশংবদ [মোহপরতন্ত্র] ও উপায়দৰ্শী হইয়া থাকেন; অতএব ভয় উপস্থিত হইলে তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়। তাঁহারা বিচিত্র প্রাসাদ, সভা বা উপবনে বিচিত্ৰ কথা উত্থাপন করিয়া পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করিতে পারেন এবং জনসমাজে নানাবিধ অলৌকিক ক্রিয়া, প্রদর্শন, যজ্ঞ অস্ত্ৰশিক্ষা অথবা সন্ধিসময়ে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। পরছিদ্রানুসন্ধান, লোকচরিত্রবিজ্ঞান, গজ, অশ্ব ও রথচৰ্য্যা, গো, খর, উষ্ট্র, অজ, মেষকাৰ্য্য, পরিজ্ঞান [জীবতত্ত্ববিদ্যা], রথ্যা [পথ], পুরদ্বার-নির্ম্মাণ এবং অন্নের সংস্কার ও দোষ বিষয়ে ইহারা কুশলী। যাঁহারা বিপক্ষের গুণকীর্ত্তন করেন তাদৃশ পণ্ডিতগণকে উপেক্ষা করিয়া শত্রুসংহারোপযোগী নীতি প্রয়োগ করুন। চতুর্দ্দিকে এরূপ ব্যূহ রচনাপূর্ব্বক মধ্যস্থানে গোসমূহ সংস্থাপিত করিয়া যত্নাতিশয় সহকারে রক্ষা করুন, যাহাতে আমরা অনায়াসে শত্রুগণ-সঙ্গে যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইব।