০৪৩. পার্থের ইন্দ্রপুরে গমন—দেবগণের অভ্যর্থনা

৪৩তম অধ্যায়

পার্থের ইন্দ্রপুরে গমন—দেবগণের অভ্যর্থনা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহাযশাঃ অর্জ্জুন সিদ্ধচারণগণপরিষেবিত সকল ঋতুজাত-কুসুমোপ-শোভিত, পরিত্র-তরুরাজি-বিরাজিত সুরম্য অমরাবতী অবলোকন করিলেন। তথায় সুগন্ধি কুসুমসংপৃক্ত অতিপবিত্ৰ সুগন্ধ গন্ধবহ সর্ব্বদাই মন্দ মন্দ প্রবাহিত হইতেছে; তিনি পরমপ্রীতিকর নন্দনবনে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন যে, অন্সরাগণ ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে ও ধীরসমীরণসঞ্চালিত কুসুমিত পাদপগণ যেন হস্তদ্বারা তাঁহাকে আহ্বান করিতেছে। তথায় কেবল পুণ্যশীলেরাই গমন করিতে পারেন, নতুবা যাহারা তপোবিহীন, হুতাশনে কদাচ আহুতি প্ৰদান করেন নাই ও যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হইয়াছেন, মহেন্দ্ৰলোক তাঁহাদিগের দুরধিগম্য। যাগ, যজ্ঞ ও ব্রতবিহীন, বেদশ্রুতিবিবর্জ্জিত, তীর্থে অনাপ্লুত [অস্নাত—যাহার স্নান করা হয় নাই], অদাতা, যজ্ঞহন্তা, সুরাপায়ী এবং গুরুতল্পসেবী [গুরুপত্নীগামী] এই সকল দুরাত্মারা কখনই ইন্দ্ৰলোক সন্দর্শন করিতে সমর্থ হয় না। মহাবাহু অর্জ্জুন দিব্য-গীতানিনাদিত মনোহর নন্দনোদ্যান বিলোকনান্তর অমরাবতী পুরী প্রবেশ করিয়া সহস্র সহস্ৰ স্বেচ্ছাচারী দেববিমান নয়নগোচর করিলেন। তাহার মধ্যে কতকগুলি অবস্থিত, কতকগুলি কৃতগতি ও কতকগুলি আগত হইতেছে।

অর্জ্জুন অমরাবতী প্রবেশ করিলে অন্যান্য গন্ধর্ব্ব ও অন্সরীগণ তাঁহার স্তব করিতে লাগিল; কুসুম-সৌরভবাহী পবিত্র বায়ু তাঁহাকে বীজন করিতে লাগিল। দেবতা, গন্ধর্ব্ব, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ হৃষ্টচিত্তে তাঁহার পূজা করিলেন এবং সকলে আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্ব্বক তদীয় স্তবপাঠে প্ৰবৃত্ত হইলেন। তাঁহার অভ্যর্থনাৰ্থ দিব্যবাদ্যধ্বনি ও শঙ্খদুন্দুভিনিনাদ আরম্ভ হইল। এইরূপে অর্জ্জুন চতুর্দ্দিক হইতে স্তুয়মান হইয়া ইন্দ্রের আজ্ঞাক্ৰমে অতি বিস্তীর্ণনক্ষত্রপথে গমন করিলেন। তথায় সাধ্য, বিশ্ব, মরুৎ, অশ্বিনীকুমার, আদিত্য, বসুগণ, রুদ্র, ব্রহ্মর্ষি, দিলীপ-প্রমুখ রাজর্ষিগণ, তুম্বুরু, নারদ ও হাহা, হূহূ প্রভৃতি গন্ধর্ব্বগণের সহিত সমাগত হইয়া দেবরাজ ইন্দ্রকে সন্দর্শন করিলেন। অনন্তর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দেখিলেন যে, বিশ্বাবসু প্রভৃতি গন্ধর্ব্বগণ এবং ঋগ যজুঃ সামবেদবেত্তা দ্বিজবরেরা তাঁহার পিতা পাকশাসনের [ইন্দ্রের] স্তব করিতেছেন, মস্তকোপরি হেমদণ্ড ও পাণ্ডুরবর্ণ আতপত্ৰ [ছত্র] শোভিত হইতেছে এবং পার্শ্বে দিব্যগন্ধাধিবাসিত সুচারু চামর বীজন করিতেছে। তখন পাণ্ডুপুত্ৰ অর্জ্জুন বিনীতভাবে সুররাজসমীপে আগমনপূর্ব্বক নতমস্তক হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। দেবরাজও সেই প্রশ্রয়াবনত [প্রণয়নম্র] আত্মজকে আলিঙ্গন ও তাঁহার মস্তকাঘ্রাণপূর্ব্বক অঙ্কে লইয়া তদীয় করগ্রহণপূর্ব্বক স্বীয় দেবর্ষিসেবিত পবিত্র আসনে উপবেশন করাইলেন।

অর্জ্জুন সুররাজের নিয়োগানুসারে তদীয় আসনে সমধিরূঢ় হইয়া দ্বিতীয় বাসবের ন্যায় শোভমান হইতে লাগিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র স্নেহবশতঃ বজ্রকিণাঙ্কিত [ঘর্ষণে উৎপন্ন কড়াদ্বারা চিহ্নিত] করদ্ধারা অর্জ্জুনের শুভানন গ্রহণপূর্ব্বক তাহাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন এবং শরনিক্ষেপ ও জ্যাকর্ষণ-কঠিন হিরন্ময়-স্তম্ভপ্রতিম সুদীর্ঘ তদীয় বাহুযুগল বিমর্দ্দন করিয়া বাহুস্ফোটন করিলেন এবং হর্ষোৎফুল্প-লোচনে সহাস্যবদনে অর্জ্জুনকে বারংবার নয়নগোচর করিয়াও তৃপ্তির পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন না। যেমন চতুর্দ্দশীতে সূৰ্য্য-শশধরের একত্র সমুদয় হইলে নভোমণ্ডল অনির্ব্বচনীয় শোভা সম্পাদন করে, তদ্রূপ পিতাপুত্রে একাসনোপবিষ্ট হইয়া সভামণ্ডল উদ্ভাসিত করিলেন। তথায় সামগানকুশল তুম্বরু-প্রমুখ গন্ধর্ব্বসকল মধুরস্বরে সামগান করিতে লাগিল এবং ঘূতাচী, মেনকা, রম্ভা, পূর্ব্বাচিত্তি, স্বয়ম্প্রভা, উর্ব্বশী, মিশ্রকেশী, দণ্ডগৌরী, বরুথিনী, গাপালী, কুম্ভযোনি, প্ৰজাগরা, চিত্ৰসেনা, চিত্ৰলেখা ও সহা প্রভৃতি কমললোচনা কলকণ্ঠী নর্ত্তকীগণ, সিন্ধপুরুষদিগের চিত্তানুরঞ্জন করিবার নিমিত্ত স্থানে স্থানে নৃত্য করিতে লাগিলেন। তাহাদিগের সুললিত নিতম্বাভিনয়, কম্পমান পয়োধর ও মনোহর হাবভাব-বিলাস এবং কটাক্ষ-বিক্ষেপে সকলের চিত্ত চঞ্চল ও মন মোহিত হইল।