০২০. সৈন্যসজ্জায় সঞ্জয়ের মন্তব্য

২০তম অধ্যায়

সৈন্যসজ্জায় সঞ্জয়ের মন্তব্য

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সূৰ্য্যোদয় হইলে সেনাপতি ভীষ্মের অধীন কৌরবসেনা অথবা ভীমপরিপালিত পাণ্ডবসেনাএই উভয় পক্ষের কোন পক্ষ প্রথমে প্রফুল্লচিত্তে যুদ্ধার্থী হইয়াছিল? চন্দ্র, সূৰ্য্য ও বায়ু কাহাদিগের পশ্চাদবর্ত্তী হইয়াছিলেন? শ্বাপদগণ কাহার সেনাগণের প্রতি [প্রতিকূলে] গর্জ্জন [অনিষ্টসূচক লক্ষণ প্রকাশ] করিয়াছিল এবং কোন পক্ষের যুবকগণ প্রসন্নবদন হইয়াছিল? এই সমুদয় যথাবৎ বর্ণন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! উভয় পক্ষই তুল্যরূপে পরস্পর সমীপবর্ত্তী হইয়াছে; উভয় পক্ষই হৃষ্টচিত্তে ব্যূহিত হইয়া বনরাজির ন্যায় বিচিত্র এবং হস্তী, রথ ও অশ্বে পরিপূর্ণ হইয়াছে; উভয় পক্ষের সেনাগণই অপরিমিত, ভীমরূপ ও দুর্বিষহ এবং উভয় পক্ষই সৎপুরুষসমবেত [প্রধান প্রধান পুরুষপরম্পরামিলিত] ও স্বৰ্গলাভের নিমিত্ত প্ৰস্তুত হইয়াছে। কৌরবগণ পশ্চিমাভিমুখে ও পাণ্ডবগণ পূর্ব্বাভিমুখে অবস্থান করিতেছেন। কৌরবসেনা অসুরসেনার ন্যায় ও পাণ্ডবসেনা দেবসেনার ন্যায় শোভা পাইতেছে। সমীরণ পাণ্ডবগণের পৃষ্ঠভাগে প্রবাহিত হইতেছে; শ্বাপদগণ ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের প্রতি গর্জ্জন করিতেছে। আপনার পুত্রের হস্তিগণ শত্রুপক্ষের গজেন্দ্ৰসমূহের তীব্রতর মদগন্ধ সহ্য করিতে সমর্থ হইতেছে না। দুৰ্য্যোধন পদ্মবৰ্ণ, সুবর্ণীকক্ষ [স্বর্ণনির্ম্মিত সজায় শোভিতপার্শ্ব], জলমণ্ডিত, মদস্রাবী মাতঙ্গে আরোহণ করিয়া কুরুগণের মধ্যস্থলে অবস্থান করিতেছেন; বন্দী ও মাগধগণ তাঁহার স্তুতিবাদ করিতেছে। চন্দ্রের ন্যায় শ্বেতপ্রভ আতপত্র ও সুবর্ণমালা তাঁহার মস্তকে শোভা পাইতেছে। গান্ধাররাজ শকুনি পার্ব্বতীয় গান্ধারগণসমভিব্যাহারে [গান্ধারদেশজ সৈন্যগণসহ] তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। পিতামহ ভীষ্ম শ্বেতচ্ছত্র, শ্বেত ধনু, শ্বেত উষ্ণীষী, শ্বেত ধ্বজ, কৈলাসসদৃশ [শ্বেতপর্ব্বতসদৃশ] শ্বেত অশ্ব ও খড়েগ সুশোভিত হইয়া সকল সৈন্যের অগ্রগামী হইলেন। কতিপয় বাহ্লীক, অম্বষ্ঠ, ক্ষত্ৰিয়, সৈন্ধব, সৌবীর ও মহাশূল পাঞ্চনদগণ [পঞ্চনদদেশীয় সৈন্যসমূহ-বর্ত্তমান পাঞ্জাবী শিখ] এবং শল্য দুৰ্য্যোধনের সৈন্যদলের অন্তর্গত রহিলেন। অদীনসত্ত্ব মহাত্মা দ্রোণাচাৰ্য্য রক্তবর্ণ তুরঙ্গসংযোজিত সুবর্ণময় রথে আরোহণ ও শরাসন ধারণপূর্ব্বক প্রায় সমুদয় ভূপালের পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করিয়া রাজার ন্যায় গমন করিতে লাগিলেন। বাৰ্দ্ধক্ষত্রি, ভূরিশ্রবা, পুরুমিত্র ও জয়, ইঁহারা সকলে সৈন্যগণের মধ্যে এবং শাল্ব, মৎস্যদেশীয় ও কেকয়েরা পঞ্চভ্রাতা যুদ্ধাভিলাষী হইয়া গজসৈন্যমধ্যে অবস্থান করিলেন। যাঁহার বাণের অগ্রভাগ উৎকৃষ্ট, সেই মহাধনুৰ্দ্ধর চিত্ৰযোধী কৃপাচাৰ্য্য শক, কিরাত ও যবনগণসমভিব্যাহারে সেনার উত্তরভাগে গমন করিতে লাগিলেন। বিখ্যাত মহারথ অস্ত্রশস্ত্ৰধারী বৃষ্ণি ও ভোজগণ এবং সুরাষ্ট্রদেশীয় যোধগণকর্ত্তৃক রক্ষিত যে বৃহৎ সৈন্যদল—যাহা কৃতবর্ম্মা রক্ষা করিতেছিলেন, ঐ বৃহতীসেনা সৈন্যের দক্ষিণভাগে গমন করিল। যাহারা অর্জ্জুনের মৃত্যু বা তাহাকে জয় করিবার নিমিত্ত সৃষ্ট হইয়াছে, সেই সংশপ্তকগণের অযুতরাথী ও শৌৰ্য্যশালী ত্ৰিগর্ত্তগণও অস্ত্রশস্ত্ৰ লইয়া যে স্থানে অর্জ্জুন অবস্থিত ছিলেন, সেই স্থানেই সৈন্যগণসমভিব্যাহারে গমন করিলেন।

“মহারাজ! অত্যুৎকৃষ্ট একলক্ষ হন্তী; এক এক হস্তীর প্রতি, এক এক শত রথ; এক এক রথের প্রতি, এক এক শত অশ্ব; এক এক অশ্বের প্রতি, দশ দশ ধনুৰ্দ্ধার; এক এক ধনুৰ্দ্ধরের প্রতি, দশ দশ চর্মী [ঢালওয়ালা]; এইরূপে ব্যূহিত আপনার সেনাগণকে লইয়া সেনাপতি ভীষ্ম কোন দিন দৈব, কোন দিন গান্ধর্ব্ব ও কোন দিন আসুর ব্যূহ রচনা করেন। মহারথ-সঙ্কুল সাগরের ন্যায় গভীরধ্বনিযুক্ত এই ব্যূহ সমরে পশ্চিমাভিমুখে অবস্থান করে। আপনার সেই সেনা যেরূপ অসংখ্য ও ভয়ানক, পাণ্ডবগণের সেনা সেরূপ নয়; কিন্তু কেশব ও ধনঞ্জয় যাহাদিগের নেতা, আমার মতে তাহারাই বৃহৎ ও দুর্জ্জয়।”