০৫. বৃক্ষশাখায় অস্ত্রসংস্থাপনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের বিরাটনগরে প্রবেশ

৫ম অধ্যায়

বৃক্ষশাখায় অস্ত্রসংস্থাপনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের বিরাটনগরে প্রবেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর স্বরাজ্যলিপ্সু শ্মশ্রুধারী পাণ্ডবগণ গোধূলিঙ্গুলিত্রাণবন্ধন এবং ধনু, খড়গ, অন্যান্য আয়ুধ ও তূণ গ্রহণপূর্ব্বক পদচারে কালিন্দী নদীর দক্ষিণ-তীরে উপস্থিত হইলেন। তথা হইতে কখনো বা গিরিদুর্গে, কখনো বা বনদুর্গে অবস্থানপূর্ব্বক মৃগয়া করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। এই রূপে দশার্ণদেশের উত্তর, পাঞ্চালদেশের দক্ষিণ এবং যকৃল্লোম ও শূরসেনের মধ্য দিয়া মৎস্যদেশে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন দ্রুপদনন্দিনী রাজা যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! নানাবিধ ক্ষেত্র ও এই পথসমুদয়ের অবস্থা দৃষ্টিগোচর করিয়া স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, মৎস্যরাজের রাজধানী অতি-দূরবর্তী হইবে আমিও সাতিশয় পরিশ্রান্ত হইয়াছি; অতএব এই রাত্রি এই স্থানে অবস্থান করুন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! তুমি যত্নসহকারে পাঞ্চালীকে বহন কর। যখন অরণ্য অতিক্রম করিয়াছি, তখন একেবারে রাজধানীতে গিয়া অবস্থিতি করিব।” গজরাজতুল্য অর্জ্জুন দ্রৌপদীকে গ্রহণ করিয়া দ্রুত পদসঞ্চারে গমন করিয়া বিরাট-নগরের সমীপে উপস্থিত হইয়া অবতারিত করিলেন।

তখন রাজা যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে পাৰ্থ! এই আয়ুধ-সকল কোথায় রাখিয়া পুর প্রবেশ করিব? যদ্যপি আমরা অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ লইয়া নগর মধ্যে প্রবিষ্ট হই, তাহা হইলে সমুদয় লোক সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইবে। তোমার গাণ্ডীবধনু লোকমধ্যে কাহারও অবিদিত নাই; ইহা গ্ৰহণ করিয়া নগর মধ্যে প্রবেশ করিলে মনুষ্যমাত্রেই আমাদিগকে চিনিতে পরিবে। যেরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তদনুসারে অজ্ঞাতবাসসময়ে এক ব্যক্তি জানিতে পরিলে পুনরায় দ্বাদশ বৎসর বনবাস করিতে হইবে।”

অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! এই পর্ব্বতশৃঙ্গে এক দুরারোহ শমীবৃক্ষ দৃষ্টিগোচর হইতেছে, উহার শাখাসকল অতি ভয়ঙ্কর; বিশেষতঃ উহা শ্মশানের সমীপবর্তী ও হিংস্ৰজন্তু-সমাকীর্ণ দুৰ্গম অরণ্যে পরিবৃত। বোধ হয়, উহার সমীপে এমন কেহ নাই যে আমরা উহাতে অস্ত্রগুলি সংস্থাপিত করিবার সময় তাহার দর্শনপথে নিপতিত হইব। অতএব ঐ শমীবৃক্ষে আয়ুধ সমস্ত সংস্থাপন করিয়া নগরপ্রবেশপূর্ব্বক যথাযোগ্যরূপে কালযাপন করিব।”

ধনঞ্জয় ধর্ম্মরাজকে এই প্রকার কহিয়া শস্ত্ৰ-সংস্থাপন করিবার উপক্ৰম করিতে লাগিলেন। তিনি যাহা দ্বারা একরথে সমুদয় দেব ও মনুষ্যগণকে পরাজিত এবং সুসমৃদ্ধ জনপদ সকল আয়ত্ত করিয়াছিলেন, সেই গভীর-নিস্বন, অরাতিবলনিসূদন গাণ্ডীবশরাসন মৌর্ব্বীশূন্য [জ্যা-ছিলা] করিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির যে ধনু দ্বারা কুরুক্ষেত্র রক্ষা করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা হইতে অক্ষয় গুণ বিশ্লেষিত করিলেন। মহাবল ভীমসেন যদ্বারা পঞ্চাল-জনপদ পরাজিত ও দিগ্বিজয়কালে একাকী ভুরি ভুরি অরাতিগণকে দূরীভূত করিয়াছিলেন, বজ্রাহত পর্ব্বত-বিস্ফোটের ন্যায় যাহার বিস্ফারধ্বনি শ্রবণ করিয়া সপত্নগণ [শত্রু] রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিত, যাগার প্রভাবে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ পরাভূত হইয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি সেই শরাসন হইতে জ্যাপাশ অবতারিত করিলেন। যিনি কুলে, রূপে অনুপম বলিয়া নকুল নামে প্ৰসিদ্ধ, সেই ইন্দ্রসদৃশ, মিতভাষী, মাদ্রীনন্দন যে শরাসন দ্বারা পশ্চিমদিক পরাজয় করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহারও মৌর্বী অপাকৃষ্ট [খুলিয়া রাখা] হইল। দক্ষিণাচার-পরায়ণ সহদেব যে ধনু দ্বারা দক্ষিণদিক পরাজয় করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনিও তাহা হইতে গুণাপাশি বিযোজিত করিলেন। অনন্তর সেই সমস্ত ধনু এবং সুদীর্ঘ খড়গ, মহামূল্য তূণ ও ক্ষুরধার শর-সমুদয় একত্র সঙ্কলিত হইল।

তখন রাজা যুধিষ্ঠির নকুলকে কহিলেন, “বীর! তুমি এই শমীবৃক্ষে আরোহণ করিয়া, এই সমস্ত অস্ত্ৰ-শস্ত্র উহাতে সংস্থাপন কর।”

তখন নকুল সেই শমী-বৃক্ষে আরোহণপূর্ব্বক উহার যে যে স্থানে বক্রভাবে বারিবর্ষণ হয়, সেই সেই স্থানে গাণ্ডীব প্রভৃতি পাঁচখানি ধনু ও অস্ত্ৰ সুদৃঢ় পাশ দ্বারা দৃঢ়রূপে বন্ধন করিয়া রাখিলেন।

লোকে শবদুৰ্গন্ধ আত্মাণ করিয়া দূর হইতে এই বৃক্ষ পরিহার করিবে, এই অভিপ্ৰায়ে পাণ্ডবগণ সেই শমীবৃক্ষে একটি মৃতশারীর বন্ধন করিয়া রাখিলেন এবং গোপাল ও মেষপাল প্রভৃতি সকলের নিকটে এই কথা প্রচার করিয়া দিলেন যে, আমরা পূর্ব্বাচরিত্র কুলধর্ম্মানুসারে অশীতিবর্ষবয়স্কা গতাসু প্রসূতিকে ইহাতে বন্ধন করিয়া রাখিলাম।

তদনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির আপনাদিগের পঞ্চজনের জয়, জয়ন্ত, বিজয়, জয়ৎসেন ও জয়দ্বল এই পাঁচটি গূঢ় নাম রাখিয়া কৃষ্ণা ও ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে ত্রয়োদশ বর্ষ অজ্ঞাতসারে [প্রচ্ছন্নভাবে] অতিবাহন করিবার নিমিত্ত নগর মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।