০১৫. সঞ্জয়কর্ত্তৃক যুদ্ধবৃত্তান্তবর্ণন

১৫শ অধ্যায়

সঞ্জয়কর্ত্তৃক যুদ্ধবৃত্তান্তবর্ণন

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যে প্রশ্ন করিতেছেন, ইহা আপনার উপযুক্ত বটে, কিন্তু দুৰ্য্যোধনে দোষারোপ করা আপনার উচিত নয়; যে মনুষ্য আপনার দুশ্চরিত্রনিবন্ধন [দুষ্টস্বভাব জন্য] অশুভ ভোগ করে, অন্যর প্রতি সেই পাপের আশঙ্কা করা তাহার কর্ত্তব্য নহে। হে রাজন! যে ব্যক্তি সর্ব্বপ্রকার নিন্দনীয় কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, সে সকল লোকের বধ্য হয়। পাণ্ডব ও তাঁহাদের অমাত্যগণ আপনাদিগের অনুষ্ঠিত শঠতা বিলক্ষণ অনুভব করিয়াও কেবল আপনার মুখাপেক্ষায় অরণ্যমধ্যে দীর্ঘকাল উহা সহ্য করিয়াছেন।

“মহারাজ! আমি প্রত্যক্ষ ও যোগবলে তুরঙ্গ, মাতঙ্গ ও অমিততেজাঃ ভূপতিগণের যাহা কিছু দর্শন করিয়াছি, তাহা শ্রবণ করুন; শোকে মনোনিবেশ করিবেন না, এক্ষণে যেরূপ ঘটিতেছে, তাহা পূর্ব্বেই দর্শন করিয়াছি। অতএব যাহার প্রসাদে আমি দিব্যজ্ঞান [দৈবলব্ধ বোধশক্তি], অতীন্দ্ৰিয় [চক্ষুরাদি ইন্দ্ৰিয়ের অতীত] দৃষ্টি, দূর হইতে শ্রবণ, পরিচিত্ত-বিজ্ঞান [অন্যের মনোগত বিষয়ের বোধ], উৎকৃষ্ট আকাশগতি, শাস্ত্ৰবহিষ্কৃত [শাস্ত্র উল্লঙ্ঘনকারী] ব্যক্তিদিগের উৎপত্তির কারণজ্ঞান, অতীত ও অনাগত [ভবিষ্যৎ] বৃত্তান্তের অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি এবং যে মহাত্মার বরদানে অস্ত্রসমূহের অস্পৃশ্য [অবধ্য] হইয়াছি, এক্ষণে আপনার পিতা সেই ধীমান পরাশরনন্দনকে নমস্কার করিয়া ভরতগণের সেই অদ্ভুত লোমহর্ষণ বিচিত্ৰ যুদ্ধ সবিস্তারে [সবিস্তার—বিস্তারপূর্ব্বক] কহিতেছি, শ্রবণ করুন।

“সেই সমুদয় সেনা বিধানানুসারে ব্যূহিত্য [অযুদ্ধনীতি অনুযায়ী ব্যূহরচনায় রক্ষিত] ও সযত্ন [যুদ্ধার্থ যত্নবান] হইলে দুৰ্য্যোধন দুঃশাসনকে কহিলেন, “হে দুঃশাসন! তুমি শীঘ্র ভীষ্মের রক্ষাকারী রথীসকল যোজনা করিতে ও সেনাগণকে সজ্জীভূত হইতে আদেশ কর। চিরাকাঙ্ক্ষিত সসৈন্য পাণ্ডব ও কৌরবগণের সমাগম [যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হইবার সময়] সমুপস্থিত হইয়াছে; এক্ষণে ভীষ্মকে রক্ষা করা ব্যতিরেকে আর কাৰ্য্য নাই; তিনি রক্ষিত হইলে পাণ্ডব, সোমক ও সৃঞ্জয়গণকে সংহার করিবেন। সেই বিশুদ্ধাত্মা কহিয়াছেন যে, “আমি শিখণ্ডীকে বধ করিব না; শুনিয়াছি, শিখণ্ডী পূর্ব্বে স্ত্রী ছিল; অতএব সংগ্রামকালে আমি উহাকে পরিত্যাগ করিব।” সেই নিমিত্ত আমার মতে আমার পক্ষের সমুদয় বীর ভীষ্মকে বিশেষরূপে রক্ষা ও শিখণ্ডীর প্রাণসংহারে যত্নবান হউক এবং সর্ব্বাস্ত্ৰকুশল প্রাচ্য, প্রতীচ্য, দক্ষিণাত্য ও উদীচ্যগণও পিতামহকে রক্ষা করুক; অরক্ষিত হইলে মহাবল সিংহও শৃগালকর্ত্তৃক বিনষ্ট হয়; আমরা যেন সিংহরূপ ভীষ্মকে শৃগালরূপ শিখণ্ডীর হস্তে নিপাতিত না করি। হে দুঃশাসন! যুধামন্যু বামচক্ৰে ও উত্তমৌজা দক্ষিণচক্রে অবস্থান করিয়া অর্জ্জুনকে রক্ষা করিতেছে; আবার অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে রক্ষা করিতেছে, এইরূপ সুরক্ষিত ও ভীষ্মের পরিহার্য্য শিখণ্ডী যাহাতে ভীষ্মকে বিনষ্ট করিতে সমর্থ না হয়, তাহাই কর।’ ”