১৩. সময়পালনপর্ব্বাধ্যায়-পূর্ব্বসংকল্পিত বৃত্তিতে পাণ্ডবগণের বিরাটপুরে বাস

১৩তম অধ্যায়

সময়পালনপর্ব্বাধ্যায়-পূর্ব্বসংকল্পিত বৃত্তিতে পাণ্ডবগণের বিরাটপুরে বাস

জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, হে দ্বিজোত্তম! মহাবীৰ্য্য পাণ্ডবেরা এইরূপ প্রচ্ছন্নবেশে মৎস্য-নগরে থাকিয়া কি কি কাৰ্য্য করিয়াছিলেন?

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবেরা মহাত্মা ধর্ম্ম ও তৃণবিন্দুপ্ৰসাদে বিরাট-নগরে মৎস্যরাজের পরিচর্যাপূর্ব্বক অজ্ঞাতবাসে কালযাপন করিতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠির বিরাটরাজের সভাসদ হইলেন। তিনি রাজা, রাজপুত্র ও সমুদয় সভ্যগণের পরম প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাঁহার অক্ষবিদ্যায় অসাধারণ নৈপুণ্য থাকাতে, যেমন লোকে সূত্রবদ্ধ পক্ষিগণকে লইয়া স্বেচ্ছানুসারে ক্রীড়া করে, তদ্রূপ তিনি প্রতিদিন তাঁহাদিগের সহিত ক্রীড়া করিয়া বিপুল ধনোপার্জনপূর্ব্বক গোপনে ভ্রাতাদিগকে প্ৰদান করিতেন। ভীমসেন মৎস্যরাজ-প্রদত্ত মাংস প্রভৃতি বিবিধ ভক্ষ্যদ্রব্য যুধিষ্ঠিরকে প্ৰদান করিতেন। অর্জ্জুন অন্তঃপুরে যে সকল জীৰ্ণ-বস্ত্ৰ পাইতেন, তাহা বিক্রয় করিতে আসিয়া অন্যান্য পাণ্ডবদিগকে প্ৰদান করিতেন। সহদেব গোপবেশ ধারণপূর্ব্বক অন্যান্য ভ্রাতৃগণকে দধি, দুগ্ধ ও ঘৃত প্ৰদান করিতেন। নকুল অশ্বগণের উত্তমরূপ পালন করিয়া রাজপ্ৰসাদে যে অর্থ প্ৰাপ্ত হইতেন, তাহা ভ্ৰাতাদিগকে প্ৰদান করিতেন। তপস্বিনী দ্রৌপদী লোকের অজ্ঞাতসারে অতি সাবধান হইয়া পাণ্ডবগণকে নিরীক্ষণ করিতেন।

এইরূপে মহারথ পাণ্ডবগণ পরস্পরের সাহায্য করিয়া পুর্ণগর্ভস্থিতের ন্যায় অতি কষ্টে বিরাট-নগরে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা ধার্ত্তরাষ্ট্রের ভয়ে নিতান্ত শঙ্কিত হইয়া সর্ব্বদা দ্রৌপদীকে পৰ্য্যবেক্ষণ করিতেন।

ব্ৰহ্মমহোৎসব—মল্লক্রীড়া—জীমূত-মল্লবধ

অনন্তর চতুর্থ মাসে মৎস্য-নগরে সুসমৃদ্ধ ব্ৰহ্মা-মহোৎসব সমারব্ধ হইল। ঐ মহোৎসবে চতুর্দ্দিক হইতে মহাবলপরাক্রান্ত, মহাকায়, অসুরসন্নিভ, রাজসৎকৃত মল্পগণ সমুপস্থিত হইল। তাহারা নৃসন্নিধানে বারংবার স্ব স্ব অসাধারণ ক্ষমতা প্রকাশপূর্ব্বক পরিচিত হইয়াছে। তন্মধ্যে একজন সর্ব্বপ্রধান, সে সমুদয় মল্পগণকে রল্লে আহ্বান করিতে লাগিল, কিন্তু কেহই তাহার সম্মুখীন হইতে পারিল না। এইরূপে সমাগত সমস্ত মল্লগণ তদীয় বিক্ৰম-দর্শনে বিমোহিত হইলে মৎস্যরাজ স্বীয় সূদের [পাচক—ভীমসেন] সহিত তাহাকে যুদ্ধ করিতে কহিলেন। ভীমসেন রাজার আজ্ঞা শ্রবণ করিয়া অতিশয় দুঃখিত হইলেন; কারণ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত না হইলে রাজাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়, কিন্তু যুদ্ধ করিলে স্বীয় বাহুবল প্রকাশিত হইয়া যায়। যাহা হউক, অগত্যা তাঁহাকে যুদ্ধে সম্মত হইতে হইল। তখন তিনি বিরাটের সৎকার করিয়া শার্দ্দুলের ন্যায় ধীরে ধীরে মহারাঙ্গে প্রবেশপূর্ব্বক কটিবন্ধন করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সকলেই হৃষ্ট হইল। পরে তিনি বৃত্ৰাসুরসদৃশ বিখ্যাতবিক্রম মহামল্ল জীমূতকে তথায় আহ্বান করিলেন। মহাবল-পরাক্রান্ত মহোৎসাহ, রঙ্গভূমিগত সেই বীরযুগল ষষ্টিবৰ্ষীয় মহাকায় মত্তমাতঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তদনন্তর উভয়ে প্ৰহৃষ্ট ও পরস্পর জয়েচ্ছা হইয়া বাহুযুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন। বজ্র ও পর্ব্বতপাতের ন্যায় অতি ভয়ঙ্কর শব্দ হইতে লাগিল। তাঁহারা পরস্পরের ছিদ্রান্বেষণতৎপর ও বিজিগীষু হইয়া কখন সাংঘাতিক বাহুপ্রহার, কখন মুষ্ট্যাঘাত, কখন নিদারুণ পদাঘাত, কখন শলাকার ন্যায় সুতীক্ষ্ন নখাঘাত, কখন চপেটাঘাত, কখন পাষাণসুদৃঢ় জঘন-প্রহার ও কখন বা মস্তকে মস্তকে সংঘট্টিনপূর্ব্বক ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিলেন।

সেই বীরযুগল সংগ্রামে পরস্পরকে আকর্ষণ ও বিকর্ষণপূর্ব্বক জানুপ্রহার করিতে লাগিলেন এবং গভীর-শব্দে পরস্পরকে ভৎসনা করিয়া সুদৃঢ় লৌহ-পরিঘের ন্যায় বাহু দ্বারা বেষ্টন করিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন, সিংহ যেমন হস্তীকে আক্রমণ করে, তদ্রূপ সেই তর্জনগর্জনকারী মল্লকে আকর্ষণপূর্ব্বক ভুজবলে উৎক্ষিপ্ত করিয়া ঘুরাইতে লাগিলেন। তদর্শনে সমস্ত মল্ল ও মৎস্যদেশবাসিগণ সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তৎপরে মহাবাহু বৃকোদার তাহাকে একশতবার ঘূর্ণিত ও বিচেতন করিয়া ভূতলে নিক্ষিপ্ত ও নিস্পিষ্ট করিলেন।

এইরূপে লোকবিশ্রুত জীমূত বিনিহত হইলে বিরাটরাজ ও তাঁহার বন্ধুবর্গের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। তখন মৎসরাজ প্ৰসন্নমনে রঙ্গস্থলে ভীমসেনকে বিপুল বিত্ত প্রদান করিলেন। তৎপরে মহাবীর বৃকোদর ক্রমে ক্ৰমে সমস্ত মল্প ও বীরপুরুষদিগকে পরাভব করিয়া মৎস্যরাজের পরিমপ্ৰিয়পাত্ৰ হইলেন। মৎস্যরাজ যখন দেখিলেন যে, তথায় ভীমের তুল্য বীর পুরুষ আর কেহই নাই, তখন তিনি তাঁহাকে সিংহ, ব্যাঘ্র ও দ্বিরদগণের সহিত যুদ্ধে ব্যাপৃত করিয়া দিলেন।

অনন্তর বৃকোদর রাজাজ্ঞায় অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্ব্বক স্ত্রীগণসমক্ষে সিংহ, শার্দ্দুল প্রভৃতি পশুগণের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুন সঙ্গীত এবং নৃত্য দ্বারা বিরাটরাজ ও তাঁহার অন্তঃপুরচারিণী রমণীগণের চিত্তবিনোদন করিতে লাগিলেন। নকুল অশ্বগণকে বিনীত ও গমনবিষয়ে সুশিক্ষিত করিয়া রাজার সন্তোষ সম্পাদনপূর্ব্বক তাহার নিকট বহুতর অর্থ প্রাপ্ত হইলেন। সহদেব কর্ত্তৃক বৃষভগণ অতি বিনীত হইয়াছে দেখিয়া রাজা আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহাকে বহু বিত্ত প্ৰদান করিলেন। দ্রৌপদী মহারথ পাণ্ডবদিগকে নিতান্ত ক্লিশ্যমান দেখিয়া বিষগ্নমানে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।

হে মহারাজ! পুরুষৰ্ষভ পাণ্ডবেরা এইরূপে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাটভূপতির কাৰ্য্যসম্পাদনপূর্ব্বক তথায় বাস করিতে লাগিলেন।

সময়পালনপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত