০২৪. পাণ্ডবগণের দ্বৈতবনে বাস

২৪তম অধ্যায়

পাণ্ডবগণের দ্বৈতবনে বাস

বৈশম্পায়ন কহিলেন, কুরুজাঙ্গলনিবাসীরা প্রস্থান করিলে সত্যসন্দ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণকে কহিতে লাগিলেন, “আমাদিগকে দ্বাদশ বৎসর বিপিনে বাস করিতে হইবে, অতএব নানাবিধ মৃগপক্ষিসমাকীর্ণ, বহুপুষ্প-ফলোপেত, সজ্জনগণাশ্ৰিত, কল্যাণকর এক স্থান অন্বেষণ কর; যে স্থানে আমরা সুখস্বচ্ছন্দে এই কয়েক বৎসর অতিবাহিত করিতে পারি।”

ধনঞ্জয় মনস্বী মানবগুরু ধর্ম্মরাজকে গুরুজনোচিত সম্মান করিয়া কহিলেন, “হে রাজন! আপনি প্রতিনিয়ত দ্বৈপায়ন প্রভৃতি বৃদ্ধ মহর্ষিগণ ও ব্রাহ্মণনিবহের সহবাসলাভ করিয়া থাকেন; মনুষ্যলোকে আপনার অবিদিত কিছুই নাই। বিশেষতঃ যিনি প্রতিদিন ব্ৰহ্মলোক, দেবলোক, গন্ধৰ্ব্বলোক, অন্সরালোক প্রভৃতি সকল ভুবনের সর্ব্বস্থানে পৰ্যটন করেন, সেই মহাতপাঃ নারদ আপনার উপাসিত; আপনি ব্রাহ্মণগণের অনুভব ও প্রভাব বিশেষরূপে অবগত আছেন; কোন স্থানে গমন করিলে সুখস্বচ্ছন্দতালাভ হইতে পরিবে, তাহা আপনিই জানেন; অতএব আপনি যে স্থানে বাস করিতে বাসনা করেন, আমরাও তথায় বাস করিব। কিন্তু অনতিদূরবর্ত্তী সাধুজনাকীর্ণ, জলাশয়শালী, ফলকুসুমশোভিত ও দ্বিজগণনিষেবিত দ্বৈতবণ অতি পবিত্ৰ স্থান; যদ্যপি আপনি অনুমতি করেন, তবে ঐ স্থানে বাস করিলে অনায়াসে দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত হইতে পরিবে, সন্দেহ নাই।” ইহা শ্রবণ করিয়া যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পাৰ্থ! তুমি যাহা বলিলে, তাহাতে আমি সম্মত আছি, অতএব চল, এক্ষণে আমরা দ্বৈতবনে গমন করি।”

অনন্তর ধর্ম্মচারী পাণ্ডবগণ পবিত্র সরোমণ্ডিত সুরম্য দ্বৈতবনে বাস করিবার অভিলাষে সাগ্নিক, নিরাগ্নিক, স্বাধ্যায়ী, ভিক্ষু এবং অন্যান্য শংসিতব্ৰত মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ-সমভিব্যাহারে দ্বৈতবনে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, বর্ষাপ্রারম্ভে তমাল, তাল, আম্র, মধুক, নীপ, কদম্ব, সর্জ্জ, অর্জ্জুন, কণিকার প্রভৃতি মহীরুল-সকল প্রফুল্ল কুসুমসমূহে সুশোভিত হইয়া রহিয়াছে; ময়ূর, দাত্যুহ, চকোর, কোকিল প্রভৃতি বিহঙ্গমগণ উত্তুঙ্গ পাদপশিখরে উপবেশন করিয়া মধুরস্বরে গান করিতেছে; গিরিবরাকার মদমত্ত মাতঙ্গগণ করেণু যুথের সহিত ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে। মনোহর ভোগবতীতীরে চীরজটাধারী পুণ্যাত্মা ধার্ম্মিকদিগের আশ্রমে কত শত সিদ্ধার্ষিগণ অবস্থিতি করিতেছেন।

অনন্তর মহাত্মা অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির ভ্রাতা ও অন্যান্য সমভিব্যাহারীদিগের সহিত রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক সেই কাননমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বোধ হইল যে, অমরনাথ অমরাবতী পুরী প্রবেশ করিলেন। সিদ্ধাচারগণ মনস্বী যুধিষ্ঠিরের দর্শনমানসে আগমন করিলেন ও বনবাসীরা তাহার চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান হইলেন। যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলি হইয়া তাঁহাদিগকে যথাযোগ্য অভিবাদনপূর্ব্বক সকলের সহিত কাননমধ্যে প্রবেশ করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী ও অনুচরগণ একান্ত ক্লান্ত হইয়া ফল্লকুসুমসুশোভিত মহীরুহতালে উপবেশন করিলে ধর্ম্মপরায়ণ তপস্বিগণ আসিয়া যথাযোগ্য সম্মানপুরঃসর স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন। মহাগিরি যেমন করিবারসমূহে বেষ্টিত হইয়া শোভমান হয়, তদ্রূপ পাণ্ডবগণপরিবেষ্টিত সেই লতাবনবত মহাবৃক্ষও সুশোভিত হইয়াছিল।