০৭. অশ্বত্থামার শিব-শরণাগতি

৭ম অধ্যায়

অশ্বত্থামার শিব-শরণাগতি

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আচাৰ্য্যতনয় অশ্বত্থামা এইরূপে কৃতনিশ্চয় হইয়া রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক ভগবান্ ভবানীপতিকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, ‘হে দেবেশ! আমি অতি ক্ষুদ্রাশয়। এক্ষণে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে আত্মোপহার প্রদানপূর্ব্বক তোমার পূজা করিব। হে দেব! তুমি উগ্র, স্থাণু, শিব, রুদ্র, সর্ব্ব, ঈশান ও ঈশ্বর, তুমি গিরিশ, বরদ ও ভগবান্‌; তুমি শিতিকণ্ঠ, অজ ও শুক্র; তুমি দক্ষযজ্ঞনাশক হর; তুমি বিশ্বরূপ, বিরূপাক্ষ ও বহুরূপী; তুমি উমাপতি ও মহাগণপতি; তুমি শ্মশানবাসী ও খট্টাঙ্গধারী; তুমি জটিল; তুমি স্তুত্য, ঔত্য ও স্তূয়মান; তুমি অমোঘ, তুমি শত্রু; কৃত্তিবাস, বিলোহিত অসহ্য ও দুর্নিবার। তুমি ব্রহ্মস্রষ্টা, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মচারী; তুমি ব্রতধারী, তপস্বী ও তাপসগণের গতি; তুমি অনন্ত পরিষদ প্রিয়, ত্রিলোচন, ধনাধ্যক্ষ ও ক্ষিতিমুখ; তুমি পার্ব্বতীর হৃদয়বল্লভ ও স্কন্দের[কার্তিকেয়ের] পিতা; তুমি পিঙ্গ[পিঙ্গলবর্ণ], বৃষবাহন ও সূক্ষ্মবাসধারী; তুমি পার্ব্বতীর ভূষণ ও তাঁহাতে নিরত; তুমি শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠতর; তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেহই নাই। তুমি অস্ত্র-শস্ত্রবিশারদ, তুমি দিগন্ত ও দেশরক্ষক; তুমি চন্দ্রমৌলী ও হিরণ্যকবচধারী[সুবর্ণের বর্ম্মধারী]; অতএব একাগ্রচিত্তে তোমার শরণাগত হইলাম। যদি আমি আসন্নবর্তী বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারি, তাহা হইলে তোমাকে স্বীয় শরীরস্থ পঞ্চভূত[ক্ষিতি, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ-পঞ্চভূতাত্মক দেহ] উপহার প্রদানপূর্ব্বক পূজা করিব।

শিববিভূতি—গণদেবতাগণের আবির্ভাব

হে মহারাজ! মহারাজ অশ্বত্থামা এইরূপ স্তব করিলে তাঁহার সম্মুখে এক কাঞ্চনময় বেদী সহসা প্রাদুর্ভূত হইল। ভগবান্ হুতাশন স্বীয় তেজঃপ্রভাবে দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া সেই বেদীমধ্যে বিরাজমান হইলেন। বিচিত্র অঙ্গদধারী, উদ্যতবাহু, অসংখ্য করচরণসম্পন্ন, বহুমস্তক শোভিত, উজ্জ্বলবদন, উজ্জ্বলনেত্র, পৰ্বতাকার মহাগণ[ভূত প্রমথাদি গণদেবতা] সকলে তথায় উপস্থিত হইল। তাহাদিগের আকার কুকুর, বরাহ ও উষ্ট্রের ন্যায়; মুখ অশ্ব, শৃগাল, ভল্লুক, মার্জার, ব্যাঘ্র, দ্বীপী[হস্তী], বায়স, বানর, শুক, অজগর, হংস, সারস, চাস, কুর্ম্ম, নক্র, শিশুমার, পারাবত, তিমি, নকুল, বক, মহামকর, শ্যেন, মেষ ও ছাগলের ন্যায়; তাহাদিগের মধ্যে কেহ সহস্রলোচন, কাহারও উদর অতি বৃহৎ ও অঙ্গ কৃশ; কেহ কেহ মস্তকবিহীন, কেহ দীপ্তনেত্র ও দীপ্তজিহ্বা সম্পন্ন এবং কাহারও কেশ, কাহারও কর্ণ, কাহারও বা গাত্রলোম তাম্রবর্ণ। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ শঙ্খের ন্যায় ধবল, কেহ কেহ শঙ্খমাল্যধারী এবং কেহ কেহ শঙ্খশব্দের ন্যায় অতি গভীরকণ্ঠস্বরসম্পন্ন। কেহ কেহ জটাভারধারী, কেহ কেহ পঞ্চশিখাসম্পন্ন, কেহ কেহ মুণ্ডিতমুণ্ড, কাহারও কাহারও চারি দন্ত, কাহারও কাহারও চারি জিহ্বা, কাহারও কাহারও উদর অতি কৃশ, কাহারও কাহারও কর্ণ গর্দ্দভের ন্যায়; কেহ কেহ কিরীট ও উষ্ণীষধারী, কেহ কেহ মুঞ্জমেখলা [মুঞ্জতৃণের কটিবন্ধন] সমলঙ্কৃত, কেহ সর্পকিরীটশোভিত, কেহ কেহ সর্পাঙ্গদধারী, কেহ কেহ বিবিধ ভূষণে বিভূষিত, কাহারও কাহারও কেশকলাপ কুঞ্চিত এবং কাহারও কাহারও মস্তক পদ্ম ও উৎপলে সুশোভিত। উহাদের মধ্যে কেহ কেহ শতঘ্নী, কেহ কেহ বজ্র, কেহ কেহ মুষল, কেহ কেহ ভুশুণ্ডী, কেহ কেহ পাশ, কেহ কেহ দণ্ড, কেহ কেহ ধ্বজ, কেহ কেহ পতাকা, কেহ কেহ ঘণ্টা, কেহ কেহ পরশু, কেহ কেহ লগুড়, কেহ কেহ স্থুণা, কেহ কেহ খড়্গ এবং কেহ কেহ বা শরপরিপূর্ণ তূণীর ধারণ করিয়াছে। কাহারও কাহারও কলেবর পঙ্কলিপ্ত, কেহ কেহ শুক্লাম্বর ও শুক্লমাল্যধারী এবং কেহ কেহ নীল ও কেহ কেহ পিঙ্গলবর্ণ।

ঐ সময় তাহারা হৃষ্টান্তঃকরণে ভেরী, শঙ্খ, মৃদঙ্গ, ঝর্কর, আনক ও গোমুখ প্রভৃতি বিবিধ বাদ্য বাদিত করিতে লাগিল। কেহ কেহ গান, কেহ কেহ নৃত্য এবং কেহ কেহ লঙ্ঘন ও কেহ কেহ লম্ফ প্রদান করিতে আরম্ভ করিল; কেহ কেহ মহাবেগে ধাবমান হইল; উহাদের কেশকলাপ বায়ুবেগে উড্ডীন হইতে লাগিল। কেহ কেহ মত্তমাতঙ্গের ন্যায় বারংবার গমন করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সমস্ত দুর্বিষহ-বিক্রমসম্পন্ন, নানারাগ রঞ্জিতবসনধারী, রত্নখচিত-অঙ্গদ-সমলঙ্কৃত, শত্রুনাশক, ঘোররূপ মাংসভোজী, বসাশোণিতপায়ী পরিচারকগণমধ্যে কেহ কেহ চূড়ান্তসম্পন্ন, কেহ কেহ অতিশয় হ্রস্ব, কেহ কেহ অতিশয় দীর্ঘ, কাহারও কাহারও উদর পিঠের ন্যায়, কাহারও কাহারও ওষ্ঠ লম্বিত, কাহারও কাহারও মেঢ্র[পুং-চিহ্ন] ও অণ্ড[অণ্ডকোষ] অতি বৃহৎ; উহারা চন্দ্র, সূৰ্য্য ও গ্রহ-নক্ষত্র-পরিপূর্ণ নভোমণ্ডল ভূমণ্ডলে আনয়ন এবং চতুৰ্ব্বিধ লোকসকলকে বিনাশ করিতে সমর্থ। উহারা প্রতিনিয়ত নির্ভয়ে ভবানীপতির ভ্রূভঙ্গী সহ্য করিয়া থাকে। উহারা নিরন্তর স্বেচ্ছাচারপরায়ণ এবং ত্রৈলোকের ঈশ্বরেরও ঈশ্বর। উহারা হিংসাদ্বেষশূন্য হইয়া সর্ব্বদা আমোদ-প্রমোদে কালযাপন করে। ঐ সকল বাক্যবিন্যাসবিশারদ পারিষদগণ অষ্ট ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিয়াও গর্বিত হয় নাই। ভগবান শূলপাণি উহাদের কাৰ্য্যদর্শনে সাতিশয় বিস্মিত হইয়া থাকেন এবং উহাদের কর্ত্তৃক কায়মনোবাক্যে আরাধিত হইয়া ঔরস পুত্রের ন্যায় উহাদিগকে রক্ষা করেন। উহারা রুদ্রের একান্ত ভক্ত। উহারা চতুর্বিধ সোমরস এবং রোষাবিষ্টচিত্তে রাক্ষসদিগের শোণিত ও বসা পান করিয়া থাকে। উহারা বেদাধ্যয়ন, ব্রহ্মচর্য্য, তপস্যা ও ইন্দ্রিয়-সংযম দ্বারা ভগবান্ শশিশেখরকে প্রসন্ন করিয়া তাঁহার সলোকতা [১] লাভ করিয়াছে। কালয়ের অধিপতি রুদ্রদেব ও দেবী পার্ব্বতী ঐ সমস্ত আত্মানুরূপ পরিষদের সহিত একত্র ভোজন করিয়া থাকেন।

শিব উদ্দেশ্যে অশ্বত্থামার আত্মদান—খড়্গলাভ

অনন্তর ঐ সমস্ত ভূত বিবিধ বাদি বাদন, মুহুর্মুহুঃ গর্জন, আক্রোশ প্রকাশ ও সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক তেজঃপ্রদর্শন ও মহিমা বর্ণন করিবার মানসে স্ব স্ব প্রভাবজাল বিস্তার করিয়া মহাদেবকে স্তব করিতে করিতে দ্রোণপুত্রের প্রতি ধাবমান হইল। সেই ভীমদর্শন ভূতগণকে নিরীক্ষণ করিলে ত্রিলোক সমস্ত ব্যক্তিরই ভয় জন্মে, কিন্তু মহাবলপরাক্রান্ত অশ্বত্থামা তাহাদিগকে দেখিয়া কিছুমাত্র ভীত না হইয়া ভগবান্ শঙ্করকে আপনার দেহ উপহার প্রদান করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। তৎকালে তাঁহার কার্মুক সমিধ, শাণিত শরনিকর পরিত্র ও আত্মা হবিঃস্বরূপ হইল। অনন্তর তিনি রৌদ্রকর্ম্মা রুদ্রদেবকে সৌম্য-অস্ত্রে আপনার দেহ, উপহার প্রদানপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করিতে লাগিলেন, হে ভগবন্! আমি আঙ্গিরসকুলে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছি, অদ্য এই বিপকালে তোমার প্রতি ভক্তিভাবে সমাধিবলে হুতাশনে আত্মদেহ আহুতি প্রদান করিতেছি, তুমি এই উপহার প্রতিগ্রহ কর। সমস্ত ভূত তোমাতেই বিদ্যমান আছে এবং তুমিও সর্ব্বভূতে বিরাজমান রহিয়াছ; প্রধান প্রধান গুণসমুদয় তোমাতেই অবস্থান করিতেছে। এক্ষণে আমি শত্ৰুপরাজয়ে অসমর্থ হইয়া তোমার নিকট হবিঃস্বরূপ অবস্থান করিতেছি। তুমি আমাকে প্রতিগ্রহ কর। মহাবীর অশ্বত্থামা এই বলিয়া সেই প্রদীপ্ত পাবকযুক্ত বেদীতে আরোহণপূর্ব্বক হুতাশনমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তখন ভগবান্ রুদ্র তাঁহাকে হুতাশনমধ্যে প্রবিষ্ট, নিশ্চেষ্ট ও উর্দ্ধবাহু নিরীক্ষণ করিয়া হাস্যমুখে কহিলেন, ‘হে বীর! মহাত্মা কৃষ্ণ সত্য, শৌচ, আর্জব, দান, তপ, নিয়ম, ক্ষমা, ধৃতি, বুদ্ধি ও বাক্যে আমার আরাধনা করিয়াছেন; সুতরাং কৃষ্ণ অপেক্ষা আমার আর কেহই প্রিয়তর নাই। সেই কৃষ্ণের সম্মান রক্ষা ও তোমার বলবীৰ্য্য পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত আমি পাঞ্চালগণকে সুরক্ষিত করিয়া মায়াবল বিস্তার করিয়াছিলাম; কিন্তু পাঞ্চালেরা কালগ্রস্ত হইয়াছে, আজ তাহাদিগের জীবনরক্ষা হইবে না।’

ভূতভাবন ভগবান্ ভবানীপতি এই বলিয়া অশ্বত্থামাকে এক সুনির্ম্মল খড়্গ প্রদানপূর্ব্বক তাঁহার শরীরে প্রবেশ করিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা পুনরায় শঙ্করের তেজঃপ্রভাবে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর উদ্ভাসিত হইয়া যুদ্ধার্থে মহাবেগে শিবিরে ধাববান হইলেন। ভূত ও রাক্ষসগণ সাক্ষাৎ মহাদেবের ন্যায় দ্রোণতনয়কে শত্রুশিবিরে প্রবেশ করিতে দেখিয়া অদৃশ্যভাবে তাহার উভয় পার্শ্বে গমন করিতে লাগিল।”