২০. দ্ৰৌপদী-দুঃখে ভীমের শোক বাষ্পবারি বর্ষণ

২০তম অধ্যায়

দ্ৰৌপদী-দুঃখে ভীমের শোক বাষ্পবারি বর্ষণ

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে ভীম! আমি দ্যূতপ্রিয় রাজা যুধিষ্ঠিরের নিমিত্তই রাজসংসারে সৈরিন্ধ্রীবেশে অবস্থান করিয়া সুদেষ্ণার বশবর্তী হইয়াছি। দেখ, আমার কিরূপ দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে। এক্ষণে মনুষ্যের কোন দুঃখ প্রায় চিরস্থায়ী হয় না; অর্থসিদ্ধি ও জয়পরাজয় নিতান্ত অনিত্য, বিপদ ও সম্পদ সতত চক্রের ন্যায় পরিবর্ত্তিত হইতেছে; যদ্বারা জয় হয়, তাহাই পরাজয়ের কারণ হইয়া উঠে; আমি এই বিবেচনা করিয়া ভর্ত্তৃগণের উদয়কাল প্রতীক্ষা করিতেছি।

“হে ভীম! আমি যে জীবন্মৃত হইয়া রহিয়াছি, তাহা কি তুমি জানিতেছ না? লোকমুখে শুনিয়াছি, মনুষ্য অগ্ৰে দান করিয়া পশ্চাৎ প্রার্থনা করে এবং বিনাশ করিয়া বিনষ্ট ও পাতিত করিয়া পতিত হইয়া থাকে। এই সকলই দৈবমূলক। দৈবের অসাধ্য কিছুই নাই; দৈবকে অতিক্রম করা নিতান্ত দুষ্কর। আমি এই বুঝিয়া দৈবেরই প্রতীক্ষা করিতেছি। সলিল পূর্ব্বে যে স্থানে থাকে, পুনরায় তথায়ই প্রতিনিবৃত্ত হয়; ইহা বিবেচনা করিয়া আমি উদয়েরই প্রতীক্ষা করিতেছি। দৈব যাহার অর্থসিদ্ধির ব্যাঘাত করে, সে নিতান্ত দুরবস্থাপন্ন হয়, অতএব দৈবেরই আগমে যত্ন করা কর্ত্তব্য। হে বৃকোদর! আমি এক্ষণে যে কারণে এই কথার উল্লেখ করিলাম, তাহা শ্রবণ কর।

“দেখ, আমি দ্রুপদরাজের দুহিতা এবং পাণ্ডবগণের প্রিয়মহিষী হইয়াও এইরূপ দুরবস্থাপন্ন হইলাম। হায়! আমা ব্যতিরেকে কোন নারী এইরূপ অবস্থায় জীবিত থাকিতে বাসনা করে? আমার এই ক্লেশ কৌরব, পাণ্ডব ও পাঞ্চালদিগকে অবশ্যই অবমানিত করিবে। কোন নারী পুত্ৰ, শ্বশুর ও ভ্রাতৃগণে পরিবৃত হইয়া এইরূপ ক্লেশে কালযাপন করিয়া থাকে? যে বিধাতার প্রভাবে আমাকে এইরূপ অত্যাচার সহ্য করিতে হইতেছে, বোধ হয়, আমি বাল্যকালে তাঁহারই কোন অপকার করিয়া থাকিব। দেখ, এক্ষণে আমি কিরূপ বিবৰ্ণ হইয়াছি। তাদৃশ বিষম দুঃখের সময়ও এরূপ হই না। পূর্ব্বে আমার যে প্রকার সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তাহা তোমার অগোচর নাই, এক্ষণে সেই আমি দাসীভাব-প্ৰাপ্ত হইয়াছি, কিরূপে শান্তিলাভ করিব? যখন মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় ভস্মাচ্ছন্ন অনলের ন্যায় এই স্থানে অবস্থান করিতেছেন, তখন আমি এই বিষয় দৈবায়ত্ত বলিয়া অবশ্যই স্বীকার করি। প্রাণীগণের গতি বোধগম্য হওয়া নিতান্ত দুষ্কর। দেখ, তোমাদিগের যে এইরূপ দুরবস্থা হইবে, পূর্ব্বে কেহই ইহা বুঝিতে পারে নাই।

“হে মহাবীর! তোমরা ইন্দ্ৰতুল্য বলিয়া আমি তোমাদিগের নিকট সম্পূর্ণ সুখ-প্রত্যাশা করিয়াছিলাম, কিন্তু এক্ষণে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট লোকদিগেরই সুখ-স্বচ্ছন্দতার বৃদ্ধি দেখিতেছি। দেখ ভীম! তোমরা এরূপ দুরবস্থায় পতিত হইয়াছ বলিয়া আমার কি দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে! কালের কি বিপরীত গতি! পূর্ব্বে এই সসাগরা ধরা আমারই অধিকৃত ছিল; এক্ষণে আমাকে শঙ্কিত-মনে সুদেষ্ণার বশবর্ত্তিনী হইতে হইয়াছে। পূর্ব্বে অনুচরেরা আমার অগ্র-পশ্চাৎ গমন করিত, কিন্তু এক্ষণে আমি সুদেষ্ণার অগ্রপশ্চাৎ গমন করিতেছি। আর এই একটি দুঃখ আমার নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে যে, আমি আৰ্য্যা কুন্তী ব্যতিরেকে কদাচ কাহারও গাত্ৰবিলোপন [উদ্ধৰ্ত্তনদ্রব্য] পেষণ করি নাই; কিন্তু এক্ষণে আমাকে সুদেষ্ণার চন্দন পেষণ করিতে হইতেছে। দেখ, আমার পাণিতল আর পূর্ব্ববৎ কোমল নাই; এক্ষণে কিণাঙ্কিত হইয়াছে। আমি আৰ্য্যা কুন্তী ও তোমাদিগকে কখন ভয় করি নাই; কিন্তু এক্ষণে রাজভবনে কিঙ্করীরূপে অবস্থান করিয়া বিরাটের নিকট ভীত হইতেছি। অনুলেপন সুমৃষ্ট [উত্তমরূপে পিষ্ট] হইয়াছে কি না দেখিয়াই বা রাজা কি বলিবেন, সর্ব্বদা এই শঙ্কা করিয়া থাকি; কারণ, আমি ভিন্ন অন্য কেহ চন্দন পেষণ করিলে কদাচ রাজার মনোনীত হয় না।”

দ্ৰৌপদী এইরূপে আপনার দুঃখবৃত্তান্ত কীৰ্তন করিয়া ভীমের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্ব্বক রোদন করিতে লাগিলেন। পরে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীমের হৃদয় বিদীর্ণপ্ৰায় করিয়া কহিলেন, “বোধ হইতেছে, পূর্ব্বে আমি দেবগণের নিকট বিলক্ষণ অপরাধ করিয়া

থাকিব, নতুবা কেন কর্ম্মকরী [দাসী] হইয়া এত ক্লেশে জীবনধারণ করিতে হইবে?” তখন বৃকোদর দ্রৌপদীর কিণাঙ্কিত পাণিতল নিরীক্ষণ ও মুখমণ্ডলে দৃষ্টি প্রদানপূর্ব্বক অনিবাৰ্য্যবেগে বাষ্পবারি বিসর্জন করিয়া কহিতে লাগিলেন।