৭৮. অর্জ্জুনবাণে বিধ্বস্ত কৌরবগণের পলায়ন

৭৮তম অধ্যায়

অর্জ্জুনবাণে বিধ্বস্ত কৌরবগণের পলায়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে মহাবীর অর্জ্জুন সংগ্রামস্থলে রথনির্ঘোষ ও সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, হে গোবিন্দ! তুমি সত্বর অশ্ব সঞ্চালন কর।’ তখন বাসুদেব কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! যে স্থানে ভীমসেন অবস্থান করিতেছেন, অচিরাৎ তোমাকে তথায় লইয়া যাইতেছি। এই বলিয়া তিনি তুষারশঙ্খধবল মণিমুক্তাভূষিত সুবর্ণজালজড়িত অশ্বসকলকে বায়ুবেগে সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন সেই কৌরবগণের চতুরঙ্গিণী সেনা জম্ভাসুরসংহারার্থ প্রস্থিত নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট বস্ত্রধারী সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় মহাবীর অর্জ্জুনকে বিজয়াভিলাষে গমন করিতে দেখিয়া ক্রোধভরে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইল। অনবরত নিক্ষিপ্ত শরনিকরের ভীষণ নিঃস্বন, রথচক্রের ঘর্ঘর রব ও অশ্বগণের খুরশব্দে রণস্থল ও দিঙ্মণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অনন্তর ত্রিলোকরক্ষাৰ্থ অসুরগণের সহিত বৈকুণ্ঠনাথ বিষ্ণুর যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, তদ্রূপ কৌরবপক্ষীয় বীরগণের সহিত অর্জ্জুনের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় একাকীই ক্ষুর, অর্দ্ধচন্দ্র ও নিশিতভল্লদ্বারা বিপক্ষগণের বিবিধ আয়ুধ, ছত্র, চামর, ধ্বজ, অশ্ব, রথ, পদাতি ও মাতঙ্গগণকে বিনষ্ট করিয়া অরাতিগণের মস্তক ও ভুজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিতে লাগিলেন। বীরগণ অর্জ্জুনের শরাঘাতে বিকৃতরূপ হইয়া বায়ুবেগে উন্মুলিত অরণ্যানীর ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। যোধ ও ধ্বজপতাকাসম্পন্ন সুবর্ণজালসমলঙ্কৃত বৃহদাকার করিনিকর সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া প্রজ্বলিত অচলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল।

“হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপে বজ্রসন্নিভ শরনিকরে অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও রথ বিদীর্ণ করিয়া বলাসুরসংহারার্থে প্রস্থিত সুররাজের ন্যায় সূতপুত্রের বিনাশসাধনার্থ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি মকর যেমন সারে প্রবেশ করে, তদ্রূপ বিপক্ষসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন কৌরবপক্ষীয় বীরগণ একান্ত হৃষ্টচিত্তে প্রভুত রথ, পদাতি, হস্তী ও অসমভিব্যাহারে দ্রুতবেগে অর্জ্জুনের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সমাগমসময়ে ক্ষুভিত মহাসাগরের জলকল্লোলের ন্যায় তুমুল কোলাহল সমুত্থিত হইল। এইরূপে সেই ব্যাঘ্রের ন্যায় বিক্রমসম্পন্ন মহারথগণ প্রাণভয় পরিত্যাগ করিয়া পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলে মহাবীর পাণ্ডুনন্দন প্রবল বায়ু যেমন জলদজালকে সমাহত করে, তদ্রূপ তাঁহাদের সৈন্যগণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তখন তাঁহারা সকলে মিলিয়া অর্জ্জুনের অভিমুখে আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তাঁহাদের শরে আহত হইয়া ক্রোধভরে বিশিখজালে সহস্র সহস্র রথ, হস্তী ও অশ্ব ধ্বংস করিয়া ফেলিলেন। মহারথগণ পার্থশরে নিপীড়িত ও ভীত হইয়া স্পন্দনহীনের ন্যায় স্ব স্ব রথে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন নিশিত শরনিকরে সংগ্রামনিপুণ চারিশত মহারথের প্রাণ সংহার করিলেন। হতাবশিষ্ট যোধগণ ধনঞ্জয়ের নানাবিধ শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে পলায়ন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের পলায়নসময়ে বাহিনী[সৈন্যশ্রেণী]মুখে গিরিসঙ্ঘট্টিত [পর্ব্বতাঘাতে উত্থিত] জলধিজলের গভীর নিঃস্বনের ন্যায় তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন শরনিকরে সেই সৈন্যগণকে বিদ্ধ ও বিদারিত করিয়া সূতপুত্রের সেনাগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। পূর্ব্বে গরুড় নাগগণের প্রতি ধাবমান হইলে যেরূপ ভীষণ শব্দ হইয়াছিল, মহাবীর ধনঞ্জয় অরাতিসেনাগণের প্রতি ধাবমান হইলে তদ্রূপ ঘোরতর শব্দ হইতে লাগিল।।

“হে মহারাজ। ঐ সময় বায়ুর ন্যায় বেগবান্ মহাবলপরাক্রান্ত পবনন্দন ভীমসেন সেই গভীর শব্দ শ্রবণে পরমপ্রীত ও অর্জ্জুনকে দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইলেন এবং হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক প্রাণপণে সুতীক্ষ্ণশরনিকরে কৌরসেনাসকলকে বিমর্পিত করিয়া বায়ুবেগে সমরাঙ্গনে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। কৌরবসৈন্যগণ সেই যুগান্তকালীন কৃতান্তসদৃশ বৃকোদরের অলৌকিক পরাক্রম দর্শনে একান্ত ভীত ও শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ইতস্ততঃ বিঘূর্ণিত ও ভগ্ন অর্ণবানের ন্যায় বিদীর্ণ হইতে লাগিল।

ভীমসেনসমরে কৌরবপরাজয়

“হে মহারাজ। এইরূপে মহাবীর ভীমসেন সেই কৌরবসৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিতে আরম্ভ করিলে রাজা দুৰ্য্যোধন মহাধনুর্দ্ধর সৈনিকপুরুষ ও যোধগণকে কহিলেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা অবিলম্বে ভীমসেনকে নিহত কর। ভীমসেন বিনষ্ট হইলেই পাণ্ডবসৈন্য নিঃশেষিত হইবে। দুর্য্যোধন এইরূপ কহিলে ভূপালগণ তাঁহার আদেশানুসারে চতুর্দ্দিক হইতে শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। অসংখ্য হস্তী, রথী ও পদাতি বৃকোদরকে পরিবেষ্টন করিল। তখন তিনি নক্ষত্রপরিবেষ্টিত পরিবেষ [পরিধিমণ্ডল] মধ্যগত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় শোভাধারণ করিলেন। অনন্তর নরপালগণ সকলে সমবেত হইয়া রোষারুণিতনেত্রে বৃকোদরের বিনাশবাসনায় তাহার উপর অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন কৃতান্তসদৃশ প্রভাবসম্পন্ন মহাবীর ভীমসেন সন্নতপর্ব্বশরনিকরে সেই প্রভূত সৈন্য বিদারণপূর্ব্বক মহাজাল বিনিগত মৎস্যের ন্যায় তাহাদের মধ্য হইতে বহির্গত হইলেন এবং অবিলম্বে দশসহস্র অনিবার্য্য হস্তী, দুইশত মনুষ্য, পাঁচসহস্র অশ্ব ও একশত রথ বিনাশ করিয়া সংগ্রামস্থলে বৈতরণীনদীর ন্যায় ভীরুজনের ভয়বর্দ্ধন শোণিতনদী প্রবাহিত করিলেন। রথসমুদয় ঐ নদীর আবর্ত্ত, হস্তিসকল গ্রাহ [বৃহৎ কুম্ভীর], মনুষ্যগণ মীন, অসমুদয় নক্র [সাধারণ কুমীর], কেশকলাপ শৈবাল ও শাদ্বল, মজ্জা পঙ্ক, মস্তকসমুদয় উপলখণ্ড, কার্ম্মুকনিচয় কাশকুসুম, শরনিকর নিম্নোন্নত ভূমি, উষ্ণীষ ফেনা, হারাবলী পদ্ম, পার্থিব রজ তরঙ্গমালা এবং ছত্র ও ধ্বজ উহার হংসস্বরূপ শোভমান হইল। ঐ নদী ভীরুজনের নিতান্ত দুস্তর; কিন্তু বলবিক্রমসম্পন্ন নির্ভীকচিত্ত বীরগণ উহা অনায়াসে সমুত্তীর্ণ হইতে পারেন। হে মহারাজ! ঐ সময়ে রথীসত্তম ভীমসেন যে যে স্থানে প্রবেশ করিলেন, সেই সেই স্থানেই অসংখ্য যোধ বিনষ্ট হইল।

“তখন রাজা দুৰ্য্যোধন ভীমসেনের সেই অদ্ভুত কাৰ্য্যদর্শনে শকুনিকে কহিলেন, ‘হে মাতুল! তুমি অবিলম্বে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেনকে পরাজিত কর। উহাকে জয় করিতে পারিলেই সমুদয় পাণ্ডবসৈন্য পরাজিত হইবে।’

ভীম-শকুনিসমর শকুনিপলায়ন

“হে কুরুরাজ! প্রবল প্রতাপশালী সুবলনন্দন শকুনি দুর্য্যোধনের বাক্য শ্রবণানন্তর ভ্রাতৃগণে পরিবেষ্টিত হইয়া সমরে অবতীর্ণ হইলেন এবং তীরভূমি যেমন সমুদ্রবেগ নিবারণ করে, তদ্রূপ বৃকোদরের অভিমুখীন হইয়া তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর বৃকোদর শকুনির শরনিকরে নিবারিত হইয়া তাঁহার অভিমুখীন হইলেন। তখন সুবলনন্দন বৃকোদরের বক্ষঃস্থলে সুবর্ণপুঙ্খ শিলাশাণিত নারাচনিকর নিক্ষেপ করিলেন। নারাচসকল মহাত্মা ভীমসেনের বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তখন ভীমসেন অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া রোষভরে শকুনির প্রতি এক সুবর্ণবিভূষিত ঘোরতর সায়ক প্রয়োগ করিলেন। সুবলনন্দন সেই ভীষণ শর সমাগত সন্দর্শন করিয়া হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক সপ্তধা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর ভীমসেন তদ্দর্শনে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া হাস্য করিয়া একভল্লে শকুনির শরাসন ছেদন করিলেন। প্রবলপ্রতাপ শকুনিও অবিলম্বে সেই ছিন্নকার্ম্মুক পরিত্যাগ এবং অন্য শরাসন ও সন্নতপর্ব্ব যোড়শ ভল্ল গ্রহণপূর্ব্বক দুইভল্লে ভীমের ছত্র ও একভল্ল ধ্বজ ছেদন করিয়া সাতভল্লে তাঁহাকে, দুইভল্লে সারথিকে এবং চারিভল্লে চারি অশ্বকে বিদ্ধ করিলেন। তখন প্রবল প্রতাপশালী ভীমসেন যৎপরোনাস্তি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শকুনির প্রতি এক সুবর্ণদণ্ড লৌহময় শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। সেই ভীমভুজনির্ম্মুক্ত ভুজগজিহ্বার ন্যায় চঞ্চল ভীষণ শক্তি মহাবেগে শকুনির উপর নিপতিত হইল। শকুনি তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্টচিত্তে সেই শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক ভীমসেনের উপর নিক্ষেপ করিলেন। তখন সেই কনকভূষিত ভীষণ শক্তি ভীমসেনের বামবাহু বিদারণপূর্ব্বক নভোমণ্ডলচ্যুত বিদ্যুতের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। তদ্দর্শনে কৌরবগণ চতুর্দ্দিক হইতে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন কৌরবগণের সেই সিংহনাদ সহ্য করিতে না পারিয়া সত্বর জ্যাযুক্ত অন্য শরাসন গ্ৰহণপূর্ব্বক ইতস্ততঃ বিচরণপূর্ব্বক প্রাণপণে মুহূৰ্তমধ্যে শরজালে শকুনির সৈন্যগণকে সমাচ্ছন্ন করিলেন এবং অবিলম্বে সুবলনন্দনের চারি অশ্ব ও সারথিকে বিনাশপুর্ব্বক একভল্লে তাঁহার রথধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর শকুনি সেই অশ্বশূন্য রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও শরাসন বিস্ফোরণ করিয়া রোষারুণনেত্রে চতুর্দ্দিক হইতে ভীমসেনকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিলেন। প্রবলপ্রতাপ ভীমসেন তদ্দর্শনে অবিলম্বে সুবলনন্দনের শরজাল নিরাকৃত করিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে তাঁহার শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে নিশিতশরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অরাতিকৰ্ষণ শকুনি বৃকোদরের প্রহারে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া মৃতের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন। ঐ সময় আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন শকুনিকে বিহ্বল অবলোকন করিয়া ভীমসেনের সমক্ষেই তাঁহাকে রথে আরোপিত করিলেন। কৌরবগণ শকুনিকে তদবস্থ অবলোকনপূর্ব্বক সমরপরাঙ্মুখ হইয়া ভীতচিত্তে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিলেন। হে কুরুরাজ! রাজা দুর্য্যোধনও শকুনিকে ভীমকর্ত্তৃক পরাজিত দেখিয়া একান্ত ভয়াবিষ্টচিত্তে মাতুলের জীবিত রক্ষা প্রত্যাশায় তাঁহাকে লইয়া সমরাঙ্গন হইতে অপসৃত হইলেন।

“কৌরব সৈন্যগণ নরপতিকে রণপরাঙ্মুখ অবলোকন করিয়া দ্বৈরথযুদ্ধ পরিত্যাগপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন তাহাদিগকে সমরপরাঙ্মুখ ও পলায়নপরায়ণ অবলোকন করিয়া অসংখ্য শরবর্ষণপূর্ব্বক মহাবেগে তাহাদিগের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন সেই কৌরবসৈন্যগণ ভীমশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া সূতপুত্রের আশ্রয় গ্রহণ করিল। হে মহারাজ! ভগ্ন নৌকাসংস্থিত নাবিকেরা যেমন দ্বীপ প্রাপ্ত হইয়া আশ্বাসযুক্ত হয়, তদ্রূপ কৌরবসৈন্যগণও তৎকালে মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণকে আশ্রয় করিয়া আশ্বাসিত হইল এবং পরমাহ্লাদসহকারে পুনরায় প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিল।”