৭৪. কৃষ্ণের সমর-উৎসাহদান

৭৪তম অধ্যায়

কৃষ্ণের সমর-উৎসাহদান

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর উদারস্বভাব বাসুদেব কর্ণবিনাশে কৃতসঙ্কল্প অর্জ্জুনকে পুনরায় কহিলেন, ‘হে সখে! অদ্য সপ্তদশ দিন হইল, অনবরত অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্য বিনষ্ট হইতেছে। পাণ্ডবপক্ষীয় বিপুল সৈন্য কৌরবগণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত ও নিহত হইয়া অল্পমাত্রাবশিষ্ট হইয়াছে। কৌরবগণ প্রভূত গজবাজিসম্পন্ন হইয়াও তোমার প্রভাবে শমনসদনে আতিথ্য গ্রহণ করিতেছে। যাবতীয় পাণ্ডব, সৃঞ্জয় ও সমাগত অন্যান্য ভূপালগণ তোমাকে আশ্রয় করিয়াই সমরে অবস্থান করিতেছেন। পাঞ্চাল, পাণ্ডব, মৎস্য, কারূষ ও চেদিগণ কর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়াই শত্রুক্ষয়ে কৃতকার্য্য হইয়াছেন। হে অর্জ্জুন! পাণ্ডবগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি তোমাকর্ত্তৃক রক্ষিত না হইয়া কৌরবগণকে জয় করিতে পারে? আমি নিশ্চয় কহিতেছি যে, কৌরবসৈন্যের কথা দূরে থাকুক, তুমি সুরাসুরনরসমবেত ত্রিলোক পরাজয় করিতে পার। তুমি ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি দেবরাজসদৃশ পরাক্রমশালী হইয়াও ভগদত্তকে পরাজয় করিতে পারে? ভূপতিগণ তোমার বাহুবলে রক্ষিত সৈন্যগণকে দর্শন করিতেও সমর্থ নহেন। শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন তোমাকর্ত্তৃক নিয়ত রক্ষিত হইয়াই ভীষ্ম ও দ্রোণকে নিপাতিত করিয়াছে, নচেৎ সেই ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী মহারথ বীরদ্বয়কে পরাজয় করা কাহার সাধ্য? তুমি ভিন্ন আর কোন্ ব্যক্তি অনেক অক্ষৌহিণীর অধীশ্বর যুদ্ধদুর্ম্মদ শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, দ্রোণাচাৰ্য্য, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, সৌমদত্তি, কৃতবর্ম্মা, জয়দ্ৰথ, শল্য ও রাজা দুৰ্য্যোধনকে পরাজিত করিতে পারে? তোমার শরে নানা জনপদবাসী অসংখ্য ক্ষত্রিয় বিনষ্ট এবং রথ ও হস্তিসমুদয় বিদীর্ণ হইতেছে। ধ্বজবাজিসম্পন্ন গোবাস, দাসমীয়, বসাতি, প্রাচ্য, বাটধান ও অভিমানী ভোজসৈন্যগণ তোমার ও ভীমের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে। তুমি ভিন্ন অন্য কোনও ব্যক্তিই দুর্য্যোধনের কার্য্যে নিযুক্ত কৌরবগণপরিবৃত অতি ভীষণ উগ্রস্বভাব দণ্ডপাণি যুদ্ধবিশারদ তুষার, যবন, খস, দাৰ্ব্বাভিসার, দরদ, শক, রামঠ, কৌঙ্কন, অন্ধ্রক, পুলিন্দ, কিরাত, স্লেচ্ছ, পাৰ্ব্বতীয় ও সাগরকূলবর্তী শুরগণকে জয় করিতে পারে নাই। যদি তুমি দুৰ্য্যোধনসৈন্যগণকে ব্যহিত ও উগ্র দেখিয়া স্বপক্ষরক্ষণে তৎপর না হইতে, তাহা হইলে কোন্ ব্যক্তি তাহাদিগের প্রতি গমনে সমর্থ হইত? কোপাবিষ্ট পাণ্ডবগণ তোমাকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়াই সাগরের ন্যায় সমুদ্ধত ধূলিপটলসংবৃত কৌরবসৈন্যগণকে বিদারণপূর্ব্বক নিহত করিয়াছেন। আজ সাত দিন হইল, মগধাধিপতি মহাবলপরাক্রান্ত জয়সেন অভিমন্যুর শরে নিপাতিত হইয়াছেন এবং ভীমসেন গদাপ্রহারে তাঁহার অনুগামী দশসহস্র হস্তীর প্রাণসংহারপূর্ব্বক অন্যান্য শত শত নাগ ও রথ বিনষ্ট করিয়াছেন। হে ধনঞ্জয়! কৌরবগণ এইরূপে মহাবীর ভীমসেনের ও তোমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া অশ্ব, রথ ও মাতঙ্গগণের সহিত নিহত হইয়াছেন।

‘পাণ্ডবগণ এইরূপে কৌরবদিগের সেনামুখ নিপাতিত করিলে পরমাস্ত্রবিদ ভীষ্মদেব শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক চেদি, কাশী, পাঞ্চাল, করূষ, মৎস্য ও কৈকয়গণকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া নিহত করিয়াছেন। তাঁহার শরাসনচ্যুত পরদেহবিদারণ সুবৰ্ণপুঙ্খ শরনিকরে নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইয়াছিল। তিনি এক একবার শর পরিত্যাগপূর্ব্বক সহস্র সহস্র রথ বিনষ্ট করিয়া লক্ষ লক্ষ মনুষ্য ও হস্তী নিহত করিয়াছেন। তাহারা বিনষ্ট হইয়া পতন সময়ে অসংখ্য গজ, অশ্ব ও রথ সংহার করিয়াছে। মহাবীর ভীষ্মদেব ধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া দশ দিন অনবরত শরবর্ষণপূর্ব্বক রথসকল রথীশূন্য ও গজবাজিগণকে নিহত করিয়া রুদ্র ও বিষ্ণুর ন্যায় অদ্ভুত রূপ প্রদর্শনপুরঃসর চেদি, পাঞ্চাল ও কেকয়দেশীয় নরপতিদিগকে নিপীড়িত করিয়া প্রদীপ্ত পাবকের ন্যায় পাণ্ডবসৈন্যগণকে দগ্ধ করিয়াছেন। তিনি সমরসাগরে নিমগ্ন মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধনের উদ্ধারার্থ সমরে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলে সৃঞ্জয়দিগের সহস্র কোটি পদাতি ও অন্যান্য মহীপালগণ তাঁহাকে দর্শন করিতেও সমর্থ হয়েন নাই। তিনি তৎকালে একাকী সমরে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকে বিভ্রাবণপূর্ব্বকঅদ্বিতীয় বীর বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। শিখণ্ডী কেবল তোমার প্রভাবে রক্ষিত হইয়া নতপৰ্ব্ব শরনিকরে পুরুষপ্রধান কুরুপিতামহকে নিপাতিত করিয়াছে। ফলতঃ মহাত্মা ভীষ্ম তোমার প্রভাবেই শরশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন।

‘প্রতাপান্বিত দ্রোণাচার্য্যও, পাঁচ দিন শত্রুসৈন্য নিপীড়িত করিয়াছিলেন। তিনি অভেদ্য ব্যূহ নিৰ্মাণপূর্ব্বক পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণকে সংহার ও জয়দ্রথকে রক্ষা করেন। ঐ অন্তকসদৃশ প্রতাপশালী মহাবীরের শরানলে রাত্রিযুদ্ধে অসংখ্য যোধ [যোদ্ধা] দগ্ধ হইয়াছিল। মহাবলপরাক্রান্ত আচার্য্য এইরূপে অরাতি সংহার করিয়া পরিশেষে ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে প্রাণত্যাগপূর্ব্বক পরম গতি লাভ করিয়াছেন; কিন্তু বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে অবশ্যই ইহা স্থির হইবে যে, তোমার প্রভাবেই দ্রোণের মৃত্যু হইয়াছে। যদি তুমি সমরে কর্ণপ্রমুখ রথীগণকে নিবারিত না করিতে, তাহা হইলে ঐ বীর কখনই নিহত হইতেন না। তুমি দুর্য্যোধনের সমুদয় বল নিবারিত করিয়াছিলে, এই নিমিত্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে নিপাতিত করিয়াছে। হে ধনঞ্জয়! তুমি জয়দ্রথ বিনাশসময়ে যেরূপ বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছ, আর কোন্ ক্ষত্রিয় তদ্রূপ করিতে পারে? তুমি সমুদয় কৌরবসৈন্য বিদারণ ও মহাবীর ভূপতিগণকে সংহার করিয়া অস্ত্রবলে সিন্ধুরাজকে নিহত করিয়াছ। ভূপালগণ সিন্ধুরাজের বধ আশ্চৰ্য্য বলিয়া জ্ঞান করেন, কিন্তু তুমি ঐরূপ বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক তাঁহাকে নিহত করিলেও আমার উহা আশ্চৰ্য্য বোধ হয় না। এই সমুদয় ক্ষত্রিয়কে বিনষ্ট করিতে তোমার সম্পূর্ণ একদিন যুদ্ধ করিতে হয় না। যদি তোমার একদিনের যুদ্ধ উহারা সহ্য করিতে পারে, তবে আমি উহাদিগকে বলবান বলিয়া স্বীকার করি। তুমি মুহূৰ্তমধ্যেই সকলকে বিনষ্ট করিতে পার, সন্দেহ নাই। যখন ভীষ্ম ও দ্রোণ নিহত হইয়াছেন, তখন ভয়ঙ্কর কৌরবসেনা বীরশূন্য হইয়াছে। যোধগণ নিপতিত এবং হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয় বিনষ্ট হওয়াতে অদ্য কৌরবসৈন্য চন্দ্র, সূৰ্য্য ও তারকাবিহীন আকাশের ন্যায় শোভা পাইতেছে। পূর্ব্বকালে অসুরসেনাগণ যেমন ইন্দ্রের পরাক্রমে ধ্বংস হইয়াছিল, এক্ষণে কৌরবসেনারাও তদ্রূপ তোমার প্রভাবে বিনষ্ট হইতেছে। সম্প্রতি কৌরবপক্ষে অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা, কর্ণ, মদ্ররাজ ও কৃপাচাৰ্য্য—এই পাঁচজন মাত্র মহারথ অবশিষ্ট রহিয়াছেন। অতএব পূৰ্বে বিষ্ণু যেমন দানবগণকে বিনাশ করিয়া ইন্দ্রকে বসুন্ধরা প্রদান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি অদ্য ঐ পাঁচ মহারথকে নিপাতিত করিয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে গিরিকাননসমন্বিত পৃথিবী প্রদান কর। পূৰ্বে দানবগণ বিষ্ণুকর্ত্তৃক নিহত হইলে দেবতারা যেমন হৃষ্ট হইয়াছিলেন, অদ্য অরাতিগণ তোমার হস্তে বিনষ্ট হইলে পাঞ্চালগণ সেইরূপ পরিতুষ্ট হইবেন। যদি তুমি তোমার গুরু দ্বিজাগ্রগণ্য দ্রোণাচার্য্যের সম্মানরক্ষার্থে অশ্বত্থামার প্রতিও আচার্য্যগৌরবপ্রযুক্ত কৃপাচার্য্যের প্রতি দয়া কর এবং যদি মাতৃবান্ধব বলিয়া কৃতবর্ম্মাকে ও মাতার ভ্রাতা বলিয়া মদ্ৰাধিপতি শল্যকে বিনাশ না কর, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই; কিন্তু পাপাত্মা নীচাশয় সূতপুত্রকে অবিলম্বে নিশিতশরে নিহত করা তোমার অবশ্যকর্ত্তব্য। আমি কহিতেছি, এ বিষয়ে তোমার অণুমাত্র দোষ নাই। দুর্য্যোধন রজনীযোগে যে তোমাদিগকে মাতার সহিত দগ্ধ করিতে উদ্যত এবং সভামধ্যে দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইয়াছিল, পাপপরায়ণ সূতপুত্রই তৎসমুদয়ের মূল। দুরাত্মা দুর্য্যোধন প্রতিনিয়ত কর্ণ হইতেই পরিত্রাণ বাসনা করিয়া থাকে এবং তাহাদ্বারা আমাকে নিগ্রহ করিতে উদ্যত হইয়াছিল। দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রতনয় ইহা স্থিরনিশ্চয় করিয়াছে যে, কর্ণই পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। ঐ দুরাত্মা তোমার বলবীৰ্য্য অবগত হইয়াও একমাত্র কর্ণকে আশ্রয় করিয়া তোমাদের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছে। দুরাত্মা সূতপুত্রও ‘আমি পাণ্ডবগণকে এবং মহারথ বাসুদেবকে পরাজিত করিব’ বলিয়া প্রতিনিয়ত দুরাশয় দুৰ্য্যোধনকে উৎসাহ প্রদানপূর্ব্বক সমরাঙ্গনে গৰ্জন করিয়া থাকে। ফলতঃ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন তোমাদের প্রতি যেসকল অত্যাচার করিয়াছে, পাপাত্মা কর্ণ সেই সমুদয়েরই মূলীভূত। অতএব আজ তুমি তাহাকে বিনাশ কর।

‘হে ধনঞ্জয়! বৃষভস্কন্ধ [বৃষতুল্য উন্নত স্কন্ধ] মহাযশস্বী অভিমন্যু দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও কৃপাচাৰ্য্যপ্রমুখ বীরগণকে পরাজিত এবং মাতঙ্গগণকে আরোহিশূন্য, মহারথদিগকে রথশূন্য, তুরঙ্গগণকে আরোহিহীন, পদাতিগণকে আয়ুধ ও জীবিতবিহীন এবং সমস্ত সৈন্য ও মহারথগণকে বিদলিত করিয়া, হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক সমরে অগ্রসর হইতেছিল, ক্রূরকর্ম্মকারী ছয় মহারথ একত্র হইয়া সেই মহাবীরকে নিহত করিয়াছে। আমি সত্যদ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি যে, তদ্দর্শনাবধি ক্ৰোধানলে আমার দেহ দগ্ধ হইতেছে। দুরাত্মা কর্ণ অভিমন্যুর সংগ্রামসময়ে তাহারও দ্রোহে প্রবৃত্ত হইয়াছিল; কিন্তু তাহার শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া তাহার অগ্রে অবস্থান করিতে সমর্থ হয় নাই। তৎকালে ঐ দুরাত্মা সুভদ্রাতনয়ের প্রহারে জর্জরীভূত, উৎসাহশূন্য ও জীবনে নিরাশ হইয়া ক্রোধভরে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ক্ষণকাল অজ্ঞানাবস্থায় অবস্থান করিয়াছিল। পরিশেষে ঐ দুরাত্মা দ্রোণচার্য্যের তৎকালসদৃশ ক্রূরতর বাক্য শ্রবণ করিয়া অভিমন্যুর শরাসন ছেদন করিলে, ছলপরায়ণ অবশিষ্ট পাঁচ মহারথ সেই আয়ুধশূন্য বালককে শরনিকরে বিনষ্ট করিল। তদ্দর্শনে কর্ণ ও দুর্যোধন ব্যতীত আর সকলেই সাতিশয় দুঃখিত হইয়াছিল।

‘হে ধনঞ্জয়! পাপাত্মা সূতপুত্র সভামধ্যে কৌরব ও পাণ্ডবগণসমক্ষে দ্রৌপদীকে কহিয়াছিল, “হে বিপুলনিতম্বে [স্থূলনিতম্বিনি-পাছা যাহার স্থূল, এরূপ নারী] মৃদুভাষিণি কৃষ্ণে! পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইয়া শাশ্বত নরকে গমন করিয়াছে; অতএব তুমি অন্য কাহাকে পতিত্বে বরণ কর। তোমার পূর্ব্বপতিগণ বর্ত্তমান নাই, অতএব এক্ষণে দাসীভাবে কুরুরাজসদনে প্রবেশ করা তোমার কর্ত্তব্য।” হে পার্থ। পাপপরায়ণ সূতনন্দন তোমার সমক্ষেই দ্রৌপদীর প্রতি এইরূপ কুবাক্যসকল প্রয়োগ করিয়াছিল। আজ তুমি জীবিতনাশক শিলাশিত সুবর্ণময় শরনিকরে সেই দুরাত্মাকে নিহত করিয়া তাহার দুর্ব্বাক্যের এবং সে তোমার প্রতি যেসকল পাপাচরণ করিয়াছে, তৎসমুদয়ের শাস্তিবিধান কর। আজ কর্ণ গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত ঘোরতর শরনিকর স্পর্শ করিয়া ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য্যের বচন স্মরণ করুক। আজ তোমার ভুজনিক্ষিপ্ত বিদ্যুৎসপ্রভ [বিদ্যুৎকান্তি] সুবর্ণপুঙ্খ নারাচসমুদয় সূতপুত্রের বর্ম্ম ও মর্ম্ম বিদারণপূর্ব্বক শোণিত পান করিয়া উহাকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করুক। আজ ভূপালগণ তোমার শরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হইয়া হাহাকারপূর্ব্বক বিষমনে কর্ণকে রথ হইতে নিপতিত এবং তাহার বান্ধবগণ দীনভাবে তাহাকে শোণিতমগ্ন ও রণশয্যায় শয়ান অবলোকন করুক। ঐ দুরাত্মার হস্তিকক্ষ ধ্বজ তোমার ভল্পে উন্মখিত হইয়া কম্পিত হইতে হইতে ভূতলে নিপতিত হউক। মহাবীর শল্য তোমার শরনিকরে সংচূৰ্ণিত, যোধশূন্য, কনকমণ্ডিত রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভয়ে পলায়ন করুক। আজ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সূতপুত্রকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া রাজ্যলাভ ও জীবনে নিরাশ হউক।

‘ঐ দেখ, পাঞ্চালগণ দুরাত্মা কর্ণের নিশিতশরে নিপীড়িত হইয়াও তোমাদিগের উদ্ধারবাসনায় ধাবমান হইতেছে। সূতপুত্র পাঞ্চালগণ, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্নের তনয়গণ, নকুলপুত্র শতানীক, নকুল, সহদেব, দুর্ম্মুখ, জনমেজয়, সুধর্ম্মা ও সাত্যকিকে আক্রমণ করিয়াছে। ঐ কর্ণশরনিপীড়িত পরমাত্মীয় পাঞ্চালগণের সিংহনাদ শ্রবণগোচর হইতেছে। পূর্ব্বে মহাবীর ভীষ্ম একাকী শরজালে সমুদয় পাণ্ডবসৈন্যকে সমাচ্ছন্ন করিয়াছিলেন; কিন্তু মহাধনুর্দ্ধর পাঞ্চালগণ তাঁহার শরে নিপীড়িত হইয়াও সমপরাঙ্মুখ বা ভীত হয় নাই। উহারা ধনুর্দ্ধরগণের অস্ত্রগুরু, প্রজ্বলিত পাবকসদৃশ তেজস্বী দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজয় করিবার নিমিত্ত নিয়ত সমুদ্যত হইত এবং কর্ণ হইতে ভীত হইয়া কখন রণপরাঙ্মুখ হয় নাই। আজ হুতাশন যেমন শলভদিগকে ভস্মসাৎ করে, তদ্রূপ দুরাত্মা সূতপুত্র মিত্ৰাৰ্থ প্রাণপরিত্যাগে উদ্যত মহাবেগে সমাগত সেই পাঞ্চালগণকে শমনসদনে প্রেরণ করিতেছে। অতএব হে অর্জ্জুন! তুমি আজ প্লবস্বরূপ হইয়া সেই সমরসাগরে নিমগ্ন মহাধনুর্দ্ধরগণকে পরিত্রাণ কর। সূতপুত্র ঋষিসত্তম পরশুরামের নিকট হইতে যে ভীষণ অস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছিল, আজ সেই শত্রুসৈন্যতাপন তেজঃপ্রজ্বলিত অস্ত্র প্রাদুর্ভুত করিয়াছে। সেই অস্ত্রের প্রভাবে অসংখ্য শর সমুৎপন্ন হইয়া ভ্রমরপংক্তির ন্যায় রণস্থলে ভ্রমণ করিয়া পাণ্ডবসৈন্যগণকে সন্তপ্ত করিতেছে। পাঞ্চালগণ কর্ণের অনিবার্য্য অস্ত্রপ্রভাবে ব্যথিত হইয়া চারিদিকে ধাবমান হইতেছে। ঐ দেখ, অমর্ষপরায়ণ ভীমসেন সৃঞ্জয়গণে পরিবৃত হইয়া কর্ণের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহার নিশিতশরনিকরে নিপীড়িত হইতেছেন। এক্ষণে তুমি যদি সূতপুত্রকে উপেক্ষা কর, তাহা হইলে ঐ মহাবীর শরীরস্থিত ব্যাধির ন্যায় প্রবল হইয়া পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে বিনাশ করিবে। হে অর্জ্জুন! যুধিষ্ঠিরবলমধ্যে তোমা ভিন্ন এমন কোন যোদ্ধা নাই যে, সূতপুত্রের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়া সুস্থশরীরে স্বগৃহে প্রত্যাগমন করে। আমি সত্য বলিতেছি, তোমা ভিন্ন আর কেহই সমারাঙ্গনে কর্ণের সহিত কৌরবগণকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে না; অতএব আজি তুমি নিশিতশরজালে মহারথ কর্ণের বিনাশরূপ মহৎকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া স্বীয় প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালন, কীৰ্ত্তিলাভ ও অস্ত্রশিক্ষার সার্থকতা সম্পাদনপূর্ব্বক সুখী হও।’ ”