৮৩. কর্ণকরে বিশোক—সাত্যকিশরে প্রসেনসংহার

৮৩তম অধ্যায়

কর্ণকরে বিশোক—সাত্যকিশরে প্রসেনসংহার

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহারথ সূতপুত্র মহাবীর অর্জ্জুনের বীর্য্যপ্রভাবে কৌরবগণকে পলায়নপরায়ণ দেখিয়া, বায়ু যেমন জলদজাল ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ পাঞ্চালতনয়গণকে ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিলেন। তিনি অঞ্জলিকাস্ত্রে জনমেজয়ের অশ্বসমুদয় ও সারথিকে নিপাতিত করিলেন এবং ভল্লদ্বারা শতানীক ও সুতসোমকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহাদিগের কার্ম্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তিনি ছয়শরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিদ্ধ ও শরনিকরে তাঁহার অশ্বসকলকে নিহত করিয়া সাত্যকির অশ্বগণকে সংহারপূর্ব্বক কৈকয়পুত্র বিশোককে বিনষ্ট করিলেন। কৈকয়সেনাপতি উগ্ৰকর্ম্মা রাজকুমারকে নিহত দেখিয়া কর্ণাত্মজ প্রসেনকে উগ্ৰবেগসম্পন্ন শরনিকরে সমাহত ও বিচলিত করিলেন। মহাবীর কর্ণ তদ্দর্শনে হাস্যমুখে তিন অর্দ্ধচন্দ্ৰশরে কৈকয়সেনাপতির ভুজযুগল ও মস্তক ছেদন করিলে তিনি গতাসু হইয়া পরশুচ্ছিন্ন [কুড়োল দিয়া কাটা] শালবৃক্ষের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন। অনন্তর কর্ণাত্মজ প্রসেন শরাসন আকর্ণ আকর্ষণ ও নিশিত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকিকে সমাচ্ছন্ন করিয়া যেন নৃত্য করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শাণিতশরে তৎক্ষণাৎ প্রসেনের প্রাণসংহার করিলেন। মহাবীর কর্ণ পুত্রের নিধন দর্শনে ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া সাত্যকিকে সংহার করিবার বাসনায় ‘অরে শৈনেয়! তুই নিহত হইলি’ এই বলিয়া তাঁহার প্রতি এক ভীষণ শর বিসর্জনপুর্ব্বক গর্জন করিতে লাগিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী তদ্দর্শনে অবিলম্বে তিনবাণে সেই কর্ণনিক্ষিপ্ত শর ছেদন করিয়া তাঁহাকে তিনশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাতেজস্বী সূতপুত্র ক্রোধভরে ক্ষুরদ্বারা শিখণ্ডীর শরাসন ও ধ্বজ ছিন্ন এবং ছয়শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নতনয়ের শিরচ্ছেদনপুর্ব্বক সুশাণিত শরদ্বারা সুতসোমকে বিদ্ধ করিলেন।

“হে মহারাজ! এইরূপে সেই তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত ও ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র নিহত হইলে বাসুদেব অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! ঐ দেখ, কর্ণ প্রায় সমস্ত পাঞ্চালদিগকে বিনষ্ট করিল, এক্ষণে তুমি গিয়া উহাকে সংহার কর। নরপ্রবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের বাক্যশ্রবণে ঈষৎ হাস্য করিয়া পাঞ্চালদিগকে ভয় হইতে পরিত্রাণ করিবার নিমিত্ত অবিলম্বে সূতপুত্রের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন এবং গাণ্ডীব বিস্ফারণ ও তলধ্বনি করিয়া সহসা শান্ধকার বিস্তারপূর্ব্বক অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও ধ্বজসকল ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার শরাসনের টঙ্কারশব্দ অন্তরীক্ষমণ্ডলে ও ভয়ঙ্কর গিরিগহ্বরে প্রধ্বিনিত হইতে লাগিল। ঐ সময় ভীমসেন পৃষ্ঠরক্ষক হইয়া তাঁহার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীরদ্বয় রথারোহণে সূতপুত্রের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন।

“এদিকে মহাবীর সূতপুত্র সোমকদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া রথ, অশ্ব ও মাতঙ্গগণকে নিহত এবং শরনিকরে দিঙ্মণ্ডল সমাচ্ছাদিত করিলেন। তখন উত্তমৌজা, জনমেজয়, যুধামন্যু ও শিখণ্ডী ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত সমবেত ও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক সূতপুত্রকে বিমর্পিত ও বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু রূপ, রস প্রভৃতি বিষয়সমুদয় যেমন সংযমী ব্যক্তিকে ধৈৰ্য্যচ্যুত করিতে পারে না, তদ্রূপ সেই পাঞ্চালদেশীয় পাঁচ মহাবীর একত্র হইয়াও সূতপুত্রকে রথ হইতে বিচলিত করিতে সমর্থ হইলেন না। অনন্তর মহাবীর কর্ণ শরনিকরদ্বারা ঐ মহাবীরগণের ধনু, ধ্বজ, অশ্ব, সারথি ও পতাকাসকল অবিলম্বে ছিন্নভিন্ন করিয়া পাঁচ পাঁচ বাণে তাঁহাদিগকে আঘাত করিয়া সিংহের ন্যায় গৰ্জন করিতে লাগিলেন। তৎকালে সকলেই তাঁহার শরাসননিঃস্বনে অদ্রিম পরিশোভিত পৃথিবী বিদীর্ণ হইল অনুমান করিয়া একান্ত বিষন্ন হইয়া উঠিল। মহাবীর সূতপুত্র ইন্দ্ৰচাপসদৃশ নিতান্ত আয়ত শরাসন আকর্ষণ ও অনবরত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক করজালবিরাজিত পরিবেষসম্পন্ন প্রচণ্ড সূৰ্য্যমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি শিখণ্ডীকে দ্বাদশ, উত্তমৌজাকে ছয় এবং যুধামন্যু, জনমেজয় ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিন তিন শরে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে সেই পাঞ্চালদেশীয় পাঁচ মহারথ ভোগ্যবস্তু সকল যেমন জিতেন্দ্রিয়কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া থাকে, তদ্রূপ সূতপুত্রের বলবীর্য্যে পরাজিত ও নিশ্চেষ্ট হইয়া অবস্থান করিলেন। তখন দ্রৌপদীর আত্মজগণ স্বীয় মাতুলগণকে, সূতপুত্রবিহিত বিদ্‌পসাগরে নিমগ্ন অবলোকন করিয়া, নৌকাভঙ্গনিবন্ধন সমুদ্রে নিমগ্ন বণিগণকে যেমন অন্য নৌকা উদ্ধার করে, তদ্রূপ সুসজ্জিত রর্থদ্বারা তাঁহাদিগকে উদ্ধার করিলেন।

“অনন্তর মহারথ সাত্যকি নিশিতশরনিকরে সূতপুত্র-প্রেরিত শরসমূহ খণ্ড খণ্ড ও তাঁহার কলেবর ক্ষতবিক্ষত করিয়া আটশরে মহারাজ দুৰ্য্যোধনকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর কৃপ, কৃতবর্ম্মা, কর্ণ ও রাজা দুৰ্য্যোধন সুনিশিত শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক সাত্যকিকে প্রহার করিতে লাগিলেন। শিনিপ্রবীর সাত্যকি সেই চারি মহাবীরের সহিত সমরানল প্রজ্বলিত করিয়া, দিক্‌পতিদিগের সমরে প্রবৃত্ত দানবরাজের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন এবং অনবরত শরনিকরবর্ষী, অতিমাত্র আয়ত, মহাস্বন শাসন প্রভাবে শরৎকালীন নভোমণ্ডলমধ্যস্থিত প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় একান্ত দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিলেন। ইত্যবসরে পাঞ্চালদেশীয় মহারথগণ সমবেত হইয়া দেবতারা যেমন দেবরাজকে রক্ষা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর সাত্যকিকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তখন আপনার সৈনিকগণের সহিত বিপক্ষদিগের দেবাসুর-সংগ্রামের ন্যায় রথ, অশ্ব ও মাতঙ্গ-বিনাশন তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। রথী, হস্তী, অশ্ব ও পদাতিসকল নানাবিধ শস্ত্রজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া পরিভ্রমণ করিতে লাগিল। কতকগুলি পরস্পর আহত ও স্বলিত হইয়া আর্ত্তনাদ করিতে আরম্ভ করিল এবং কতকগুলি শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া প্রাণপরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইল।।

দুঃশাসন-ভীমসেনসমর

“এদিকে মহাবীর দুঃশাসন শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক নির্ভয়ে। ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন; মহাবলপরাক্রান্ত ভীমও সিংহ। যেমন রুরুর অভিগমন করে, তদ্রূপ দ্রুতবেগে তঁহার প্রতিগমন করিলেন। তখন শম্বর ও শক্রের ন্যায় সেই রোষাবিষ্ট বীরদ্বয়ের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। অনবরত মদধারাবর্ষী মন্মথাসক্তচিত্ত মাতঙ্গদ্বয় যেমন করিণীর নিমিত্ত পরস্পরকে আঘাত করিয়া থাকে তদ্রূপ সেই বীরদ্বয় জয়শ্রী লাভ করিবার অভিলাষে দেহবিদারণক্ষম সুতীক্ষ্ণ শরনিকরদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম দুই ক্ষুরদ্বারা দুঃশাসনের কামুক ও ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া তাঁহার ললাটদেশে এক শর নিক্ষেপপূর্ব্বক সুতীক্ষ্ণ শরে সারথির মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন রাজকুমার দুঃশাসন সত্বর অন্য শাসন গ্রহণ করিয়া দ্বাদশশরে বৃকোদরকে বিদ্ধ করিলেন এবং স্বয়ং অশ্বের রশ্মি গ্রহণপূর্ব্বক পুনরায় ভীমের প্রতি শনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি ভীমকে লক্ষ্য করিয়া এক সূৰ্য্যমরীচিসপ্রভ [সূর্য্যকিরণের ন্যায় সমুজ্জ্বল], হীরকরত্নসমলঙ্কৃত, সুবর্ণজালজড়িত, অশনিতুল্য নিতান্ত দুঃসহ, দেহবিদারণক্ষম, ভীষণ শর পরিত্যাগ করিলেন। ভীমসেন সেই শরে, নির্ভিন্নকলেবর ও গতাসুর ন্যায় স্বলিতদেহ হইয়া বাহু প্রসারণপূর্ব্বক রথমধ্যে নিপতিত হইলেন এবং অবিলম্বে পুনরায় সংজ্ঞালাভপূর্ব্বক ভীষণ রবে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।”