৮০. পরস্পর সৈন্যসংহারী অর্জ্জুন-কর্ণাভিযান

৮০ অধ্যায়

পরস্পর সৈন্যসংহারী অর্জ্জুন-কর্ণাভিযান

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময়ে অরাতিঘাতন অর্জ্জুন মহারণে কৌরবপক্ষীয় চতুরঙ্গিণীসেনা নিপাতিত করিলেন। তাঁহার শরনিকরে অসংখ্য সৈন্য নিহত হওয়াতে সংগ্রামস্থানে। বীরজনের সুপ্ৰতর ভীরুগণের দুস্তর শোণিতনদী প্রবাহিত হইল। মাংস, মজ্জা ও অস্থিসকল ঐ নদীর পঙ্ক নরমস্তকসমুদয় উহার উপলখণ্ড; হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয় তীরস্বরূপ; আতপত্ৰসকল হংস; হারসকল পদ্ম; উষ্ণীষসমুদয় ফেনা; শরাসনসকল শরবন, রথসমুদয় উড়ুপ [৪] এবং বর্ম্ম ও চর্ম্মসকল উহার আবৰ্তস্বরূপ বোধ হইতে লাগিল। বীরগণ বৃক্ষসমুদয়ের ন্যায় উহার স্রোতে প্রবাহিত হইতে লাগিলেন এবং কাক ও গৃধ্রুগণ উহার উভয় পার্শ্বে ভীষণ রবে চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল।

“অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় কর্ণকে ক্রোধান্বিত দেখিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ সূতপুত্রের ধ্বজ লক্ষিত হইতেছে। ভীমসেনপ্রমুখ বীরগণ উহার সহিত যুদ্ধ করিতেছেন। পাঞ্চালগণ কর্ণের প্রভাবে ভীত হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতেছে। ঐ দেখ, রাজা দুর্য্যোধন শ্বেতাতপত্রে পরিশোভিত হইয়া কর্ণশায়কনির্ভিন্ন পাঞ্চালগণকে বিদ্রাবিত করিতেছে। মহারথ কৃপ, কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামা সূতপুত্ৰকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া দুর্য্যোধনের রক্ষায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। আমরা উহাদিগকে নিধন না করিলে উহারা নিশ্চয়ই সোমকগণকে সংহার করিবেন। ঐ দেখ, রশ্মিগ্রহণবিশারদ মদ্ররাজ শল্য সূতপুত্রের রথসঞ্চালন করিতেছেন; অতএব তুমি মহারথ কর্ণের অভিমুখে আমার রথচালন কর। আমি সূতপুত্রকে সংহার না করিয়া কদাপি সমরাঙ্গন হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইব না। যদি আমি এক্ষণে কর্ণের অভিমুখীন না হই, তাহা হইলে ঐ দুরাত্মা নিশ্চয়ই আমাদিগের সমক্ষে সৃঞ্জয় ও পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণকে নিঃশেষিত করিবে।

“হে মহারাজ! মহাত্মা রাসুদেব ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে কর্ণের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবর্তিত করিবার মানসে সূতপুত্রের অভিমুখে রথসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবসৈন্যগণ তদ্দর্শনে আশ্বাসযুক্ত হইল। তখন পুরন্দরের বজ্রের ন্যায় ও জলধির তরঙ্গের ন্যায় মহাবীর ধনঞ্জয়ের রথের ভীষণ নির্ঘোষ হইতে লাগিল। সত্যবিক্রম মহাত্মা অর্জ্জুন কৌরবসৈন্যগণকে পরাজিত করিয়া কর্ণসমীপে ধাবমান হইলেন।

কর্ণের প্রতি শল্যের সমারোৎসাহবাণী

“তখন মদ্ৰাধিপতি শল্য কৃষ্ণসারথি শ্বেতাশ্ব অর্জ্জুনের বানরধ্বজ নিরীক্ষণ করিয়া কর্ণকে কহিলেন, ‘হে রাধেয়! তুমি যাহার অনুসন্ধান করিতেছিলে, ঐ দেখ, সেই কৃষ্ণসারথি শ্বেতাশ্ব ধনঞ্জয় গাণ্ডীব ধারণপূর্ব্বক শত্রুগণকে নিপীড়িত করিয়া আগমন করিতেছে। যদি আজ উহাকে নিপাতিত করিতে পার, তাহা হইলেই আমাদের মঙ্গললাভ হইবে। অর্জ্জুন কৌরবপক্ষীয় ধনুর্দ্ধরগণকে নিপীড়িত করিয়া তোমাকেই আক্রমণ করিবার নিমিত্ত আগমন করিতেছে; অতএব তুমি অবিলম্বে উহার প্রতি গমন কর। ঐ কৌরবসেনাগণ শত্রুঘাতন অর্জ্জুনের ভয়ে চতুর্দ্দিক বিকীর্ণ হইতেছে; ধনঞ্জয়ও উহাদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তোমার অভিমুখে ধাবমান হইয়াছে। এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, অমর্ষপরায়ণ অর্জ্জুন তোমা ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তির সহিত সংগ্রাম করিবে না। ঐ মহাবীর ভীমসেনকে নিতান্ত নিপীড়িত, ধর্ম্মরাজকে বিরথ ও ক্ষতবিক্ষত এবং শিখণ্ডী, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, যুধামন্যু, উত্তমৌজা, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীতনয়গণকে পরাজিত অবলোকন করিয়া কৌরবপক্ষীয় সমুদয় পার্থিবগণের বিনাশসাধনার্থ অন্যান্য সৈন্যগণকে । পরিত্যাগপূর্ব্বক রোষারক্তনয়নে মহাবেগে আমাদিগেরই প্রতি ধাবমান হইতেছে; অতএব সত্বর তুমি উহার প্রতি গমন কর। ইহলোকে তুমি ভিন্ন আর কেহই ক্রোধপরায়ণ ধনঞ্জয়কে সমরে আক্রমণ করিতে সমর্থ নহে। ঐ দেখ, মহাবীর কুন্তীনন্দন একাকী তোমার প্রতি ধাবমান হইতেছে, কেহই উহার পৃষ্ঠ বা পার্শ্বদেশ রক্ষা করিতেছে না। অতএব এক্ষণে তুমি আপনার কার্য্যসিদ্ধির উপায় দেখ। তুমিই সংগ্রামে বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিতে পারিবে। ঐ ভার তোমার উপরেই অর্পিত হইয়াছে; অতএব তুমি অবিলম্বে ধনঞ্জয়ের প্রতি গমন কর। তুমি ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও কৃপের সদৃশ; অতএব এই মহাসংগ্রামে লেলিহান সর্পের ন্যায়, গর্জনশীল ঋষভের ন্যায় ও বনস্থিত ভীষণ ব্যাঘ্রের ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন ধনঞ্জয়কে নিবারণপূর্ব্বক সংহার কর। ঐ দেখ, কৌরবপক্ষীয় মহারথ ভূপালগণ অর্জ্জুনের ভয়ে সমর নিরপেক্ষ হইয়া পলায়ন করিতেছেন। এ সময়ে তুমি ভিন্ন আর কেহই তাঁহাদিগের ভয়নিবারণে সমর্থ নহেন। কৌরবগণ এই সমরসাগরে দ্বীপের ন্যায় তোমার আশ্রয় গ্রহণপূর্ব্বক অবস্থান করিতেছেন। অতএব তুমি যেরূপ ধৈৰ্য্যসহকারে বৈদেহ, অম্বষ্ঠ, কাম্বোজ, নগ্নজিৎ ও গান্ধারগণকে পরাজিত করিয়াছ, সেইরূপ ধৈৰ্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক স্বীয় পুরুষকার প্রকাশ করিয়া অর্জ্জুন ও বাসুদেবের প্রতি গমন কর।’

শল্যবাক্যে সন্তুষ্ট কর্ণের অর্জ্জুনপ্রশংসা

“হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ শল্যকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! তুমি এক্ষণে প্রকৃতিস্থ ও আমার অভিমত হইয়াছ। ধনঞ্জয় হইতে তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। আজ তুমি আমার ভুজবল ও অস্ত্রশিক্ষা অবলোকন কর। আমি একাকীই সমুদয় পাণ্ডবসৈন্য সংহার করিব। আজ আমি কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে বিনাশ না করিয়া কদাচ রণস্থল হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইব না। যুদ্ধে জয়লাভের কিছুই স্থিরতা নাই; অতএব হয় কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে সংহার, নচেৎ তাহাদিগের শরনিকরে প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক সমরশয্যায় শয়ন করিয়া এককালে নিশ্চিন্ত হইব। তখন মদ্ররাজ শল্য কর্ণের বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, ‘হে কর্ণ! মহারথগণ সেই অর্জ্জুনকে নিতান্ত দুর্জয় বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। সে একাকী থাকিলেও তাহাকে আক্রমণ করা সহজ নহে। এক্ষণে আবার সে বাসুদেবকর্ত্তৃক রক্ষিত হইতেছে। এখন তাহাকে পরাজয় করা কাহার সাধ্য?’ কর্ণ কহিলেন, ‘হে শল্য! আমিও শুনিয়াছি যে, ধনঞ্জয় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রথী আর কেহই নাই, তথাপি আমি সেই মহাবীরের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব। এক্ষণে তুমি আমার পৌরুষ প্রত্যক্ষ কর। ঐ দেখ, পাণ্ডুতনয় মহাবীর অর্জ্জুন শ্বেতাশ্বসংযোজিত রথে আরোহণপূর্ব্বক রণস্থলে সঞ্চরণ করিতেছে। অদ্য হয়ত ঐ বীরই আমাকে বিনাশ করিবে। আমি বিনষ্ট হইলে কৌরবপক্ষীয় কোন যোদ্ধাই জীবিত থাকিবে না। হে মদ্ররাজ! ধনঞ্জয়ের ভুজযুগল সুদীর্ঘ ও ব্রণাঙ্কিত; উহা হইতে স্বেদজল নির্গত বা উহা কদাচ বিকম্পিত হয় না। দৃঢ়ায়ুধ মহাবীর অর্জ্জুন অদ্বিতীয় কৃতী ও ক্ষিপ্তহস্ত। এই পৃথিবীতে উহার সদৃশ যোদ্ধা আর কেহই নাই। ঐ মহাবীর একটি শরের ন্যায় এককালে বহুসংখ্যক শর গ্রহণ ও অবিলম্বে সন্ধানপূর্ব্বক এক ক্রোশ অন্তরে নিক্ষেপ করিয়া থাকে। ঐ মহাবীর কৃষ্ণের সমভিব্যাহারে খাণ্ডবারণ্যে হুতাশনকে পরিতুষ্ট করিতে তিনি বাসুদেবকে চক্র এবং উহাকে গাণ্ডীবশরাসন, শ্বেতাশ্বযুক্ত মেঘগম্ভীরনিঃস্বন রথ, অক্ষয়তূণীর ও দিব্যশস্ত্রসমুদয় প্রদান করেন। ঐ মহাবীর ইন্দ্রলোকে একত্র সমবেত লোকপালগণের নিকট পৃথক পৃথক অস্ত্র ও দেবদত্তশঙ্খ লাভ করিয়া অসংখ্য কালকেয় দৈত্যগণকে বিনাশ করিয়াছিল; অতএব এই পৃথিবীতে উহার তুল্য বলবীৰ্য্যসম্পন্ন আর কে আছে? ঐ মহাবীর ধর্ম্মযুদ্ধে অস্ত্রদ্বারা দেবাদিদেব মহাদেবের তুষ্টিসাধন করিয়া ত্রৈলক্যসংহারক একান্ত ভয়ঙ্কর পাশুপতাস্ত্র লাভ করিয়াছে। ঐ মহাবীর একাকীই বিরাটনগরে সমবেত কৌরবপক্ষীয় বীরগণকে পরাজিত করিয়া গোধন প্রত্যাহরণ ও মহারথদিগের বস্ত্র গ্রহণ করিয়াছিল। বিশেষতঃ সকল লোক সমবেত হইয়া অযুত বৎসরেও যে শঙ্খচক্রগদাপাণি জয়শীল মহাত্মা বাসুদেবের গুণ বর্ণন করিয়া শেষ করিতে পারে না, সেই অনন্তবীৰ্য্য, অপ্রতিমপ্রভাবসম্পন্ন দেবকীনন্দন ঐ মহাবীরকে সতত রক্ষা করিয়া থাকেন। এক্ষণে আমি সেই অশেষ গুণসম্পন্ন কৃষ্ণসহায় ধনঞ্জয়কে সংগ্রামে আহ্বান করিয়া আপনাকে সর্ব্বাপেক্ষা সাহসী জ্ঞান করিতেছি। মহাবীর বাসুদেব ও ধনঞ্জয়কে একরথে সমবেত দেখিয়া আমার অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইতেছে। ধনঞ্জয় শরযুদ্ধে ও বাসুদেব চক্ৰযুদ্ধে অতিশয় নিপুণ। যদিও হিমাচল স্বস্থান হইতে বিচলিত হয়, কিন্তু ঐ দুই মহাবীর কিছুতেই বিচলিত হইবার নহে। যাহা হউক, এক্ষণে আমি ব্যতিরেকে ঐ মহাবলপরাক্রান্ত মহারথদ্বয়ের নিকট যুদ্ধার্থ আর কে অগ্রসর হইবে? আজ ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধ করিতে আমার যে অভিলাষ হইয়াছে, উহা অচিরাৎ পূর্ণ হইবে। আমি অবিলম্বেই অর্জ্জুনের সহিত ঘোরতর বিচিত্র সংগ্রাম করিব। ঐ যুদ্ধে হয় আমি ঐ বীরদ্বয়কে বিনষ্ট করিয়া ভূতলে নিপাতিত করিব, না হয় উহারাই আমাকে নিহত করিবে।

“হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ এই বলিয়া জলধরের ন্যায় গভীর গৰ্জন করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি দুৰ্য্যোধনসন্নিধানে সমুপস্থিত ও তৎকর্ত্তৃক অভিনন্দিত হইয়া তাঁহাকে এবং কৃপ, ভোজ, অনুজসমবেত গান্ধাররাজ শকুনি, অশ্বত্থামা, স্বীয় কনিষ্ঠপুত্র এবং পদাতি, গজারোহী ও অশ্বারোহিগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা বাসুদেব ও অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইয়া তাহাদিগকে অবরুদ্ধ ও পরিশ্রান্ত কর। তোমরা ঐ বীরদ্বয়কে শরনিকরে সাতিশয় ক্ষতবিক্ষত করিলে আমি অক্লেশে উহাদিগকে সংহার করিতে সমর্থ হইব। হে মহারাজ! তখন ঐ সমস্ত বীরেরা সূতপুত্রের আদেশানুসারে অর্জ্জুনকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত সত্বর ধাবমান হইয়া শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে সমাহত [ভীষণভাবে আহত] করিতে লাগিলেন; মহাবীর অর্জ্জুনও মহাসাগর যেমন বহুল সলিলসম্পন্ন নদ-নদীসমুদয়ের বেগ ধারণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ অনায়াসে কৌরবপক্ষীয় বীরগণের শরনিকর সহ্য করিলেন। অনন্তর তিনি বিপক্ষগণের উপর অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তিনি যে কখন শর সন্ধান ও বর্ষণ করিতে লাগিলেন, শত্রুগণ তাহা কিছুই অবগত হইতে সমর্থ হইল না। তখন অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্য তাঁহার শরে বিদীর্ণ কলেবর ও নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে নিপতিত হইতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর কুন্তীনন্দন যুগান্তকালীন মার্কণ্ডের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। তাঁহার শরনিকরকিরণ ও গাণ্ডীব শরাসন পরিবেষের [সূৰ্য্যমণ্ডলের] ন্যায় শোভমান হইল। চক্ষুরোগপীড়িত ব্যক্তি যেমন দিবাকরকে নিরীক্ষণ করিতে পারে না, তদ্রূপ কৌরবগণ তাঁহাকে অবলোকন করিতে সমর্থ হইলেন না।

অশ্বত্থামাদিসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ

“অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন হাস্যমুখে শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসের মধ্যগত দিবাকর যেমন জলরাশি বিশোষিত করে, তদ্রূপ বিপক্ষনিক্ষিপ্ত শরনিকর নিরাকৃত করিয়া স্বীয় তেজঃপ্রভাবে কৌরবসৈন্য দগ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কৃপ, ভোজ, রাজা দুর্য্যোধন ও মহারথ অশ্বত্থামা জলধর যেমন মহীধরের উপর বারিবর্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ অনবরত অর্জ্জুনের উপর শরনিকর বিসৰ্জন করিয়া তাঁহার প্রতি দ্রুতবেগে ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় জীবনান্তকর শরনিকরদ্বারা সেই শরসমূহ ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের প্রত্যেকের বক্ষঃস্থলে তিন তিন বাণ বিদ্ধ করিলেন এবং গাণ্ডীব আকর্ষণপূর্ব্বক বিপক্ষগণকে শরানলে নিতান্ত সন্তপ্ত করিয়া জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসের মধ্যগত পরিবেষ সুশোভিত প্রচণ্ড মার্ত্তণ্ডের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহারথ অশ্বত্থামা দশশরে ধনঞ্জয়কে, চারিশরে তাঁহার চারি অশ্বকে ও তিনশরে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিয়া ধ্বজাগ্রস্থিত বানরের উপর নারাচনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া তিনশরে অশ্বত্থামার কার্ম্মুক, ক্ষুরাস্ত্ৰদ্বারা তাঁহার সারথির মস্তক ও চারিশরে অশ্বগণকে ছেদনপূর্ব্বক তিনশরে তাঁহার ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা একান্ত রোষাবিষ্ট হইয়া হীরক-মণিসমলঙ্কৃত সুবর্ণজালজড়িত, তক্ষকদেহের ন্যায় তেজঃসমপন্ন অদ্রিতটস্থ অজগরের ন্যায় প্রকাণ্ড এক মহামূল্য কার্ম্মুক গ্রহণ করিলেন এবং উহাতে জ্যারোপণপূর্ব্বক শরনিকর বর্ষণ করিয়া অর্জ্জুন ও বাসুদেবকে নিপীড়িত ও বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন বারিধর যেমন দিবাকরকে অবরোধ করে, তদ্রূপ মহাবীর কৃপ, ভোজ, দুৰ্য্যোধন ও অন্যান্য মহারথগণ শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক ধনঞ্জয়কে অবরোধ করিলেন। কার্ত্তবীৰ্য্যসদৃশ বলবীৰ্য্যসম্পন্ন মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে শরনিকরদ্বার কৃপাচার্য্যের সশর শরাসন, অশ্ব, ধ্বজ ও সারথিকে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। হে মহারাজ! পূর্ব্বে গাঙ্গেয় যেমন অর্জ্জুনের অসংখ্যশরে নিপীড়িত হইয়াছিলেন, এক্ষণে কৃপাচার্য্যও তদ্রূপ একান্ত নিপীড়িত হইলেন।

“অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন দুৰ্য্যোধনকে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া তাঁহার ধ্বজ ও শরাসন ছেদনপূর্ব্বক কৃতবর্ম্মার অশ্বগণকে বিনষ্ট ও ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর তিনি অশ্ব, সারথি, ধ্বজ ও শরাসনযুক্ত রথসমুদয় এবং গজযূথকে বিপাটিত [ছিন্নভিন্ন] করিলেন। কৌরবসৈন্যগণ জলবেগবিদীর্ণ সেতুর ন্যায় সমন্তাৎ [সর্ব্বদিকে] বিকীর্ণ হইয়া পড়িল। ঐ সময় মহাত্মা কৃষ্ণ রণপীড়িত শত্রুগণকে অর্জ্জুনের দক্ষিণপার্শ্বে রাখিয়া রথসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন অন্যান্য যোধগণ বৃত্রাসুরনিধোদ্যত বাসবের ন্যায় মহাবীর ধনঞ্জয়কে ধাবমান অবলোকন করিয়া উন্নত ধ্বজযুক্ত সুকল্পিত রথে আরূঢ় হইয়া যুদ্ধবাসনায় তাঁহার অনুগমন করিলেন। তদ্দর্শনে মহারথ শিখণ্ডী, সাত্যকি, নকুল ও সহদেব ধনঞ্জয়ের সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহার অরাতিগণকে নিবারণ ও শাণিতশরনিকরে বিদারণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন কৌরব ও সৃঞ্জয়গণ পরস্পর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অবগামী সায়কদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। পূর্ব্বকালে অসুরগণ যেমন দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল, এক্ষণে কৌরবগণের সহিত সৃঞ্জয়গণের তদ্রূপ সংগ্রাম আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষীয় গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথিগণ জয় ও স্বর্গলাভে সমুৎসুক হইয়া সমরে গমন ও পরস্পরকে প্রহার করিয়া গৰ্জন করিতে লাগিল।

“হে মহারাজ! ঐ সময় যোধগণ পরস্পরের প্রতি অনবরত শরনিকর নিক্ষেপ করাতে সূর্য্যের প্রভা তিরোহিত ও সমুদয় দিগ্বিদিক্‌ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইল।”