৭৯. কর্ণসমরে পাণ্ডবপরাজয়

৭৯তম অধ্যায়

কর্ণসমরে পাণ্ডবপরাজয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর বৃকোদরের প্রভাবে কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ ভগ্ন হইলে দুৰ্য্যোধন, শকুনি, কর্ণ, কৃপ, কৃতবর্ম্মা, অশ্বত্থামা, দুঃশাসন ও আমাদের পক্ষীয় অন্যান্য যোধগণ কি করিলেন? ভীমসেন একাকী সমুদয় যোধগণের সহিত যুদ্ধ করাতে তাহার পরাক্রম অতি অদ্ভুত বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। শত্রুনিসূদন কর্ণ সমস্ত কৌরবগণের মঙ্গল, বৰ্ম্ম, যশ ও জীবিতাশাস্বরূপ। সে কি ঐ সময় আপনার প্রতিজ্ঞানুরূপ যোধগণকে বিনাশ করিল? হে সঞ্জয়! ভীমসেনের প্রভাবে কৌরবসৈন্য ভগ্ন হইলে আমার দুর্দ্ধর্ষ পুত্রগণ ও সূতপুত্র কর্ণ কি করিল? তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সেই অপরাহুসময়ে মহাবল পরাক্রান্ত কর্ণ ভীমসেনের সমক্ষে সমুদয় সোমকগণকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। বৃকোদরও কৌরবসৈন্যগণকে ধ্বংস করিতে লাগিলেন; তখন সূতপুত্র ভীমসেনকর্ত্তৃক স্বীয় সৈন্যসমুদয় বিদ্ৰাবিত দেখিয়া শল্যকে কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! আমাকে অবিলম্বে পাঞ্চালগণের অভিমুখে লইয়া চল। মহাবলপরাক্রান্ত মদ্ররাজ কর্ণের বাক্য শ্রবণে চেদি, পাঞ্চাল ও কারূষদিগের অভিমুখে সেই মনোমারুতগামী শ্বেতাশ্বসকল সঞ্চালন করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বে অরাতিসৈন্যগণের মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক সূতপুত্র যে যে স্থানে গমন করিতে অভিলাষী হইলেন, সেই সেই স্থানে রথ সমানীত করিলেন। পাণ্ডব ও পাঞ্চালণ কর্ণের সেই ব্যাঘ্রচর্ম্মাবৃত মেঘসদৃশ রথ সন্দর্শন করিয়া একান্ত ভীত হইলেন। তৎকালে বিদীর্ণ পৰ্বত ও মেঘের ন্যায় সেই রথের ঘোরতর নির্ঘোষ প্রাদুর্ভূত হইল; মহাবীর কর্ণও আকর্ণপূর্ণ সুতীক্ষ্ণ শরনিকরে শত শত সহস্র সহস্র পাণ্ডবসৈন্য নিপীড়িত করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! মহাবীর সূতপুত্র সমরে এইরূপ দারুণ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলে পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথ শিখণ্ডী, ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি ও দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে নিপীড়িত করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে পরিবেষ্টন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর সাত্যকি বিংশতি ও ভীমসেন শতবাণে কর্ণের জত্রুদেশে আহত এবং শিখণ্ডী পঞ্চবিংশতি, ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত, দ্রৌপদীতনয়গণ চতুঃষষ্টি, সহদেব সাত ও নকুল একশত বাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত সূতনন্দন শরাসনে টঙ্কার প্রদান ও নিশিত শরনিকর পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহাদিগের প্রত্যেককে পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া নিমেষমধ্যে সাত্যকির ধ্বজ ও শাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং নয়বাণে তাঁহার বক্ষস্থল আহত ও ত্রিংশৎশরে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিয়া ভল্লদ্বারা সহদেবের ধ্বজ ছেদন ও তিনবাণে তাঁহার সারথিকে নিপীড়নপূর্ব্বক দ্রৌপদেয়গণকে রথবিহীন করিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল।

“এইরূপে সূতপুত্র শরনিকরে মহারথগণকে বিমুখ করিয়া, নিশিতসায়কদ্বারা পাঞ্চাল ও মহারথ চেদিগণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত চেদি ও পাঞ্চালগণ কর্ণের শরে নিপীড়িত হইয়া ক্রোধভরে তাঁহার অভিমুখে গমনপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন; মহারথ কর্ণও নিশিতশরনিকরে তাঁহাদিগকে নিপীড়িত ও নিবারিত করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে প্রতাপশালী সূতপুত্র একাকী সমরে শরবর্ষণপূর্ব্বক সংগ্রামে যত্নশীল পাণ্ডবপক্ষীয় অসংখ্য ধনুর্দ্ধরকে নিবারণ করিতেছেন দেখিয়া আমি নিতান্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। মহাত্মা কর্ণের হস্তলাঘব দর্শনে দেব, সিদ্ধ ও চারণগণ পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং মহাধনুর্দ্ধর কৌরবগণও সেই ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য মহারথ সূতপুত্রকে বারংবার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর সূতপুত্র গ্রীষ্মকালীন কক্ষদহন দহনের ন্যায় শরশিখায় অরাতিসৈন্যকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। পাণ্ডবসৈন্যগণ কর্ণশরে নিপীড়িত হইয়া তাঁহাকে সন্দর্শনপূর্ব্বক ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল। পাঞ্চালগণ সূতপুত্রের সায়কে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া তুমুল আর্ত্তনাদ করিতে আরম্ভ করিল। অন্যান্য পাণ্ডবসৈন্যেরা সেই শব্দশ্রবণে শঙ্কিত হইয়া কর্ণকে অদ্বিতীয় যোদ্ধা বলিয়া বোধ করিতে লাগিল। তখন শত্রুনিসূদন রাধেয় পুনর্ব্বার এরূপ অদ্ভুত পরাক্রম প্রকাশ করিলেন যে, পাণ্ডবসৈন্যগণ তাঁহাকে দর্শন করিতেও সমর্থ হইল না। তাঁহারা সূতপুত্রের সহিত মিলিত হইয়া পর্ব্বতলগ্ন বেগবান্ জলরাশির ন্যায় ইতস্ততঃ বিকীর্ণ হইতে লাগিল। তখন মহাবাহু কর্ণ প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় পাণ্ডবসৈন্যগণকে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার শরনিকরে বিপক্ষবীরগণের মস্তক, কুণ্ডলান্বিত কর্ণ, বাহু এবং হস্তিদন্তনির্ম্মিত মুষ্টিসম্পন্ন খড়্গ, ধ্বজ, শক্তি, অশ্ব, গজ, রথ, পতাকা, ব্যজন, অক্ষ, যুগ, যোত্র ও চক্ৰসমুদয় অনবরত নিকৃত্ত হইতে লাগিল। তাঁহার সায়নিহত প্রভূত গজবাজী ও তাহাদের মাংসশোণিতসঞ্জাত কর্দ্দমে সমরাঙ্গন দুর্গম হইয়া উঠিল। চতুরঙ্গিণী সেনা নিহত ও নিপাতিত হওয়াতে সমরস্থল সম কি বিষম, কিছুই নির্ধারিত হইল না। ঐ সময়ে কর্ণের অস্ত্রপ্রভাবে সমরভূমি অন্ধকারসমাচ্ছন্ন হইলে যোধগণ কে আত্মীয়, কে পর, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না।

“অনন্তর সূতনন্দন সুবর্ণভূষিত শরনিকরদ্বারা পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণকে সমাচ্ছন্ন করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহারা বারংবার ভগ্ন হইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! যেরূপ অরণ্যে মৃগেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইয়া মৃগযূথকে বিদ্রাবিত করে, তদ্রূপ যশস্বী সূতপুত্র মহারথ পাঞ্চালগণকে বারংবার বিদ্রাবিত করিয়া পশুহন্তা বৃকের ন্যায় তাহাদিগকে ভয় প্রদর্শনপূর্ব্বক সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। কৌরবপক্ষীয় যোধগণ পাণ্ডবসেনাদিগকে পরাঙ্মুখ দেখিয়া সিংহনাদ করিয়া তাহাদের প্রতি ধাবমান হইল। মহারাজ দুৰ্য্যোধন অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া নানাবিধ বাদিনিঃস্বন করিতে আদেশ করিলেন। তখন মহাধনুর্দ্ধর পাঞ্চালগণ ভগ্নাস্ত্র হইয়াও বীরপুরুষের ন্যায় প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিল। শত্রুতাপন কর্ণও তাহাদিগকে বারংবার ভগ্ন করিয়া শরনিকরে বিংশতিজন পাঞ্চাল ও শতাধিক চেদির প্রাণসংহার করিলেন। তাঁহার শরে বিপক্ষগণের রথোপস্থ, বাজিপৃষ্ঠ ও গজস্কন্ধ নির্ম্মনুষ্য এবং পদাতিসকল বিদ্রুত হইতে লাগিল। তখন তিনি মধ্যাহ্নকালীন দুর্নিরীক্ষ্য সূৰ্য্যের ন্যায় ও কালান্তক যমের ন্যায় শোভমান হইলেন।

“হে মহারাজ! অরাতিঘাতন মহাধনুর্দ্ধর রাধেয় এইরূপে পাণ্ডবপক্ষীয় চতুরঙ্গিণী সেনা নিপাতিত করিলেন। বলবান্ কৃতান্ত যেমন প্রাণীগণকে সংহার করেন, তদ্রূপ মহারথ কর্ণ একাকী সোমকগণকে নিহত করিয়া সমরে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় আমরা পাঞ্চালদিগেরও অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিলাম। তাহারা সমরাঙ্গনে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিল না। হে মহারাজ! ঐ অবসরে মহাবলপরাক্রান্ত রাজা দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন, কৃপ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা এবং শকুনি, ইহারাও অসংখ্য পাণ্ডবসেনা নিহত করিতে লাগিলেন। কর্ণের বলবিক্রমশালী পুত্রদ্বয় ক্রুদ্ধ হইয়া ইতস্ততঃ পাণ্ডবসেনা নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী এবং দ্রৌপদীর পুত্রগণও কোপাবিষ্ট হইয়া কৌরবসৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। হে, মহারাজ! এইরূপে সেই ভীষণ সংগ্রাম আরম্ভ হইলে কর্ণপ্রমুখ বীরগণের প্রভাবে পাণ্ডবপক্ষীয় ও ভীমসেনপ্রমুখ বীরগণের প্রভাবে কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য সৈন্য কালগ্রাসে নিপতিত হইতে লাগিল।”