৮২. সংশপ্তকগণসহ অর্জ্জুনের ভীষণ যুদ্ধ

৮২তম অধ্যায়

সংশপ্তকগণসহ অর্জ্জুনের ভীষণ যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাত্মা মধুসূদন ধনঞ্জয়ের সুবর্ণভূষণবিভূষিত মুক্তাজালজড়িত শ্বেতাশ্বগণকে কর্ণের রথাভিমুখে সঞ্চালিত করিলেন। অনন্তর কৌরবপক্ষীয় মহাবলপরাক্রান্ত নবতিসংখ্যক সংশপ্তক অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত ঘোরতর পারলৌকিক শপথ করিয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিল। মহাবীর অর্জ্জুন নিশিতশরজালে অবিলম্বে সেই সংগ্রামতৎপর নবতি বীরকে তাঁহাদের সারথি, শরাসন ও ধ্বজের সহিত নিপাতিত করিলেন। পুণ্যক্ষয় হইলে বিমানস্থ সিদ্ধগণ যেরূপ স্বর্গ হইতে পতিত হয়, তদ্রূপ তাহারা অর্জ্জুনের নানারূপ শরনিকরে নিহত হইয়া নিপতিত হইল। অনন্তর কৌরবগণ প্রভূত হস্তী, অশ্ব ও রথ লইয়া নির্ভয়ে ধনঞ্জয়ের সম্মুখীন হইয়া তাঁহাকে অবরোধপূর্ব্বক অসংখ্য শক্তি, ঋষ্টি, প্রাস, গদা, তরবার ও শরনিকরদ্বারা সমাচ্ছন্ন করিলেন; মহাবীর অর্জ্জুনও দিবাকর যেমন কিরণজালে তিমির নাশ করেন, তদ্রূপ সরনিকরদ্বারা অরাতিনিক্ষিপ্ত অন্তরীক্ষে বিস্তৃত শরজাল ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

“অনন্তর ত্রয়োদশশত মত্তগজসমারূঢ়, ম্লেচ্ছ দুর্য্যোধনের আদেশানুসারে কর্ণ, নালীক, নারাচ, তোমর, প্রাস, শক্তি, মুষল ও ভিন্দিপালদ্বারা রথস্থ পার্থের পার্শ্বদেশে আঘাত করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন নিশিত ভল্ল ও অর্দ্ধচন্দ্রদ্বারা সেই ম্লেচ্ছগণনিক্ষিপ্ত শস্ত্রবৃষ্টি নিরাকৃত করিয়া নানাবর্ণ শরনিকরে ধ্বজপতাকাবিশিষ্ট দ্বিরদগণকে আরোহিগণের সহিত নিহত করিলেন। সুবর্ণমালাবৃত মাতঙ্গগণ অর্জ্জুনের সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকরে সমাবৃত ও নিহত হইয়া বজ্রবিদারিত পর্ব্বতের ন্যায়, আগ্নেয়গিরির ন্যায় ভূতলে পতিত হইল। অনন্তর সংগ্রামস্থলে মনুষ্য, গজ ও অশ্বগণের নিঃস্বন এবং গাণ্ডীবের গভীর নির্ঘোষ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। অসংখ্য কুঞ্জর ও আরোহিবিহীন অশ্বগণ শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া দশদিকে ধাবমান হইল। অশ্বহীন, রথিবিহীন, গন্ধর্ব্বনগরাকার সহস্র সহস্র রথ চতুর্দ্দিকে দৃষ্ট হইতে লাগিল এবং অশ্বারোহিগণ ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়া অর্জ্জুনের বাণে নিহত হইল। হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয়ের কি অদ্ভুত বাহুবল! তিনি তৎকালে একাকীই সেই হস্তী, অশ্বারোহী ও রথিগণকে পরাজিত করিলেন।

ভীমার্জ্জুননিপীড়িত কৌরবগণের পলায়ন

“ঐ সময়ে মহাবীর ভীমসেন অর্জ্জুনকে ত্রিবিধ সৈন্যপরিবৃত দেখিয়া কৌরবপক্ষীয় হতাবশিষ্ট কতিপয় রথীকে অতিক্রমপূর্ব্বক মহাবেগে অর্জ্জুনের রথাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন কৌরবগণের অল্পমাত্রাবশিষ্ট ক্ষতবিক্ষত সৈন্যগণ ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল; গদাপাণি বৃকোদরও অর্জ্জুনের সমীপে গমন করিয়া ধনঞ্জয়হতাবশিষ্ট কৌরবপক্ষীয় মহাবল তুরঙ্গমগণকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার ভীষণ গদা প্রাকার, অট্টালিকা ও পুরদ্বারবিদারণে সমর্থ, কালরাত্রির ন্যায় নর, নাগ ও অশ্বগণের উপর অনবরত নিপতিত হইতে লাগিল। লৌহবর্ম্মধারী অশ্ব ও অশ্বরোহিগণ সেই প্রচণ্ড গদার আঘাতে ভগ্নমস্তক, ভগ্নাস্থি ও ভগ্নচরণ হইয়া শোণিতাদ্রকলেবরে চীৎকার করিয়া ধরাতলে নিপতিত ও দশনদ্বারা ভূতল দংশনপূর্ব্বক পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। ক্ৰব্যাদগণ আনন্দিতচিত্তে তাহাদের মাংস ভোজন করিতে লাগিল। তখন ভীমসেনের সেই ভীষণ গদা শোণিত, মাংস, বসা ও অস্থির দ্বারা পরমপরিতৃপ্ত হইয়া দুর্ল্লক্ষ্য কালরাত্রির ন্যায় নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিল। এইরূপে ভীমসেন দশসহস্র অশ্ব ও বহুসংখ্যক পদাতিকে নিপাতিত করিয়া গদাহস্তে সরোষনয়নে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। কৌরবগণ তাঁহাকে গদাহস্তে সমীপে সমাগত হইতে দেখিয়া সাক্ষাৎ কালদণ্ডধর কৃতান্তের ন্যায় বোধ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মকর যেমন সাগরে প্রবেশ করে, তদ্রূপ মহাবীর বৃকোদর মত্তমাতঙ্গের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া গজসৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক ক্ষণকালমধ্যে তাহাদিগকে নিপাতিত করিলেন। বৰ্মাচ্ছাদিত, পরিশোভিত, আরোহিসমবেত মত্তমাতঙ্গগণ পক্ষযুক্ত পর্ব্বতের ন্যায় ভূতলে পতিত হইতে লাগিল। মহাবল ভীমসেন এইরূপে সেই গজসৈন্য নিপাতিত করিয়া রথারোহণপূর্ব্বক পুনর্ব্বার অর্জ্জুনের আগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময়ে কৌরবসৈন্যগণ অস্ত্রাঘাতে নিপীড়িত হইয়া সমরে নিরুৎসাহ ও পরাঙ্মুখ হইয়া নিশ্চেষ্টবৎ অবস্থান করিতে লাগিল। অর্জ্জুন সেই সৈনিকগণকে তেজোহীন দেখিয়া প্রাণনাশক শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় চতুরঙ্গিণী সেনা অর্জ্জুনের শরনিকরে বিদ্ধ হইয়া কেশরবিরাজিত কদম্বকুসুমের ন্যায় শোভাধারণ করিল। ঐ সময় অর্জ্জুনের শরে অসংখ্য নাগ, নর ও অশ্ব নিহত হওয়াতে কৌরবপক্ষে ভীষণ আর্ত্তনাদ সমুত্থিত হইল। সৈনিকগণ নিতান্ত ভীত হইয়া হাহাকার করিয়া অলাতচক্রের ন্যায় ভ্রমণ করিতে লাগিল। ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় কোন রথ, অশ্বারোহী বা মাতঙ্গ অক্ষত ছিল না। সৈন্যগণ ছিন্নকবচ ও শোণিতলিপ্ত হইয়া বিকশিত অশোক কাননের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ঐ সময় কৌরবগণ সব্যসাচীর পরাক্রমদর্শনে কর্ণের জীবিতাশা পরিত্যাগ করিলেন এবং পার্থের শরসম্পাত অসহ্য বোধ করিয়া শঙ্কিতচিত্তে দশদিকে পলায়ন করিয়া সূতপুত্রকে আহ্বান করিতে লাগিলেন; মহাবীর অর্জ্জুনও শত শত শরবর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাদিগের প্রতি ধাবমান হইয়া ভীমসেনপ্রমুখ পাণ্ডবপক্ষীয় যোধগণকে আহ্লাদিত করিলেন।

“হে মহারাজ! তখন আপনার পুত্রগণ অর্জ্জুনশরে ব্যথিত হইয়া কর্ণের রথসমীপে প্রতিগমন করিলেন। ঐ সময় সূতপুত্র সেই বিপত্সাগরে নিমগ্নপ্রায় বীরগণের দ্বীপস্বরূপ হইলেন; অন্যান্য কৌরবগণও অর্জ্জুনের ভয়ে ভীত হইয়া নির্ব্বিষ পন্নগের ন্যায় পলায়নপূর্ব্বক কর্ণেরই আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ক্রিয়াবান্ [কর্মী মনুষ্যাদি] প্রাণীগণ যেমন মৃত্যু হইতে ভীত হইয়া ধর্ম্মকে অবলম্বন করে, তদ্রূপ আপনার তনয়গণ মহাত্মা অর্জ্জুনের ভয়ে মহাধনুর্দ্ধর কর্ণের শরণাপন্ন হইলেন। তখন শস্ত্রধরাগ্রগণ্য মহাবীর কর্ণ সেই শরপীড়িত শোণিতক্লিন্ন [রক্তার্দ্র] বীরগণকে অভয় প্রদান করিলেন এবং সৈনিকগণকে অর্জ্জুনপ্রভাবে ভগ্ন দেখিয়া শত্ৰুসংহারবাসনায় শরাসন বিস্ফারণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি মনে মনে অর্জ্জুনের বধচিন্তা করিয়া নিশ্বাস পরিত্যাগপূৰ্বক তাঁহারই সমক্ষে পুনরায় পাঞ্চালগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় ভূপালগণ তদ্দর্শনে আরক্তনয়ন হইয়া, জলদজাল যেমন পৰ্ব্বতোপরি বারিবর্ষণ করে, তদ্রূপ কর্ণের উপর শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর কর্ণ সহস্র সহস্র শর নিক্ষেপপূর্ব্বক পাঞ্চালগণের প্রাণসংহার করিতে আরম্ভ করিলে তাহাদের মধ্যে ভীষণ শব্দ সমুত্থিত হইল।”