৯১. মাতৃবধপ্রতিহিংসাৰ্থ অশ্বসেনের কর্ণপক্ষাশ্রয়

৯১তম অধ্যায়

মাতৃবধপ্রতিহিংসাৰ্থ অশ্বসেনের কর্ণপক্ষাশ্রয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয়ের ভীষণ অস্ত্রপ্রভাবে কৌরবগণ সসৈন্যে পলায়ন করিয়া দূরে অবস্থানপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক্‌ হইতে বিদ্যুতের ন্যায় সমুজ্জ্বল অর্জ্জুনাস্ত্র অবলোকন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সূতপুত্র তাঁহার বধার্থী অর্জ্জুনের শরে কৌরবগণকে নিপীড়িত, নিহত ও পলায়িত অবলোকন করিয়া দৃঢ় জ্যাযুক্ত স্বীয় শরাসন বিস্ফোরণপূর্ব্বক পরশুরামের নিকট শিক্ষিত মহাস্ত্রজাল বর্ষণ করিয়া ধনঞ্জয়নিক্ষিপ্ত মহাস্ত্রজাল নিরাকৃত করিলেন। অনন্তর পরস্পর দন্তাঘাতে প্রবৃত্ত মত্তমাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় মহাবীর ধনঞ্জয় ও কর্ণের তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। তাঁহারা অনবরত শরনিকর বর্ষণ করিয়া এককালে আকাশমার্গ সমাচ্ছন্ন করিলেন। তাঁহাদের বাণবর্ষণে সংগ্রামভূমি তিমিরাবৃত হইলে কৌরব ও সোমকগণ শরজাল ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না। সেই শরনিকরবর্ষী ধনুর্দ্ধর বীরদ্বয় নিরন্তর শরসন্ধান করিয়া সংগ্রামে বিচিত্র গতি প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় বল, বীৰ্য্য, পৌরুষ ও অস্ত্রমায়ার প্রভাবে কখন সূতপুত্র ধনঞ্জয়ের অপেক্ষা এবং কখন বা ধনঞ্জয় সূতপুত্রের অপেক্ষা প্রবল হইতে লাগিলেন। অন্যান্য যোধগণ সেই পরস্পরছিদ্রান্বেষী বীরদ্বয়ের দুর্ব্বিষহ ঘোর সংগ্রাম নিরীক্ষণ করিয়া একান্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং অন্তরীক্ষস্থিত প্রাণীগণ কেহ কেহ ‘সাধু কর্ণ’ ও কেহ কেহ বা ‘সাধু অর্জ্জুন’ বলিয়া তাঁহাদের প্রশংসা করিতে লাগিলেন; ঐ সময় অসংখ্য রথ, অশ্ব ও মাতঙ্গগণের গতায়াতে সমরাঙ্গন বিদলিত হইয়া গেল।

“হে মহারাজ! পূৰ্বে অশ্বসেননামে যে সর্প খাণ্ডবদাহ হইতে মুক্ত হইয়া রোষভরে পাতালতলে প্রবেশ করিয়াছিল, ঐ সময় সেই নাগরাজ অর্জ্জুনকৃত মাতৃবধজনিত পূর্ব্ব-বৈর স্মরণ করিয়া বেগে পাতালতল হইতে উত্থিত হইল এবং অন্তরীক্ষ হইতে সূতপুত্র ও ধনঞ্জয়ের সংগ্রাম সন্দর্শন করিয়া বৈরনির্য্যাতনের ‘এই প্রকৃত অবসর’, ইহা বিবেচনা করিয়া কর্ণের সেই একতূণীরশায়ী শরমধ্যে প্রবেশ করিল। অনন্তর সেই বীরদ্বয়ের কিরণজালময় অস্ত্রজালে দশদি ও নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইল। কৌরব ও সোমকগণ সেই ভীষণ বাণান্ধকার দর্শনে অতিমাত্র ভীত হইলেন। তৎকালে ভয়ানক শরজাল ভিন্ন আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। ঐ সময় সেই অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধর মহাপুরুষদ্বয় প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া উভয়েই শ্রান্ত হইয়া পড়িলেন। তখন অপ্সরাগণ তাঁহাদিগকে দিব্যচামর বীজন ও চন্দনসলিলে সেচন করিতে লাগিল এবং দেবরাজ পুরন্দর ও দিবাকর করতদ্বারা তাঁহাদিগের মুখকমল মার্জ্জিত করিয়া দিলেন।

পার্থবধাৰ্থ কর্ণনিক্ষিপ্ত নাগাস্ত্রের বিফলতা

“তৎকালে সূতপুত্র যখন বলবীর্য্যে অর্জ্জুনকে কোনক্রমেই অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না, প্রত্যুত তাঁহার নিক্ষিপ্ত শরনিকরে সাতিশয় ক্ষতবিক্ষত ও সন্তপ্ত হইয়া উঠিলেন, তখন সেই একতূণীরশায়ী শর তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। ঐ শর ঐরাবতনাগবংশসম্ভূত। সূতপুত্র ধনঞ্জয়ের নিধনার্থ অতিযত্নসহকারে উহা বহুদিন সুবর্ণ তূণীরমধ্যে চন্দনচূর্ণোপরি রক্ষা করিয়াছিলেন। ঐ সময় তিনি অর্জ্জুনের মস্তকচ্ছেদনার্থে সেই জ্বালাকরাল সর্পমুখ শর শরাসনে সন্ধান ও আকর্ণ আকর্ষণ করিলেন। তৎকালে সেই সর্পবাণ শরাসনে সংহিত হইলে দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল, শত শত ভীষণ উল্কা নিপতিত হইতে লাগিল এবং ইন্দ্রপ্রমুখ লোকপালগণ হাহাকার শব্দ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে যে ঐ ভীষণশরমধ্যে মহানাগ অশ্বসেন যোগবলে প্রবেশ করিয়াছিল, সূতপুত্র তাঁহার কিছুই বিদিত হয়েন নাই। ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্র কর্ণের শরমধ্যে নাগরাজকে প্রবিষ্ট অবগত হইয়া ‘একেবারেই আমার আত্মজ অর্জ্জুন বিনষ্ট হইল’ মনে করিয়া নিতান্ত ভীত হইলেন। ভগবান্ কমলযোনি সুররাজকে তদবস্থাপন্ন অবলোকন করিয়া কহিলেন, ‘হে ইন্দ্র! তুমি কিছুমাত্র ব্যথিত হইও না। মহাবীর ধনঞ্জয়ের জয়শ্রীলাভ হইবে।’ ঐ সময় মদ্ররাজ শল্য সূতপুত্রকে সর্পশর সন্ধান করিতে দেখিয়া কহিলেন, ‘হে কর্ণ! এই শরটি অর্জ্জুনের গ্রীবাচ্ছেদনে সমর্থ হইবে না; অতএব যদ্বারা অৰ্জ্জুনের মস্তকচ্ছেদন করা যাইতে পারে, এমন একটি শর সন্ধান কর।’ তখন মহাবীর সূতপুত্র মদ্ররাজের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া রোষারুণিত-লোচনে কহিলেন, ‘হে শল্য! কর্ণ কখনই এক শরসন্ধানপূর্ব্বক তাহা পরিত্যাগ না করিয়া অন্য শর সন্ধান করে না এবং আমার সদৃশ ব্যক্তিরা কদাচ কূটযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় না।’ সূতপুত্র শল্যকে এই কথা বলিয়া বিজয়লাভার্থে উদ্যত হইয়া তৎক্ষণাৎ সেই বহুবর্ষ-পরিপূজিত, প্রযত্নসহকারে সংরক্ষিত, ভয়ঙ্কর শর পরিত্যাগপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! তুমি এইবারই বিনষ্ট হইলে।’ তখন সেই কর্ণশরাসনচ্যুত, হুতাশন ও সূৰ্য্যের ন্যায় প্রদীপ্ত, অতি ভীষণ সায়ক অন্তরীক্ষে উখিত হইয়া প্রজ্বলিত হইতে লাগিল। ঐ সময় মহাত্মা বাসুদেব সেই সূতপুত্র নিক্ষিপ্ত শর অন্তরীক্ষে প্রজ্বলিত দেখিয়া সত্বর পদদ্বারা রথ আক্রমণপূর্ব্বক অবলীলাক্রমে ভূতলমধ্যে কিঞ্চিৎ প্রবেশিত করিলেন। অর্জ্জুনের সুবর্ণজালজড়িত চন্দ্রমরীচির ন্যায় ধবলবর্ণ অশ্বগণও জানু আকুঞ্চিত করিয়া ভূতলে অবস্থান করিতে লাগিল। তখন নভোমণ্ডলে তুমুল কোলাহল সহকারে বাসুদেবের প্রশংসাবাদ উচ্চারিত হইল এবং অনবরত পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল।

“এইরূপে মহাত্মা মধুসূদনের প্রযত্নে অর্জ্জুনের রথ ভূতলে নিমগ্ন হওয়াতে কর্ণের সেই নাগাস্ত্র ধনঞ্জয়ের ইন্দ্রদত্ত সুদৃঢ় কিরীটে নিপতিত হইয়া তাহা চূর্ণ করিয়া ফেলিল। মহাবীর ধনঞ্জয়ের ঐ ত্রিলোকবিশ্রুত, সুবর্ণখচিত, মণিহীরকসমলঙ্কৃত, সূর্য, চন্দ্র ও জুলনের ন্যায় দীপ্তিশীল, মহামূল্য কিরীট ভগবান স্বয়ম্ভু স্বয়ং তপোবলে প্রযত্নসহকারে দেবরাজ ইন্দ্রের নিমিত্ত নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। বিপক্ষেরা উহা নিরীক্ষণ করিতে ভীত হইত। পূর্ব্বে পুরন্দর অসুরসংহারকালে অর্জ্জুনকে ঐ কিরীট প্রদান করিয়াছিলেন। উহা রুদ্রের পিনাক, বরুণের পাশ, ইন্দ্রের বজ্র ও কুবেরের সায়কদ্বারাও বিনষ্ট হইবার নহে। এক্ষণে দুষ্টস্বভাব অশ্বসেন সূতপুত্রের শরে প্রবিষ্ট হইয়া অৰ্জ্জুনের সেই কিরীট বিমর্পিত করিল।

“হে মহারাজ! অর্জ্জুনের সেই সুবর্ণ-জাল-পরিবৃত অতি ভাস্বর কিরীট বিষাগ্নিদ্বারা বিমথিত ও ক্ষিতিতলে নিপতিত হইয়া অস্তগিরিশিখর হইতে নিপতিত সন্ধ্যারাগরঞ্জিত দিবাকরের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। বজ্র যেমন ফলপুস্পোপশোভিত পাদপপরিপূর্ণ গিরিশিখরকে বিচূর্ণিত এবং প্রবলবায়ু যেমন ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল ও সলিলরাশি বিঘটিত করে, তদ্রূপ সেই নাগাস্ত্র অর্জ্জুনের দিব্যকিরীট মহাবেগে চূর্ণ করিয়া ফেলিল। তখন ত্রিভুবনমধ্যে একটি ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইল। সেই শব্দ শ্রবণে সকলেই একান্ত ব্যথিত ও স্থলিত হইতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় সেই কিরীট ব্যতিরেকে নীলবর্ণ উত্তুঙ্গ শৈলশৃঙ্গের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। তখন তিনি অনাকুলিতচিত্তে শ্বেতবর্ণবসনদ্বারা কেশকলাপ বন্ধন করিয়া শিখরগত সূৰ্য্যমরীচিদ্বারা একান্ত উদ্ভাসিত উদয়পর্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। এইরূপে সেই অর্জ্জুনের সহিত বদ্ধবৈর [অত্যন্ত শক্রতাভাবাপন্ন] সূতপুত্রনিক্ষিপ্ত নাগ ধনঞ্জয়কে পাতিত করিতে অসমর্থ হইয়া কেবল তাঁহার কিরীট চূর্ণ করিয়া পুনরায় স্বস্থানে গমন করিতে লাগিল।

কর্ণার্জ্জুনসহ অশ্বসেননাগের পরিচয়

“হে মহারাজ! ইত্যবসরে মহারথ কর্ণ সেই মহোরগকে নিরীক্ষণ করিলেন। তখন সেই ভুজঙ্গ কর্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘হে কর্ণ! তুমি আমাকে না দেখিয়াই প্রয়োগ করিয়াছিলে, এই নিমিত্ত আমি অর্জ্জুনের মস্তক ছেদন করিতে পারিলাম না; অতএব এক্ষণে তুমি আমাকে প্রত্যক্ষ দেখিয়া প্রয়োগ কর, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় তোমার ও আমার শত্রুকে সংহার করিব।’ তখন মহাবীর কর্ণ ভূজঙ্গের এইরূপ বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, ‘হে ভদ্র! তোমার আকার অতি ভয়ঙ্কর দেখিতেছি। এক্ষণে তুমি কে, তাহা সবিশেষ করিয়া বল।’ নাগ কহিল, ‘হে কর্ণ! পূর্ব্বে অর্জ্জুন আমার মাতৃবধ করিয়াছিল, তদবধি উহার সহিত আমার শত্রুভাব বদ্ধমূল হইয়া রহিয়াছে। অতএব যদি স্বয়ং দেবরাজও উহার রক্ষক হয়েন, তথাপি আমি উহাকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিব।’

“তখন সূতপুত্র কহিলেন, ‘হে নাগ! কর্ণ কখন অন্যের বলবীৰ্য্য অবলম্বন করিয়া সমরবিজয়ী হয় না এবং একশত অর্জ্জুনকে বিনাশ করিতে হইলেও কখন এক শর দুইবার সন্ধান করে না। অতএব আমি রোষ ও যত্নসহকারে বিবিধ উৎকৃষ্ট শরে অর্জ্জুনকে বিনাশ করিতেছি, তুমি নিরাপদে গমন কর।’ হে মহারাজ! সূতপুত্র এইরূপ কহিলে নাগরাজ তাঁহার সেই বাক্য অসহ্য জ্ঞান করিয়া অস্ত্ররূপ ধারণপূর্ব্বক রোষভরে অর্জ্জুনের বিনাশ বাসনায় গমন করিতে লাগিল। ঐ সময়ে বাসুদেব ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে পার্থ! তুমি শীঘ্র ঐ কৃতবৈর উরগপতিকে বিনাশ কর।’ তখন গাণ্ডীবধারী ধনঞ্জয় মধুসূদনকে কহিলেন, ‘হে জনার্দ্দন! যে মহানাগ গরুড়মুখগমনোদ্যতের ন্যায় ইচ্ছাপূর্ব্বক স্বয়ং আমার সমীপে আগমন করিতেছে, ও কে?’ কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! তুমি যৎকালে খাণ্ডবদাহনপূর্ব্বক হুতাশনের তৃপ্তিসাধন করিয়াছিলে, সেই সময় ঐ ভুজঙ্গের মাতা আপনার ক্রোড়ে উহাকে লুক্কায়িত করিয়া আকাশমার্গে অবস্থান করিতেছিল, তুমি তৎকালে উহার মাতাকে বিনাশ করিয়াছিলে, কিন্তু উহাকে দেখিতে পাও নাই। এক্ষণে ঐ দুরাত্মা সেই মাতৃবধজনিত পূর্ব্ববৈর স্মরণ করিয়া তোমার বিনাশবাসনায় আকাশচ্যুত প্রজ্বলিত মহোল্কার ন্যায় সমাগত হইতেছে।

অর্জ্জুনের অশ্বসেন সংহার—পুনঃ কর্ণসহ যুদ্ধ

“হে মহারাজ! তখন মহাবীর অর্জ্জুন ক্রোধে মুখ পরিবর্ত্তন করিয়া নভোমণ্ডলে পক্ষীর ন্যায় সমাগত সেই নাগরাজকে ছয় নিশিতশরে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ভুজগরাজ নিহত হইলে পুরুষোত্তম হৃষীকেশ স্বয়ং বাহুযুগলদ্বারা পৃথিবী হইতে অর্জ্জুনের রথ উত্তোলন করিলেন। ঐ সময়ে মহাবীর কর্ণ ক্রোধভরে দৃষ্টিপাত করিয়া বিচিত্র ময়ূরপুচ্ছযুক্ত নিশিত দশশরে পুরুষপ্রধান ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিলেন। তখন অর্জ্জুনও কর্ণের প্রতি সুশাণিত দ্বাদশ বরাহকৰ্ণবাণ নিক্ষেপ করিলেন। অনন্তর অর্জ্জুন পুনরায়, শৱাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক এক আশীবিষসদৃশ নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। সেই উৎকৃষ্ট শর কর্ণের প্রাণসংহারার্থ যেন তাঁহার মর্ম্ম বিদারণ ও রুধিরপান করিয়া শোণিতলিপ্ত গাত্রে ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন সূতপুত্র সেই শরপাতে দণ্ডবিঘট্টিত সর্পের ন্যায় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া, বিষাক্ত সর্প যেমন বিষ পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ উত্তম উত্তম শরনিকর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং প্রথমতঃ দ্বাদশশরে জনার্দ্দনকে ও নবতিশরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় ঘোরতর শরে ধনঞ্জয়ের দেহ বিদারণপূর্ব্বক সিংহনাদ পরিত্যাগ ও হাস্য করিতে লাগিলেন। তখন পুরন্দরতুল্য পরাক্রমশালী মহাবীর ধনঞ্জয় সূতপুত্রের আহ্লাদ সহ্য করিতে না পারিয়া, সুররাজ ইন্দ্র যেমন বলাসুরের মর্ম্ম বিদারণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অসংখ্য শরে সূতপুত্রের মর্ম্মভেদ করিয়া পুনরায় তাহার প্রতি যমদণ্ড সদৃশ নবতি শর পরিত্যাগ করিলেন। মহাবীর কর্ণ অর্জ্জুনের শরাঘাতে বজ্রাহত অচলের ন্যায় নিতান্ত ব্যথিত হইলেন। তৎপরে তাহার স্বর্ণ, হীরক ও মণিমুক্তাদিখচিত শিরোভূষণ এবং কুণ্ডলদ্বয় অর্জ্জুনের শরাঘাতে ভূতলে নিপতিত হইল। উত্তম উত্তম শিল্পীরা বহু যত্নসহকারে দীর্ঘকালে কর্ণের যে মহামূল্য ভাস্বর বর্ম্ম প্রস্তুত করিয়াছিল, মহাবীর অর্জ্জুন ক্ষণকাল মধ্যে তাহাও বহুধা বিদীর্ণ করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর তিনি ক্রোধভরে সেই বর্ম্ম বিরহিত কর্ণকে নিশিত চারিশরে অতিমাত্র বিদ্ধ করিলে সূতপুত্ৰ সান্নিপাতিকজ্বরাক্রান্ত [বায়ু-কফের দ্বন্দ্বযুক্ত বিষম জ্বরে আক্রান্ত—বিকারগ্রস্ত] আতুরের ন্যায় সাতিশয় ব্যথিত হইলেন। তখন অর্জ্জুন শরাসননির্গত নিশিত শরনিকরে তাঁহার অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত ও মর্ম্মস্থল বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণ অর্জ্জুনের বিবিধ শরে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া শোণিতক্ষরণ করিয়া গৈরিক ধাতুধারাবর্ষী পর্ব্বতের ন্যায় শোভমান হইলেন।

অর্জ্জুনশরে কর্ণের মূর্চ্ছা

“অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন ক্রৌঞ্চবিদারণ কার্তিকেয়ের ন্যায় যমদণ্ড ও অগ্নিদণ্ড-সদৃশ লৌহময় সুদৃঢ় শরনিকরে পুনরায় কর্ণের বক্ষঃস্থল ভেদ করিলেন। সূতপুত্র অর্জ্জুনের শরে নিতান্ত নিপীড়িত ও শিথিলমুষ্টি হইয়া ইন্দ্রায়ধসদৃশ শরাসন ও তূণীর পরিত্যাগপূর্ব্বক রথোপরি মূর্চ্ছিত হইলেন। তখন পরমধাৰ্মিক, ধনঞ্জয় আতুর ব্যক্তিকে নিপাতিত করা অকৰ্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া সূতপুত্রকে সেই ব্যসনকালে বিনাশ করিতে অভিলাষ করিলেন না। তখন ইন্দ্রাবরজ [ইন্দ্রের কনিষ্ঠ] বাসুদেব সসম্ভ্রমে ধনঞ্জয়কে কহিলেন,‘“হে অর্জ্জুন! তুমি কি নিমিত্ত প্রমত্ত হইতেছ? পণ্ডিতেরা দুর্ব্বল অরাতিদিগকেও নিধন করিতে কালপ্রতীক্ষা করেন না। তাঁহারা ব্যসননিমগ্ন শত্রুগণকে নিপাতিত করিয়া ধর্ম্ম ও কীৰ্ত্তি লাভ করিয়া থাকেন; অতএব তুমি প্রবল শত্রু বীরপ্রধান কর্ণকে সহসা নিহত করিতে সচেষ্ট হও। তুমি নমুচিনিসূদন পুরন্দরের ন্যায় সত্বর উহাকে শরবিদ্ধ কর, নচেৎ ঐ বীর অবিলম্বে পূর্ব্ববৎ পরাক্রম প্ৰকাশপূর্ব্বক তোমার অভিমুখীন হইবে।

“হে মহারাজ! তখন মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের বাক্য শিরোধার্য্য করিয়া, দেবরাজ ইন্দ্র যেমন দানবরাজ বলিকে বিদ্ধ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ শরনিকরদ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন এবং অচিরাৎ বসন্ত বাণদ্বারা সূতপুত্রকে অশ্ব ও রথের সহিত সমাচ্ছন্ন করিয়া সুবর্ণপুঙ্খ শরজালে দিঙ্মণ্ডল আবৃত করিলেন। স্থূলাবক্ষাঃ সূতনন্দন অর্জ্জুনের বৎসদস্তুবাণে সমাচ্ছন্ন হইয়া কুসুমিত অশোক, পলাশ ও শাল্মলিবৃক্ষ এবং চন্দনকাননে সমাকীর্ণ অচলের ন্যায়, বৃক্ষশ্রেণীপরিপূর্ণ বিকশিত কর্ণিকার [সোঁদাল ফুল] পরিশোভিত হিমালয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।

বসুন্ধরার কর্ণরথচক্রগ্রাম–কর্ণের আক্ষেপ

“হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর কর্ণ অর্জ্জুনকে লক্ষ্য করিয়া অস্তাচলগামী দিনকরের করজালসদৃশ অসংখ্য শর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন; অর্জ্জুনও নিশিতাগ্র শরনিকরদ্বারা সেই ভুজঙ্গমের ন্যায় দেদীপ্যমান কর্ণনির্ম্মুক্ত শরজাল ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন কর্ণ ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক, রোষিত, সর্পের ন্যায়, বিশিখজাল বর্ষণপূর্ব্বক দশবাণে অর্জ্জুন ও ছয়বাণে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর মহামতি ধনঞ্জয় সেই মহাযুদ্ধে কর্ণের উপর সর্পবিষ ও অনলের ন্যায় ভীষণ উগ্রনিঃস্বন রৌদ্রশর ক্ষেপণ করিতে অভিলাষ করিলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় কর্ণের বিনাশকাল উপস্থিত হওয়াতে কাল অদৃশ্যভাবে তাঁহাকে ব্রাহ্মণের শাপবৃত্তান্ত জ্ঞাপিত করিয়া কহিলেন, ‘সূতপুত্র! বসুন্ধরা তোমার রথচক্র গ্রাস করিতেছেন।’ কাল এই কথা কহিবামাত্র কর্ণ পরশুরামপ্রদত্ত অস্ত্র বিস্মৃত হইলেন এবং পৃথিবী তাঁহার রথের বামচক্র গ্রাস করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ব্রাহ্মণসন্তানের শাপে সূতপুত্রের রথ বিঘূর্ণিত হইতে আরম্ভ হইল; রথও বেদিবন্ধবিশিষ্ট পুষ্পিত চৈত্যবৃক্ষের ন্যায় ভূতলে নিমগ্ন হইয়া গেল।

“হে মহারাজ! এইরূপে সুতপুত্রের সর্পমুখ বাণ বিনষ্ট, রথ ঘূর্ণিত, পরশুরামপ্রদত্ত অস্ত্র স্মৃতিপথ হইতে তিরোহিত হওয়াতে তিনি সাতিশয় বিণ্নন্ন ও বিহ্বল হইলেন। অনন্তর তিনি সেই সকল ক্লেশ সহ্য করিতে না পারিয়া হস্ত বিধূনন[কম্পন]-পূর্ব্বক আক্ষেপ প্রকাশ করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘ধাৰ্মিক ব্যক্তিরা সতত কহিয়া থাকেন যে, ধর্ম্ম ধার্ম্মিককে সতত রক্ষা করেন। আমরা শাস্ত্র ও শক্তি অনুসারে ধর্ম্মরক্ষণে যত্ন ও ধর্ম্মে দৃঢ়ভক্তি করিয়া থাকি; ধর্ম্ম তথাপি আমাদিগকে বিনাশ করিতেছেন। অতএব বোধ হয়, ধৰ্ম আর নিয়ত ধার্ম্মিককে রক্ষা করেন না।’ মহারাজ! মহাবীর সূতপুত্র এইরূপ কহিতে কহিতে অর্জ্জুনশরে বিচলিত হইলেন। তাঁহার অশ্ব ও সারথি স্খলিত হইল, তিনিও স্বীয় কার্য্যে শিথিল প্রযত্ন হইয়া বারংবার ধর্ম্মের নিন্দা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি ভীষণ তিনবাণে বাসুদেবের হস্ত ও সাতবাণে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন; অর্জ্জুনও তাঁহার উপর দেবরাজের বজ্রসদৃশ অনলোপম [গাণ্ডীবের গুণ—ধনুকের ছিলা] ভীমবেগ সপ্তদশ শর পরিত্যাগ করিলেন। অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত শরজাল প্রবলবেগে কর্ণশরীর ভেদ করিয়া পৃথিবীপৃষ্ঠে নিপতিত হইল।

“তখন সূতনন্দন কম্পিতাত্মা হইয়া পরাক্রম প্রদর্শন করিয়া বলপূর্ব্বক ব্রহ্মাস্ত্র মন্ত্রপূত করিয়া পরিত্যাগ করিলেন; শত্ৰুনিসূদন অর্জ্জুনও তদ্দর্শনে ঐন্দ্র অস্ত্র মন্ত্রপূত করিলেন এবং গাণ্ডীবজ্যা ও অন্যান্য শরনিকর মন্ত্রপূত করিয়া বারিবর্ষী পুরন্দরের ন্যায় শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন পার্থরথনিঃসৃত তেজোময় শরজাল সূতপুত্রের রথসমীপে প্রাদুর্ভূত হইল; মহারথ কর্ণও সেই সম্মুখাগত শরজাল ব্যর্থ করিয়া ফেলিলেন। অর্জ্জুনের অস্ত্র বিনষ্ট হইলে বৃষ্ণিবীর বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! কর্ণ তোমার শরনিকর বিনষ্ট করিতেছে; অতএব তুমি উৎকৃষ্ট অস্ত্র পরিত্যাগ কর।’ তখন ধনঞ্জয় অতি ভীষণ ব্রহ্মাস্ত্র মন্ত্রপূত ও শাসনে সংযোজিত করিয়া শরজালে কর্ণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। অনন্তর সূতপুত্র সুনিশিতশরনিকরে ক্রমে ক্রমে একাদশবাণে অর্জ্জুনের মৌৰ্ব্বী ছেদন করিলেন, কিন্তু অর্জ্জুনের যে একশত জ্যা আছে, তাহা তাঁহার বোধগম্য হয় নাই। তখন অর্জ্জুন গাণ্ডীবে জ্যাসংযোজিত ও মন্ত্রপূত করিয়া সর্পের ন্যায় দেদীপ্যমান শরনিকরে কর্ণকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন জ্যা ছিন্ন হইবামাত্র অবিলম্বে অন্য জ্যা সংযোজন করিলে কর্ণ তাঁহার জ্যা-যোজন-বৃত্তান্ত [গুণসংযোজিত করার রহস্য] বুঝিতে না পারিয়া চমৎকৃত হইলেন।

কর্ণের রথচক্র উদ্ধারচেষ্টা

‘‘অনন্তর সূতপুত্র অস্ত্রজালে সব্যসাচীর অস্ত্র ছেদনপূর্ব্বক অসাধারণ পরাক্রম প্রদর্শনপূর্ব্বক তাহা অপেক্ষাও প্রবল হইয়া উঠিলেন। তখন বাসুদেব অর্জ্জুনকে কর্ণাস্ত্রে নিপীড়িত দেখিয়া কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! প্রধান অস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক কর্ণের সমীপবর্তী হও।’ শত্রুতাপন ধনঞ্জয় কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর সর্পবিষ ও অনলের ন্যায় ভয়ঙ্কর দিব্য-রৌদ্রাস্ত্র মন্ত্রপূত করিয়া ক্ষেপণ করিতে বাসনা করিলেন। ঐ সময়ে বসুমতী সূতপুত্রের রথচক্র দৃঢ়রূপে গ্রাস করিলেন। মহাবীর কর্ণ তদ্দর্শনে তৎক্ষণাৎ রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া ভুজদ্বয়দ্বারা চক্রের উদ্ধার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তখন গিরিকানন-সমবেতা সপ্তদ্বীপা মেদিনী কর্ণের বাহুবলে আকৃষ্ট হইয়া চারি অঙ্গুলি পৰ্য্যন্ত উৎক্ষিপ্ত হইলেন; কিন্তু সূতপুত্রের রথচক্র কোনক্রমেই উদ্ধৃত হইল না। তখন তিনি ক্রোধে অশ্রু পরিত্যাগপূর্ব্বক কোপাবিষ্ট অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে পার্থ! তুমি মুহূর্ত্তকাল যুদ্ধে নিবৃত্ত হও। আমি মহীতল হইতে রথচক্র উদ্ধার করিতেছি। দৈববশতঃ আমার দক্ষিণচক্র পৃথিবীতে প্রোথিত হইয়াছে। এ সময়ে তুমি কাপুরুষোচিত দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ কর। তুমি রণপণ্ডিত বলিয়া বিখ্যাত আছ, এক্ষণে অভদ্রের ন্যায় কাৰ্য্য করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। হে অর্জ্জুন! সাধুব্রতাবলম্বী শূরগণ মুক্তকেশ, বিমুখ, বদ্ধাঞ্জলি, শরণাগত, যাচমান, ন্যস্তশস্ত্র, বাণবিহীন, কবচহীন ও ভগ্নায়ুধ ব্যক্তির এবং ব্রাহ্মণের প্রতি শর পরিত্যাগ করেন না। ইহলোকে তুমি শূরতম [সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বীর], ধার্ম্মিক, যুদ্ধধর্ম্মাভিজ্ঞ, দিব্যাস্ত্রবেত্তা, মহাত্মা, বেদপারগ ও কাৰ্ত্তবীর্য্যের ন্যায় পরাক্রান্ত বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছ। বিশেষতঃ আমি এক্ষণে ভূতলগত ও বিকলাঙ্গ হইয়াছি। তুমি রথোপরি অবস্থান করিতেছ, অতএব যে পৰ্য্যন্ত রথচক্র উদ্ধার করিতে না পারি, তাবৎ আমাকে বিনাশ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। আমি বাসুদেব বা তোমা হইতে কিছুমাত্র ভীত হই নাই; তুমি ক্ষত্রিয়দিগের মহাকুলে সমুৎপন্ন হইয়াছ বলিয়াই তোমাকে কহিতেছি যে, তুমি মুহূর্ত্তকাল আমাকে ক্ষমা কর।”