৮৮. রণক্ষেত্রে যুদ্ধেচ্ছু কর্ণার্জ্জুন সমাগম

৮৮তম অধ্যায়

রণক্ষেত্রে যুদ্ধেচ্ছু কর্ণার্জ্জুন সমাগম

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর কর্ণ বৃষসেনের বিনাশ দর্শনে পুত্র শোকসন্তপ্ত হইয়া বাম্পবারি পরিত্যাগ করিতেছিলেন, ইত্যবসরে তিনি অর্জ্জুনকে সমীপে অবলোকন করিয়া রোষতাম্ৰনেত্রে [ক্রোধবশতঃ তাম্রবর্ণ নয়নে] তাঁহাকে যুদ্ধার্থ আহ্বানপূর্ব্বক তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন সেই বীরদ্বয়ের ব্যাঘ্রচর্ম্মপরিবৃত রথদ্বয় একত্র মিলিত হইয়া উদিত সূৰ্য্যদ্বয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল এবং সেই অরাতিনিসূদন বীরদ্বয় শ্বেতাশ্বযুক্ত রথে অবস্থানপূর্ব্বক গগনমণ্ডলস্থ চন্দ্ৰসুর্য্যের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। সৈনিকগণ ত্রৈলোক্যজয়াকাঙ্ক্ষী ইন্দ্র ও বলিরাজের ন্যায় সমরে সমুদ্যত সেই বীরদ্বয়কে দর্শন করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইল। ভূপালগণ তাহাদিগের রথনির্ঘোষ, জ্যাতলশব্দ, শরনিঃস্বন ও সিংহনাদ শ্রবণ করিয়া দ্রুতবেগে পরস্পরের প্রতি ধাবমান এবং কর্ণের ধ্বজে হস্তিকক্ষ ও অর্জ্জুনের ধ্বজে ভীষণ বানর বিরাজমান দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে সিংহনাদসহকারে সেই রথীদ্বয়কে অনবরত সাধুবাদ করিতে লাগিলেন। সহস্র সহস্র বীরপুরুষ দুই বীরকে দ্বৈরথযুদ্ধে সমুদ্যত দেখিয়া বাহ্বাস্ফোটন ও বস্ত্রকম্পন করিতে আরম্ভ করিলেন। কৌরবগণ কর্ণকে আমোদিত করিবার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে বাদিধ্বনি ও শঙ্খনিঃস্বন করিতে লাগিলেন; পাণ্ডবগণও তুৰ্য্য ও শঙ্খের নিনাদে ধনঞ্জয়কে আনন্দিত করিয়া দশদিক্ প্রতিধ্বনিত করিলেন। ঐ সময় চতুর্দ্দিকে শূরগণের সিংহনাদ ও বাহ্বাস্ফোটন শ্রবণগোচর হইতে লাগিল।

“হে মহারাজ! তৎকালে মহাবীর অর্জ্জুন ও কর্ণ শর, শরাসন, শক্তি, খড়্গ, তূণীর, শঙ্খ ও বর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক রথারোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা উভয়েই অতিপ্রিয়দর্শন। তাঁহাদের স্কন্ধ সিংহের ন্যায়, বাহুযুগল বিশাল, লোচন লোহিতবর্ণ, সুবিস্তীর্ণ বক্ষস্থল সুবর্ণ মাল্যদামে সমলঙ্কৃত ও সর্ব্বাঙ্গ রক্তচন্দনে চর্চিত। পরিচারকগণ মহাবৃষভের ন্যায় গর্ব্বিত মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয়কে চামরবীজন ও তাঁহাদের মস্তকে শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করিয়াছিল। ঐ বীরদ্বয়ের মধ্যে একজনের রথে মহাবীর শল্য এবং অন্যের রথে মহাত্মা বাসুদেব সারথ্য করিতেছিলেন। সেই যুগান্তকালীন কৃতান্ততুল্য আশীবিষশিশুসন্নিভ বীরদ্বয় পরস্পরের বধসাধন ও জয়লাভের অভিলাষ করিয়া পরস্পরের প্রতি ধাবমান হওয়াতে তাঁহাদিগকে গোষ্ঠস্থিত বৃষভদ্বয়ের ন্যায়, প্রভিন্নগণ্ড [ভগ্ন গণ্ড] মাতঙ্গযুগলের ন্যায়, রোষাবিষ্ট পৰ্বতদ্বয়ের ন্যায়, ক্রোধোদ্ধত পুরন্দর ও বৃত্রাসুরের ন্যায় এবং ক্রুদ্ধ মহাগ্রহদ্বয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তাঁহারা উভয়েই দেবাংশসঞ্জাত [দেবতার অংশে জাত-সূৰ্য্য হইতে কর্ণ, ইন্দ্র হইতে অর্জ্জুন], দেবতুল্য বলশালী ও রূপে দেবতার অনুরূপ। সেই নানা শস্ত্রধারী মহাবীরদ্বয় তৎকালে সমরাঙ্গনে যদৃচ্ছাক্রমে আগত সূৰ্য্য ও চন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় বীরগণ মহাবীর অর্জ্জুন ও কর্ণকে শালদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর সম্মুখীন নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় হৃষ্ট হইল। পৌরুষ ও বলপ্রভাবে বিশ্রুত সম্বর ও অমররাজের সদৃশ ঐ মহাবীরদ্বয় সংগ্রামে কার্ত্তবীৰ্য্যতুল্য, দশরথতনয় রামের অনুরূপ ও ভূতভাবন ভগবান্ ভবানীপতির তুল্য। তাঁহাদিগের বলবীর্য্য বৈকুণ্ঠনাথ বিষ্ণুর সদৃশ। ঐ সময়ে তাঁহারা বাহ্বাস্ফোটনশব্দে নভস্থল অনুনাদিত করিতে লাগিলেন। তখন কেহই সেই একত্র সমবেত বীরদ্বয়ের মধ্যে যে কাহার জয়লাভ হইবে, তাহা স্থির করিতে সমর্থ হইল না।

“অনন্তর সিদ্ধ ও. চারণগণ সেই মহারথদ্বয়কে সমরাঙ্গনে শোভমান দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন হইলেন। তখন আপনার মহাবলপরাক্রান্ত পুত্রগণ সৈন্যসমভিব্যাহারে সমরশোভী [২] মহাত্মা কর্ণকে পরিবেষ্টন করিলেন; ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ পাণ্ডবগণও অদ্বিতীয় যোদ্ধা মহাত্মা ধনঞ্জয়ের চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সংগ্রামে মহাবীর কর্ণ কৌরবগণের ও মহাবীর অর্জ্জুন পাণ্ডবগণের পণস্বরূপ হইলেন; বীরগণ পক্ষদ্বয়ের জয়পরাজয়দর্শনার্থে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় সেই সমরশোভী ক্রোধাবিষ্টচিত্ত বীরদ্বয় পরস্পর পরস্পরের প্রতি প্রহার ও পরস্পরকে বিনাশ করিতে সমুদ্যত হওয়াতে তাঁহাদিগকে ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের ন্যায় ভীষণমূৰ্ত্তি মহাধূমকেতুদ্বয়ের ন্যায় বোধ হইল।

অন্তরীক্ষে কর্ণার্জ্জুন–পক্ষপাতিগণের সম্মেলন

“অনন্তর কর্ণ ও অর্জ্জুনের নিমিত্ত অন্তরীক্ষস্থিত প্রাণীগণের পরস্পর মহাবিবাদ ও ভেদ উপস্থিত হইল। দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, পিশাচ, উরগ ও রাক্ষসগণ সকলেই কেহ কর্ণের এবং কেহ বা অর্জ্জুনের পক্ষ অবলম্বন করিলেন। আকাশমণ্ডল সূতপুত্রের এবং ভূমণ্ডল অর্জ্জুনের পক্ষ অবলম্বন করিল। পৰ্বত, সমুদ্র, নদী, মেঘ, বৃক্ষ ও লতাসকল কেহ কর্ণ ও কেহ অর্জ্জুনের পক্ষ আশ্রয় করিল। মুনি, সিদ্ধ ও চারণ; গরুড় ও অন্যান্য পক্ষী; রত্ন ও নিধি; চতুৰ্বেদ, আখ্যান, উপবেদ, উপনিষদ, রহস্য ও সংগ্রহ; বাসুকি, চিত্রসেন, তক্ষক, মণিক, ঐরাবত, সৌরভেয় ও বৈশালেয়; বৃক, শশ ও অন্যান্য মঙ্গলজনক পশুপক্ষী; অষ্টবসু, বায়ু, সাধ্য, রুদ্র, বিশ্বদেব, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অগ্নি, ইন্দ্র, চন্দ্র, দশদিক্‌, পদানুগ [অনুচর] সমবেত দেবলোক ও পিতৃলোক; যম, কুবের, বরুণ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, যজ্ঞ, দক্ষিণা, সমুদয় রাজর্ষি এবং তুম্বরুপ্রমুখ গন্ধর্ব্বগণ অর্জ্জুনের পক্ষ হইলেন। আদিত্য, অসুর, রাক্ষস, গুহ্যক, পক্ষী, বৈশ্য, শূদ্র, সূত, সঙ্করজাতি, প্রেত, পিশাচ, অন্যান্য ক্ৰব্যাদ, জলজন্তু, শৃগাল, কুকুর ও ক্ষুদ্র সর্পগণ কর্ণের পক্ষ অবলম্বন করিল। প্রাধেয়, মৌনেয়প্রমুখ গন্ধর্ব্বগণ ও অপ্সরাগণ কর্ণ ও অর্জ্জুনের সংগ্রামদর্শনবাসনায় বৃক, শশ, হস্তী, অশ্ব, রথ, মেঘ ও বায়ু বাহনে আরোহণ করিয়া সমাগত হইলেন। দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষসী, পক্ষী, তপোনিষ্ঠানিরত বেদজ্ঞ মহর্ষি, স্বধাভোগী পিতৃলোক এবং ওষধিসকল কোলাহলধ্বনি করিয়া নভোমণ্ডলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কমলযোনি ব্রহ্ম, ব্রহ্মর্ষি ও প্রজাপতিগণের সহিত সমবেত হইয়া এবং মহাত্মা মহাদেব দিব্যযানে আরোহণ করিয়া যুদ্ধদর্শনার্থ সমাগত হইলেন।

ইন্দ্র-সূৰ্য্যদ্বন্দ্ব-কর্ণার্জ্জুনের জয়পরাজয়-প্রশ্ন

“অনন্তর ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্র মহাত্মা কর্ণ ও ধনঞ্জয়কে সংগ্রামার্থ পরস্পর সমাগত দেখিয়া কহিলেন, -‘অদ্য আমার তনয় ধনঞ্জয় সূতপুত্রকে বিনাশ করিবে।’ সূৰ্য্যদেব কহিলেন, ‘আমার আত্মজ কর্ণ অর্জ্জুনকে বিনাশ করিয়া জয়শ্রীলাভে কৃতকার্য্য হইবে।’ এইরূপে তৎকালে সুররাজ ইন্দ্র ও সূর্য্যের বিবাদ উপস্থিত হইল। তখন তাঁহারা পরস্পর পৃথক পৃথক্ পক্ষ আশ্রয় করিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে দেবর্ষি ও চারণগণসমবেত ত্রিলোকস্থ সমস্ত ব্যক্তি কর্ণ ও ধনঞ্জয়কে যুদ্ধার্থ মিলিত দেখিয়া বিকম্পিত হইতে লাগিলেন। অসুরগণ কর্ণের পক্ষে এবং অমরগণ ও অন্যান্য ভূতসমুদয় অর্জ্জুনের পক্ষে অবস্থান করিলেন। অনন্তর দেবগণ সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মাকে কহিলেন, “ভগবন্‌! অর্জ্জুন ও কর্ণ এই দুই মহাবীরের মধ্যে কোন্ বীর বিজয়লাভ করিবে? আমাদের মতে ইহাদিগের উভয়েরই জয়লাভ হওয়া উচিত, অতএব ইহারা উভয়েই সমরে ক্ষান্ত হউক। হে দেব! এই দুই বীরের বিবাদে সমস্ত জগৎ সংশয়গ্রস্ত হইয়াছে। এক্ষণে ইহাদের মধ্যে কে বিজয়লাভে সম্যক্ অধিকারী, আপনি তাহা নিশ্চয় করিয়া বলুন। হে ব্ৰহ্মন্! ইহাদের উভয়েরই যে বিজয়লাভ হওয়া উচিত, ইহা আপনি স্বীকার করুন।’

“হে মহারাজা তখন সুররাজ ইন্দ্র দেবগণের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া ব্ৰহ্মাকে প্রণিপাতপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ভগবন্! পূর্ব্বে দেবাদিদেব মহাদেব কহিয়াছিলেন, বাসুদেব ও অর্জ্জুনের নিশ্চয়ই বিজয়লাভ হইবে। এক্ষণে আমি আপনাকে বারংবার নমস্কার করিতেছি, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। মহেশ্বর যেরূপ কহিয়াছেন, তাহার যেন অন্যথা না হয়। তখন ভগবান্ ব্রহ্মা ইন্দ্রের এই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া মহাদেবের সমক্ষে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে সুররাজ! যে মহাবীর খাণ্ডবপ্রস্থে হুতাশনের তৃপ্তিসাধন ও দেবলোকে উপস্থিত হইয়া তোমাকে যথোচিত সাহায্য দান করিয়াছে, তাহার অবশ্যই জয়লাভ হইবে। সূতপুত্র দানবদিগের পক্ষ; অতএব তাহার পরাজয় হওয়া উচিত। অর্জ্জুন কর্ণকে পরাজিত করিলে দেবগণেরও দানবজয়রূপ কাৰ্য্যসাধন হইবে, সন্দেহ নাই। এই নিমিত্তই আমরা অর্জ্জুনের জয় প্রার্থনা করিতেছি। আত্মকাৰ্য্যসংসাধন করাই সকলের গুরুতর কাৰ্য্য। আর দেখ, মহাত্মা ধনঞ্জয় সতত সত্যধর্ম্মনিরত। ঐ বীর অস্ত্রবলে ভগবান বৃষভবাহনের সন্তোষসম্পাদন করিয়াছিল, অতএব সেই মহাবীরের অবশ্যই জয়লাভ হইবে। মহাবীর ধনঞ্জয় মহাবলপরাক্রান্ত, শিক্ষিতাস্ত্র ও তপোবলসম্পন্ন; ঐ মহাবীর ধনুর্ব্বেদে সম্যক্ অধিকারী হইয়াছে; বিশেষতঃ জগতের প্রভু ভগবান্ বিষ্ণু স্বয়ং তাহার সারথ্য করিতেছেন; অতএব কি নিমিত্ত তাহার জয়লাভ হইবে না? এক্ষণে অর্জ্জুনের জয় হইলে একটি দেবকাৰ্য্যসাধন এবং পাণ্ডবগণের বনবাস প্রভৃতি বিবিধ ক্লেশ নিবারিত হয়। অতএব তাহারই জয়লাভ হওয়া উচিত।’

দেবগণের অর্জ্জুনজয়সিদ্ধান্ত

“হে দেবেন্দ্র! মহাবীর অর্জ্জুন তপঃপ্রভাবসম্পন্ন, তাহার দৈববল মহত্ত্বনিবন্ধন পুরুষকারকে অতিক্রম করিয়াছে। অতএব উহার অরাতিগণ সমূলে উন্মূলিত হইবে সন্দেহ নাই। ধনঞ্জয় ও বাসুদেব রোয়পরবশ হইলে সমরাঙ্গনে মৰ্য্যাদা অতিক্রম করিয়া থাকেন। ইঁহারা পুরাণ, ঋষি, নর ও নারায়ণ; ইঁহারাই জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা; ইঁহারাই সকলকে শাসন করিয়া থাকেন। কিন্তু ইঁহাদিগের নিয়ন্তা কেহই নাই! কি স্বর্গ, কি মৰ্ত্ত, কুত্রাপি ইহাদিগের তুল্য ব্যক্তি নাই। দেবর্ষি, চারণ, দেবতা ও অন্যান্য। প্রাণীগণ ইঁহাদিগের অনুগত হইয়া আছেন। ইঁহাদেরই প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব বিদ্যমান রহিয়াছে; অতএব এক্ষণে ইঁহারাই জয়শ্রী অধিকার করুন। আর এই সূতপুত্র দ্রোণের সহিত দেবলোক বা ভীষ্মের সহিত বসুলোক প্রাপ্ত হউক।’ হে মহারাজ! সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্ম এই কথা কহিলে দেবাদিদেবও তাঁহার বাক্যে অনুমোদন করিলেন।

“তখন দেবরাজ পুরন্দর ব্রহ্মা ও রুদ্রদেবের বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া তত্ৰত্য সমুদয় প্রাণীকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মহাত্মগণ! ভগবান্ ব্রহ্মা ও রুদ্র যে জগতের হিতকর কথা কহিলেন, তাহা আপনারা শ্রবণ করিলেন। উহাদের কথা কদাচ অন্যথা হইবে না। অতএব এক্ষণে আপনারা নিশ্চিন্ত হইয়া অবস্থান করুন।’ তখন তত্রত্য সমস্ত প্রাণী দেবরাজের সেই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া একান্ত বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। দেবগণ হর্ষভরে নানাপ্রকার সুগন্ধি পুষ্পবর্ষণ ও তূৰ্য্যধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। সুর, অসুর ও গন্ধর্ব্বগণ সেই বীরদ্বয়ের অদ্ভুত দ্বৈরথযুদ্ধ অবলোকন করিবার নিমিত্ত অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সমরাঙ্গনস্থ মহাবীর সেই বীরদ্বয়ের অধিকৃত দিব্যরথসমীপে সমাগত হইয়া শঙ্খনাদ করিতে আরম্ভ করিল। তখন মহাত্মা অর্জ্জুন ও বাসুদেব এবং মহাবীর কর্ণ ও শল্য—ইঁহারাও হৃষ্টচিত্তে শঙ্খবাদন করিতে লাগিলেন।

কর্ণার্জ্জুনযুদ্ধ–রথী-সারথির সরস সমরালাপ

“অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র ও শম্বরাসুরের ন্যায় সেই বীরদ্বয়ের ভীরুজনভয়ঙ্কর ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। মহাবীর কর্ণের আশীবিষসদৃশ, রত্নময়, সুদৃঢ় শক্ৰশাসনতুল্য হস্তিকক্ষধ্বজ এবং অর্জ্জুনের মধ্যাহ্নকালীন দিবাকরের ন্যায়, ব্যাদিতবদন কৃতান্তের ন্যায় নিতান্ত দুর্ণিরীক্ষ্য বিকটদশন বানরধ্বজ সকলের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার করিয়া শোভা পাইতে লাগিল। তৎকালে তাঁহাদিগের সেই দুইটি ধ্বজ প্রলয়কালে নভোমণ্ডলে সমুদিত রাহু ও কেতুগ্রহের ন্যায় নিরীক্ষিত হইল। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয়ের ধ্বজস্থিত কপিবর সংগ্রামার্থী হইয়া স্বস্থান হইতে মহাবেগে কর্ণের হস্তিকক্ষাধ্বজে উৎপতিত হইল এবং গরুড় যেমন ভুজঙ্গকে ছিন্নভিন্ন করে, তদ্রূপ নখ ও দন্তদ্বারা উহা ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিল। তখন সূতপুত্রের সেই কিঙ্কিণীজালজড়িত কালপাশোপম [যমপাশসদৃশ] হস্তিকক্ষা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কপিবরের প্রতি ধাবমান হইল। এইরূপে সেই বীরদ্বয়ের ঘোরতর দ্বৈরথযুদ্ধে প্রথমতঃ দুই ধ্বজের তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। ঐ সময় উভয়ের অশ্বগণ পরস্পর স্পর্ধা প্রকাশপূর্ব্বক হ্রেষারব পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিল। অনন্তর বাসুদেব শল্যের প্রতি কটাক্ষনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন মদ্ররাজ ও কর্ণ বারংবার কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের প্রতি কটাক্ষপাত করিলেন। অনন্তর মহাবীর সূতপুত্র হাস্যমুখে শল্যকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! যদি ধনঞ্জয় আজ আমাকে বিনাশ করে, তাহা হইলে তুমি কি করিবে, তাহা সত্য করিয়া বল।’ শল্য কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! যদি আজ মহাবীর শ্বেতাশ্ব অর্জ্জুন সমরাঙ্গনে তোমাকে নিহত করে, তাহা হইলে আমি সত্য কহিতেছি যে, আমি একাকীই কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে বিনাশ করিব। হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন কৃষকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে বাসুদেব! যদি আজ কর্ণ আমাকে নিহত করে, তাহা হইলে তুমি কি করিবে?’ কৃষ্ণ অর্জ্জুনের বাক্যশ্রবণে ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! যদি দিবাকর স্বস্থান হইতে নিপতিত হয়েন, যদি মহোদধি পরিশুষ্ক হয় এবং যদি হুতাশন শৈত্যগুণ অবলম্বন করেন, তথাপি কর্ণ তোমাকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে না। যদিও কথঞ্চিৎ এরূপ ঘটনা হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্রলয়কাল উপস্থিত হইবে। আমি কর্ণ ও শল্যকে ভুজদ্বারা নিহত করিব।’

“হে মহারাজ! কপিকেতন অর্জ্জুন বাসুদেবের এই কথা শুনিয়া হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘হে জনার্দ্দন! সূতপুত্র ও শল্য উঁহারা উভয়ে সমবেত হইলেও আমি উঁহাদিগকে আপনার সমকক্ষ জ্ঞান করি না। আজ তুমি অচিরাৎ দেখিতে পাইবে যে, হস্তী যেমন বৃক্ষ বিমর্পিত করিয়া চূর্ণ করে, তদ্রূপ আমি কর্ণকে রথ, অশ্ব, ধ্বজ, পতাকা, ছত্র, কবচ, শর, শক্তি, শরাসন ও সারথি শল্যের সহিত শতধা ছিন্নভিন্ন ও বিচূর্ণিত করিব। হে মাধব! আজ কর্ণের পত্নীগণের বৈধব্যদশা উপস্থিত হইবে। তাহারা নিশ্চয়ই দুঃখস্বপ্ন দর্শন করিয়াছে। হে কৃষ্ণ! আজ তুমি কর্ণপত্নীদিগকে বিধবা দর্শন করিবে, সন্দেহ নাই। পূর্ব্বে দুরাত্মা সূতপুত্ৰ সভামধ্যে কৃষ্ণাকে ও আমাদিগকে বারংবার উপহাস করাতে আমার মনোমধ্যে যে ক্রোধোদয় হইয়াছিল, অদ্যাপি তাহার শান্তি হয় নাই। অতএব মত্তমাতঙ্গ যেমন পুষ্পিত বনস্পতিকে উন্মূলিত করে, তদ্রূপ আমি কর্ণকে উন্মত্থিত করিব। হে গোবিন্দ! আজ সূতপুত্র নিপাতিত হইলে তুমি জয়লাভে আহ্লাদিত হইয়া অভিমন্যুর জননী, স্বীয় পিতৃষ্বসা [পিসী] কুন্তী, সজলনয়না দ্রৌপদী এবং ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে অমৃততুল্য মধুরবচনে সান্ত্বনা করিবে।”