৭৫. অর্জ্জুনের বীরদর্পসহ কৃষ্ণবাক্যে অনুমোদন

৭৫তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের বীরদর্পসহ কৃষ্ণবাক্যে অনুমোদন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া ক্ষণমধ্যে শোকশূন্য ও সন্তুষ্ট হইলেন। তখন তিনি কর্ণবিনাশার্থ গাণ্ডীব গ্রহণ ও উহার জ্যাপরিমার্জন করিয়া কেশবকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে সখে! তুমি ভূত ও ভবিষ্যতের প্রবর্ত্তয়িতা [প্রযোজক]। তুমি যখন আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া আমার সহায় হইয়াছ, তখন নিশ্চয়ই আমার জয়লাভ হইবে। হে কৃষ্ণ! আমি তোমার সাহায্যলাভ করিয়া সূতপুত্রের কথা দূরে থাকুক, একত্র মিলিত ত্রিশোকস্থ সমস্ত ব্যক্তিরই বিনাশসাধন করিতে পারি। হে জনার্দ্দন! আমি এক্ষণে পাঞ্চালসৈন্যগণকে ধাবমান হইতে এবং সূতপুত্রকে আশঙ্কিতচিত্তে সমরাঙ্গনে সঞ্চরণ করিতে নিরীক্ষণ করিতেছি। দেবরাজনির্ম্মুক্ত বজ্রের ন্যায় সূতপুত্রপরিত্যক্ত ভার্গবাস্ত্রও চতুর্দ্দিকে প্রজ্বলিত হইতেছে। আজ এই ঘোরতর সংগ্রামে আমি সূতপুত্রকে সমরে নিহত করিলে, যতদিন এই পৃথিবী বিদ্যমান থাকিবে, ততদিন আমার এই কীর্তি সর্ব্বত্র দেদীপ্যমান রহিবে। আজ আমার বিকর্ণ অস্ত্রসকল গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত হইয়া কর্ণকে যমালয়ে প্রেরণ করিবে; আজ রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যলাভের অযোগ্য দুৰ্য্যোধনকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছেন বলিয়া আপনার বুদ্ধির নিন্দা করিবেন। আজ তিনি রাজ্যহীন, সুখহীন, শ্রীহীন ও পুত্রবিহীন হইবেন, সন্দেহ নাই। আজি কর্ণ নিহত হইলে দুৰ্য্যোধন নিশ্চয়ই রাজ্য ও জীবিতাশায় নিরাশ হইয়া, তুমি সন্ধিস্থাপনোপলক্ষে যেসকল কথা কহিয়াছিলে, তৎসমুদয় স্মরণ করিবে। আজ গান্ধাররাজ শকুনি আমার শরনিকর গ্লহ [পাশার খুঁটি], গাণ্ডীব দুরোদর [পাশাখেলা] ও রথকে শারীস্থাপনমণ্ডল বলিয়া অবগত হইবে। আজ আমি নিশিতশরজালে সূতপুত্রকে সমরশায়ী করিয়া ধর্ম্মরাজের রজনীজাগরণদুঃখ অপনীত করিব। আজ তিনি প্রীত ও প্রসন্নমনে শাশ্বত সুখভোগে কৃতনিশ্চয় হইবেন। আজি আমি নিশ্চয়ই এক নিতান্ত দুঃসহ অপ্রতিম শর পরিত্যাগপূর্ব্বক কর্ণকে সমরশায়ী করিব। হে কৃষ্ণ। দুরাত্মা সূতপুত্র পূর্ব্বে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, আমি অর্জ্জুনকে বিনাশ না করিয়া কদাচ পদক্ষালন করিব না; আজ আমি সন্নতপৰ্ব্বশরদ্বারা তাহার দেহ রথ হইতে নিপাতিত করিয়া তাহার সেই ব্রত নিতান্ত নিষ্ফল করিব। দুরাত্মা সূতপুত্র রণস্থলে কোন মনুষ্যকেই লক্ষ্য করে না; কিন্তু আজ আমার শরপ্রভাবে অবনী তাহার শোণিত পান করিবে। পূর্ব্বে ঐ হতভাগ্য, দুর্য্যোধনের অভিলাষানুসারে আত্মশ্লাঘা করিয়া দ্রৌপদীকে ‘হে কৃষ্ণে! তুমি এক্ষণে পতিহীনা হইয়াছ’ বলিয়া যে উপহাস করিয়াছিল, আজ আমার রোষাদ্ধত আশীবিষের ন্যায় ভীষণদর্শন সুনিশিত শরজাল তাহার সেই বাক্যের অসত্যতা প্রতিপাদন করিয়া তাহার শোণিত পান করিবে। আজ বিদ্যুতের ন্যায় একান্ত উজ্জ্বল নারাচনিকর মদীয় ভূজদণ্ডসমাকৃষ্ট [বাহুদ্বার সম্যক আকৃষ্ট] গাণ্ডীব হইতে বিনির্গত হইয়া সূতনন্দনকে উৎকৃষ্ট গতি প্রদান করিবে। পূর্ব্বে কর্ণ সভামধ্যে পাণ্ডবগণকে ভৎসনা করিয়া দ্রৌপদীর প্রতি যে সমস্ত নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিল, আজ তন্নিমিত্ত নিশ্চয়ই অনুতাপ করিবে। যে পাণ্ডবেরা কৌরবসভায় ষণ্ডতিল হইয়াছিল, আজ দুরাত্মা কর্ণ নিহত হইলে তাঁহারা তিল হইবেন। নির্ব্বোধ রাধানন্দন আপনার গুণগর্ব্ব প্রকাশ করিয়া পাণ্ডবগণের হস্ত হইতে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগকে পরিত্রাণ করিবে কহিয়াছিল, আজ আমার সুশাণিত শরজাল তাহার সেই বাক্য নিষ্ফল করিবে। যে দুরাত্মা পাণ্ডবগণকে মাতার সহিত বিনাশ করিবে বলিয়াছিল এবং দুৰ্য্যোধন যাহার ভুজবীর্য্যের উপর নির্ভর করিয়া প্রতিনিয়ত পাণ্ডবগণের অবমাননা করিয়া থাকে, আজ আমি ধনুর্দ্ধরদিগের সমক্ষে সেই সূতনন্দনের বিনাশসাধন করিব। আজ মহাবীর কর্ণ পুত্রগণ ও বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে আমার শরে নিহত হইলে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ সিংহদর্শনভীত মৃগযুথের ন্যায় ভয়াকুলিতচিত্তে চতুর্দ্দিকে পলায়নে প্রবৃত্ত হইবে এবং দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন স্বীয় দুষ্কর্ম্মের নিমিত্ত অনুতাপ ও আমাকে ধনুর্দ্ধরদিগের অগ্রগণ্য বলিয়া গণনা করিবে। আজ আমি কর্ণকে নিহত করিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে পুত্র, পৌত্র, অমাত্য ও ভূত্যবর্গের সহিত নিরাশ্রয় করিব। আজ চক্রাঙ্গ [তন্নামক পক্ষী] ও বিবিধ ক্ৰব্যাদগণ আমার শরনিকরে ছিন্ন সূতপুত্রের দেহের উপর সঞ্চরণ করিবে। আজ আমি সমস্ত ধনুর্দ্ধরসমক্ষে তীক্ষ্ণ বিপাঠ ও ক্ষুরাস্ত্রদ্বারা দুরাত্মা রাধাপুত্রের শরীর বিদারণ ও মস্তকচ্ছেদন করিব। আজ রাজা যুধিষ্ঠির চিরসঞ্চিত মনস্তাপ ও মহাকষ্ট হইতে মুক্ত হইবেন। আজ আমি সূতপুত্রকে বান্ধবগণের সহিত বিনাশ করিয়া ধর্ম্মনন্দনকে আনন্দিত করিব। আজ আমার সর্পবিষসদৃশ পাবকসন্নিভ গুধ্রপত্রযুক্ত সায়কে কর্ণের অনুচরগণ নিহত হইবে। আজ আমি নরপালগণের দেহে বসুন্ধরা সমাচ্ছন্ন এবং নিশিতশরনিকরে অভিমন্যুর শত্রুগণের মস্তক ছিন্ন ও কলেবর ক্ষতবিক্ষত করিব। আজ আমি হয় এই পৃথিবী ধৃতরাষ্ট্রতনয়শূন্য করিয়া জ্যেষ্ঠতার হস্তে সমৰ্পণ করিব, না হয় তুমি অর্জ্জুনবিহীন হইয়া ইহাতে বিচরণ করিবে। আজ আমি সমুদয় ধনুর্দ্ধরসমক্ষে ক্রোধশরসমুদয় ও গাণ্ডীবশরাসনের ঋণ পরিশোধ করিব। হে কৃষ্ণ! পুরন্দর যেমন সম্বরকে বিনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আজ আমি কর্ণকে নিহত করিয়া ত্রয়োদশবর্ষসঞ্চিত দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইব। আজ সূতপুত্র বিনষ্ট হইলে মিত্ৰজয়লাভার্থী সোমবংশীয় মহারথগণ চরিতার্থ হইবেন। আজ আমি সমরে জয়লাভ করিলে সাত্যকির আহ্লাদের আর পরিসীমা থাকিবে না। আজ আমি কর্ণকে ও উহার মহারথতনয়কে নিহত করিয়া ভীমসেন, নকুল, সহদেব ও সাত্যকিকে পরম প্রীত এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও অন্যান্য পাঞ্চালগণের ঋণ হইতে মুক্ত হইব। আজ সকলে অমর্ষপরায়ণ ধনঞ্জয়কে সমরাঙ্গনে কৌরবগণের সহিত সংগ্রাম ও সূত্রপুত্রকে বিনাশ করিতে সন্দর্শন করুক।

“হে মাধব! আমি পুনরায় তোমার নিকট আত্মগুণ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। এই ভূমণ্ডলে ধনুর্ব্বিদ্যাপরায়ণ, পরাক্রমশালী, ক্রোধপরায়ণ বা ক্ষমাগুণসম্পন্ন আর কোন ব্যক্তি নাই। আমি ধনুর্ধারণ করিলে একাকী একত্র সমবেত সমুদয় সুর, অসুর ও অন্যান্য প্রাণীগণকে পরাভূত করিতে পারি। অতএব তুমি আমাকে অন্যান্য ব্যক্তি অপেক্ষা সমধিক পুরুষকারসম্পন্ন বলিয়া অবগত হও। আমি গ্রীষ্মকালীন কক্ষদহন দহনের ন্যায় একাকীই গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শরনিকরদ্বারা সমস্ত কৌরব ও বাকগণকে দগ্ধ করিতে পারি। আমার হস্তে শরনিকর ও শরসমাযুক্ত দিব্যশরাসন এবং পদতলে রথ ও ধ্বজের চিহ্ন বিদ্যমান রহিয়াছে; অতএব মাদৃশ ব্যক্তি যুদ্ধার্থ গমন করিলে কেহই তাহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয় না।’

“হে মহারাজ! লোহিতলোচন অদ্বিতীয় বীর অর্জ্জুন কেশবকে এই কথা বলিয়া ভীমসেনের পরিত্রাণ ও কর্ণের মস্তকচ্ছেদন বাসনায় সমরে অগ্রসর হইলেন।”